.
০৪.
প্রতীচ্য প্রভাবিত জীবনচেতনা দুইভাবে প্রকটিত হয়েছে। একটা হচ্ছে প্রতীচ্য চিন্তা ও আদর্শকে সোজাসুজি স্বাঙ্গীকরণের প্রয়াস–এ প্রয়াস ছিল রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সৈয়দ আহমদ, রবীন্দ্রনাথ ও জওয়াহেরলাল নেহেরুর।
আর একটি ছিল গ্রহণ-বর্জনের মধ্যপন্থায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় প্রয়াস–এটি মূলত নির্মাণ ক্রিয়া নয়–মেরামতি কর্ম। এ আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, সৈয়দ আমীর আলী, জালালউদ্দিন আফগানী, ইকবাল, গোখেল, তিলক, গান্ধী প্রমুখ।
এ দ্বিতীয় দলের জাতীয় অভিমান অত্যন্ত প্রবল ছিল। তারা প্রকাশ্যে য়ুরোপীয় কিছু গ্রহণ করতে অপমান বা লজ্জাবোধ করতেন। তাই তাঁরা খিড়কিদোর দিয়েই য়ুরোপকে জানালেন সম্ভাষণ, বরণ করলেন নেপথ্যে কিন্তু সমাদরে। এঁদের মধ্যে আবার বঙ্কিম, ইকবাল ও গান্ধীর স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক চেতনা ছিল প্রায় উগ্র-গোঁড়ামিরই নামান্তর। এরা আধুনিক জীবনচেতনা এবং অগ্রগতির ইঙ্গিত ও পাঠ লাভ করলেন য়ুরোপ থেকে, কিন্তু ঠাটটা রাখতে চাইলেন পুরোপুরি দেশী–যাতে মনে হবে দেশের অবহেলিত পুরানো ঐতিহ্য ও আদর্শরূপ গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়ার ফলেই যেন দেহের জরা ঘুচে এল যৌবনের উত্তাপ, মনের জড়তা ঘুচে জাগল প্রাণের সাড়া, কুটিরের জীর্ণতা ছাপিয়ে এল প্রাসাদের জৌলুস।
.
০৫.
বঙ্কিম-সাহিত্যেও মিলবে আমাদের এ ধারণার সমর্থন। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব-অনুশীলনী-কৃষ্ণচরিত্র সাম্যবাদ রচনার পেছেনে যে জীবনচেতনা, আদর্শ ও প্রেরণা ক্রিয়া করেছে, তা তিনি দেশ থেকে পাননি। তাঁর লোকরহস্য বা কমলাকান্তের দপ্তরে যে দৃষ্টির পরিচয় মেলে, তা ইংরেজি-না-জানা লোকে লভ্য নয়। বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ নিরোধ আন্দোলনে বঙ্কিমচন্দ্র যোগ দেননি, কিন্তু য়ুরোপীয় monogamy তার মন হরণ করেছিল। নইলে, এই বহুপত্নীকতা ও উপপত্নীকতার দেশে বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষ, কপালকুণ্ডলা ও কৃষ্ণকান্তের উইল-এর মতো tragedy রচনা করতে পারতেন না। সমাজে যা সমস্যাই নয় বরং রীতি, তা-ই তাঁর উপন্যাসে জীবন-বিধ্বংসী প্রাণ বিনাশী সমস্যা হয়ে উঠল কী করে! ইংরেজ civilian ও তাঁদের পত্নীরাই ছিল বঙ্কিমের আদর্শ নারী-পুরুষ। তাই মাতৃঘটিত কলঙ্কের দায়ে যে বধূ পরিত্যক্তা হল, পরপুরুষের সঙ্গে যে দস্যুবৃত্তি বা রাজনীতি করে বেড়াল, সেই প্রফুল্ল আবার উনিশ শতকী হিন্দুর ঘরে সমাদরে বৃতা হল, প্রতিষ্ঠিতা হল সগৌরবে। এ উদারতা কি ভারতীয়? কাজেই বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুয়ানী অনেকটা ভেতরের কোট-প্যান্টালুনের উপর ধুতি-চাদর পরার মতো। ইকবালের ইসলামী জীবনও অনেকটা এরূপ। আর একটি লক্ষণীয় বিষয়–উনিশ বিশ শতকে প্রতীচী প্রভাবিত হিন্দুর জীবনচেতনা গীতার আদর্শ ও প্রভাবের প্রলেপে বিকাশ লাভ করেছে। রেনেসাঁসের মর্মবাণী, মানবমূল্য বা মানবমহিমা–তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেনি। বঙ্কিম-বিবেকানন্দ, অরবিন্দ-সুভাষচন্দ্র কিংবা গোখেল তিলক-গান্ধী সবাই গীতাপন্থী। কেবল রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, জওয়াহের লালে প্রত্যক্ষ করি ব্যতিক্রম। কেননা তারা য়ুরোপীয় রেনেসাসের আত্মার সন্ধান পেয়েছিলেন। সাগর যে দেখেছে, সরোবরে কি তার মন ওঠে!
