আদি জ্যোতির সাতে সবিতার জ্যোতি আর আত্মার চৈতন্যের জ্যোতির কোনো পার্থক্য নেই। তাই কবি কামনা করেছেন :
সমস্ত কুহেলিকা ভেদ করে
চৈতন্যের শুভ্র জ্যোতি সত্যের অমৃতরূপ করুক প্রকাশ,
যে সংসারের ক্ষুব্ধতার স্তব্ধ-ঊর্ধ্ব লোকে
নিত্যের যে শান্তিরূপ তাই যেন দেখে নিতে পারি,
আর-এ জন্মের সত্য অর্থ স্পষ্ট চোখে জেনে যাই যেন
সীমা তার পেরবার আগে। (আরোগ্য–৩৩)
কবির অভিলাষ পূর্ণ হয়েছিল। তবু কবি বলেন :
এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি,
এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান,
বিদায় নিবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার। (রোগশয্যায়-২৬)
এবং
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো
এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে। (মৃত্যুঞ্জয়)
এইভাবে কবি ভূলোকে-দ্যুলোকে এবং মহাশূন্যতায় ও মহাপূর্ণতায় বিচরণ করেছেন পরিপূর্ণ আনন্দে, তৃপ্তিতে এবং বিশ্বাসে। তাই এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি।
এবং সেজন্যেই মহা অজানার পরিচয় ও সম্মুখে শান্তি পারাবারের সন্ধান পেয়েও কবি যে মধুর মর্ত্যজীবন পেছনে ফেলে যাচ্ছেন সে জীবনের অধিদেবতাকে নম্র নমস্কারে কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং যারা বন্ধুজন তাদের হাতের পরশে মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে জীবনের চরম প্রসাদ এবং মানুষের শেষ আশীর্বাদ নিয়ে যেতেও কম লালায়িত ছিলেন না।
.
০৫.
বক্তব্য উদ্ধৃতি-বহুল হল। তার কারণ আমরা কবির রচনায় কবিকে দেখতে চেয়েছি। বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে চাইনি। বার্ধক্যে যখন আবেগ হয়েছে নিঃশেষিত, প্রজ্ঞা পেয়েছে বৃদ্ধি, মনন হয়েছে সূক্ষ্ম এবং পরিবেশ-চেতনা পেয়েছে প্রাধান্য-তখনকার রচনা এগুলো। তাই এতে বিজ্ঞানবুদ্ধি, দার্শনিকতত্ত্ব, ইতিহাসের শিক্ষা ও কল্যাণ-চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছে কবির মন ও মত। এখানে চিত্তের চাইতে চিন্তা, আবেগ ছাপিয়ে উদ্বেগ, মনের উপরে মস্তিষ্ক, ভাবের চেয়ে ভাবনা, প্রাণ থেকে প্রজ্ঞা প্রবল হয়েছে–দেখতে পাই। এজন্যে অভিভূতি অপেক্ষা আবেগের তারল্য, কবিত্বের চেয়ে কথকতার প্রাধান্য, ভাবের চাইতে ভঙ্গির জৌলুস এবং অনুভবের চেয়ে মননের ঔজ্জ্বল্যই প্রকাশ পেয়েছে বেশি। এখানে কবি অনেকাংশে বক্তা ও বেত্তা। মানুষ ও মানুষের সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও আদর্শই এখানে কবির মন ও মনন অধিকার করে রয়েছে। তাই এখানে সবিতা একাধারে বিজ্ঞানীর জগৎ-কারণ, অধ্যাত্মবাদীর দেবতা ও মানব-ইতিহাসের সাক্ষী। বার্ধক্যে রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত মনীষী আর গৌণত কবি। তাঁর রচনাও তাই কবিতাশ্রয়ী জার্নাল।
নজরুল ইসলাম : এক বিরূপ পাঠকের দৃষ্টিতে
আমার এক বন্ধু আড্ডার আসরে সেদিন নজরুল-কাব্য সম্বন্ধে তার যে-বক্তব্য পেশ করেছেন, এখানে আমি তার সার সংকলন, করে দিচ্ছি। দিচ্ছি এজন্যে যে এতে ভাববার ও ভাবনার বিষয় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে তর্কের অবকাশ।
