মনুষ্যত্ব ও মানবমহিমা ঘোষণাই ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্রত। বৌদ্ধ ও হিন্দু ভারত থেকে তিনি এই মানবমহিমা প্রকাশের উপযোগী উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। তাই ত্যাগে বা ক্ষমায়, দুঃখে বা দ্রোহে, সেবা বা সহিষ্ণুতায়, চরিত্রে বা প্রত্যয়ে, প্রীতিতে বা প্রেমে, আত্মসম্মানে বা কর্তব্যনিষ্ঠায়, শ্রদ্ধায় বা অনুরাগে, আদর্শ চেতনায় বা সংকল্পে, আত্মিক বিশ্বাসে বা ন্যায়সত্যের প্রতিষ্ঠায় মানুষ যেখানে মহৎ সেই কাহিনী, ঘটনা বা চিত্ৰই তিনি তাঁর রচনার অবলম্বন করেছেন। অর্থাৎ আধুনিক য়ুরোপীয় জীবনচেতনা প্রাচীন ভারতীয় কাহিনীর মাধ্যমে আজকের বাঙালির উদ্দেশে পরিব্যক্ত। বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতির মতো মানুষ যেখানে ক্রোধ, ক্ষোভ, স্বার্থ ও হিংসাবশে বাহুবল সম্বল করে দ্বন্দ্ব সংঘাত-সংগ্রামে রত, তেমন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কাহিনী বা ঘটনা অবলম্বনে জাতীয় শৌর্যবীর্য ও গৌরব প্রকটনে তিনি উৎসাহ বোধ করেননি।
.
০৭.
রবীন্দ্রনাথের এই জীবনদৃষ্টি–এই আদর্শচেতনা য়ুরোপ থেকে পাওয়া এবং রেনেসাঁসের দান। আমরা–বাঙালিরা জানি, গীতাঞ্জলি রবীন্দ্রনাথের সর্বোৎকৃষ্ট কাব্য নয়–এমনকি জনপ্রিয় কাব্যও নয়। অথচ য়ুরোপে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা গীতাঞ্জলির কবিরূপেই। কেননা গীতাঞ্জলিতে অধ্যাত্মতত্ত্ব আছে, যা য়ুরোপে নতুন ও প্রয়োজন। বিশেষ করে বুর্জোয়াসমাজ যখন ধনে-মনে কাঙাল হয়ে উঠছে, আত্মধ্বংসী সাম্রাজ্যিক দ্বন্দ্বে যখন রাজ্যগুলো পরস্পরের উপর মরণবাণ ছোড়বার জন্যে তৈরি, বুদ্ধিজীবীরা ও হৃদয়বান মানুষেরা যখন স্বস্তি-শান্তির উপায় সন্ধানে অস্থির; য়ুরোপীয় বিবেকের সেই মৃত্যু-মুহূর্তে গীতাঞ্জলি অধ্যাত্মরস সিঞ্চন করে বিক্ষুব্ধ আত্মার জ্বালা নিবারণে ক্ষণিকের জন্যে সহায়ক হয়েছিল।
তাঁর অন্যান্য কাব্য-গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক য়ুরোপে তেমন সমাদৃত হয়নি। কেননা সেসবের মধ্যে যে বাণী আছে, তা য়ুরোপে দুর্লভ নয়–অজ্ঞাতও নয়, বরং য়ুরোপের মানস সম্পদের প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্র-রচনায় যেখানে অধ্যাত্মবুদ্ধি ও তত্ত্বরস আছে, য়ুরোপ তাকেই দুর্লভ সম্পদ জ্ঞানে বরণ করে আনন্দিত হয়েছে।
এ যুগে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখে প্রাচ্যের মহত্তম প্রতিভা, শ্রেষ্ঠ মনীষী, প্রতীচ্য আত্মার দূত, আধুনিকতার বাণীবাহক, মানবতা, মানবিকতা ও বিশ্বজনীনতার উদগাতা যুগন্ধর ও যুগস্রষ্টা। কিন্তু য়ুরোপের চক্ষে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি ও মনীষী মাত্র।
লালন শাহ্
লালন শাহ্
সাধক কবি লালন শাহর কথা বলতে হলে একটু ভূমিকা দরকার। মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন প্রশ্ন। রয়েছে, তারই মনোরম জবাব খোঁজার প্রয়াস আছে আমাদের তত্ত্ব–সাহিত্যে। বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সুফীমতের প্রত্যক্ষ সংযোগে বাউলমতের উদ্ভব হলেও, এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস-শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্যে উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যক হয়। মনে হয়, এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে, বৌদ্ধদর্শনে ও সুফীসাধনতত্ত্বে দেহকে বিশেষ মূল্য দেয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে চৈতন্য, সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শরীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে : দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধন-তত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অসামান্য। তাই এদেশে অধ্যাত্মসাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। যোগ-সাধন পাক-ভারতের আদিম অনার্যশাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলায় পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই মধ্যযুগে সুফীপ্রভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মতরূপে প্রসার লাভ করে। এভাবে চর্যাপদের পরিণতি ঘটে বাউল গানে ও সহজিয়া পদে।
মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথম দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তর ভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ–ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দু মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সুফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। উত্তর ভারতের সন্তধর্ম, দক্ষিণভারতের ভক্তিধর্ম আর বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউলমতবাদ সুফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন নির্যাতিত নিম্নশ্রেণীর মনে ইসলামের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী যে আবেগ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে উদার আকাশের তলে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনতর প্রয়াস মাত্র। জীবনের যে-চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা; উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। তখন মনে হয়, যদিও হিন্দু ধাবই দেহরা মুসলমান মসীত। কিন্তু সেখানে আল্লাহ নেই। তাদের মতে এই বিপথগামীদের আল্লাহ বলছেন–