.
০৬.
য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের চরম ফল মানবতাবোধ তথা মনুষ্যত্ব ও মানবমহিমার উপলব্ধি। একালে নিৰ্বর্ণ মানবতায় দীক্ষা খ্রীস্টান য়ুরোপ থেকেই আসে– আসলে আসে বুর্জোয়া য়ুরোপ থেকে। এই বুর্জোয়া সমাজ রেনেসাঁসের ঐতিহ্যে লালিত। য়ুরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের স্বর্ণযুগে রবীন্দ্রনাথের কৈশোর-যৌবন কেটেছে। তখন য়ুরোপীয় কবি, মনীষী, দার্শনিক বিজ্ঞানীদের ভাব, চিন্তা ও জ্ঞানের দীপ্তিতে রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট নন কেবল, একেবারে অভিভূত। য়ুরোপীয় আত্মার ঐশ্বর্যে তিনি মুগ্ধ! রবীন্দ্র প্রকৃতির অনুগ ছিল বলে বিশ্বমানবের অদ্বয় সত্তায় তার আস্থা দৃঢ়তর হয়। প্রকৃতি প্রীতি রবীন্দ্র- স্বভাবের অঙ্গ। সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা, আমাকে সত্যি সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে। (ছিন্ন পত্রাবলী পৃ. ২৫)।
বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক সত্তার বোধ তাঁর কৈশোরেই জাগে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্ভোগের মাধ্যমেই তাঁর চিত্তে বিশ্বাত্মার ধারণা দানা বাঁধে। এই ঐক্যবোধের বিকাশে প্রকৃতি ও জীবজগতে একক সত্তা এবং একাত্মার বোধ জন্মে। এ কাব্যিক-চেতনাই য়ুরোপীয় মনীষার প্রভাবে মানবাত্মার অভিন্নতায় ও মানবমহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে নির্বৰ্ণ বিশ্বমানবপ্রেমরূপে মহিমান্বিত হয়। য়ুরোপ থেকে পাওয়া এই ঔদার্যবোধ, এই বিশ্বাত্মবোধ এবং মানব নির্বিশেষের সহযোগ ও সহঅবস্থান নীতির সাদৃশ্য ও সমর্থন খুঁজে পেয়েছেন কবি উপনিষদে, বুদ্ধের বাণীতে, মধ্যযুগের সন্তদের সাধনায় ও বাউলের কণ্ঠনিঃসৃত গানে! এসব ভারতের নিজস্ব সাধনা ও মনীষার ফসল।
উপনিষদ থেকে বাউলের বাণী অবধি কোনোটাই ভারতে অজ্ঞাত ছিল না। শঙ্কারাচার্য উপনিষদকে জনপ্রিয় করেছিলেন, কিন্তু এগুলো আধ্যাত্মিক ছাড়া অন্য তাৎপর্যে কখনো গৃহীত হয়নি। এদেশে। বৌদ্ধধর্ম যেমন তার জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে; উপনিষদ যেমন স্মৃতি, পুরাণ ও গীতার চাপে পড়ে গুরুত্ব হারিয়েছে; সন্তক-পন্থীরা তেমনি সমাজচ্যুত হয়ে মঠে-মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। অতএব এগুলোকে নতুন তাৎপর্যে গ্রহণ করার প্রেরণা ও দীক্ষা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন য়ুরোপ থেকেই। তাঁর কাব্য-নাটকের প্রতিপাদ্য হয়েছে ঔপনিষদিক বিশ্বাত্মবাদ, বৌদ্ধ করুণা ও মৈত্রীতত্ত্ব, সন্ত-বাউলের প্রীতি ও অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা। এই বোধের আলোকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, নির্দেশ করেছেন সমাজ সংগঠনের উপায়, আদর্শ খুঁজেছেন রাজনীতির, ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের ধর্ম, দিশা পেয়েছেন জীবনচর্যার।