তিনি বললেন, নজরুলকে কোনো মতেই বিদ্রোহী বলা চলে না। কেননা, সুব্যবস্থা ও ন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ যে করে সে-ই বিদ্রোহী। নজরুলের সমকালীন সমাজ ও সামাজিক বিশ্বাস সংস্কার যাদের পছন্দসই ছিল তাদের চোখেই নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, আর যারা নিশ্চিত ব্যবস্থায় নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছে, ভালো-মন্দের অনুভূতি নেই–তাদের কাছে তিনি বিপ্লবী। আর আমরা-যারা তাঁর মতাদর্শের সমর্থক আমাদের কাছে তিনি সংগ্রামী বা যিহাদী কবি–তিনি মুযাহিদ।
তাকে মানবতার কবিও বলাও ভুল। মানবতা বিশ্বমানবপ্রীতির দ্যোতক। মানুষ অবিশেষের প্রতি প্রীতি তাঁর ছিল না। মার কোনো সন্তান দুবৃত্ত হলে মা বেদনা বোধ করেন, কিন্তু তার মৃত্যু কামনা করেন না বা নির্মম শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন না। গৌতমবুদ্ধকে বলা যায় মানবতার পূজারী। নজরুল বঞ্চিত উৎপীড়িতের পক্ষ নিয়ে উৎপীড়কের বিরুদ্ধ সংগ্রাম ঘোষণা করেছেন, চেয়েছেন তাদের বুকের রক্ত পান করে প্রতিশোধ নিতে। কাজেই তাঁকে বড়জোর নির্যাতিত মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা যায়।
আবার তাও বলা যায় কি-না তলিয়ে দেখবার মতো। কেননা, নজরুলের ঠিক ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ব্রত ছিল না। তিনি নিজেও বঞ্চিতের একজন, দুঃখ- লাঞ্ছনায় তার জীবনও হয়েছিল দুঃসহ। কাজেই তার সংগ্রামের মূলে নির্জলা লাঞ্ছিত-বাৎসল্য ছিল না–আত্মরতিও ছিল। এজন্যেই তাঁর কাব্যে উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা বেশি, আদর্শবাদের আবেগের চাইতে চিত্ত-বিক্ষোভের পরিমাণ অধিক। রবীন্দ্রনাথ ধনীর দুলাল। তাই তাঁর এবার ফিরাও মোরে, দুরন্ত আশা দেশের উন্নতি অপমান প্রভৃতি কবিতায় তিরস্কার আছে, ভৎর্সনা আছে, সদিচ্ছাও রয়েছে, কিন্তু ক্ষুব্ধচিত্তের উত্তেজনা নেই! ফলে রবীন্দ্রনাথের আবেদন হয়তো হৃয়দবানদের ভাবিয়ে তুলেছে, কিন্তু নজরুলের কথার আগুনে-গোলা পাঠককে করেছে বিক্ষুব্ধ এবং সগ্রামী।
আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে আমরা নজরুলকে জাতীয় কবি বলে প্রচার করি। অন্যত্র যেমনই হোক, সুধীসভায় তাঁকে জাতীয় কবি বলে পরিচিত করাবার চেষ্টা অনুচিত কর্ম। কেননা জাতীয় কবির যে-সংজ্ঞা আমাদের জানা আছে, তাতে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় কবি হতে পারেন না। সগ্রামী আদর্শেও না, বোধেও না।
নজরুলই বাঙলাদেশে একমাত্র লেখক, যার অবচেতন মনেও হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। তাঁর কথায়, কাজে ও আচরণে তিনি যে উদার মন ও মতের পরিচয় দিয়েছেন তা একান্তই বিস্ময়কর। বিশুদ্ধ-বুদ্ধি প্রত্যেক মানুষেরই অনুকরণীয়। এদিক দিয়ে নজরুলের জুড়ি নেই। মানুষ নজরুল ও কবি নজরুলের চরিত্র ও কাব্যের কেবল এদিকটি স্মরণে রাখলেও যে-কোনো মানুষেরই আত্মিক উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ে। এ দুর্লভ উদারতার একটি কারণ হয়তো এই যে, সেদিনকার ভারতের স্বাধীনতা এবং শোষিত জনের মুক্তিই তার কাম্য ও সাধ্য ছিল, তাই তিনি কোনো তুচ্ছ আবেগকে প্রশ্রয় দেননি–আদর্শ ও লক্ষ্যে বিপর্য ঘটবে বলে।