সংস্কৃত আলঙ্কারিকেরা কাব্যাস্বাদনকে ব্রহ্মাস্বাদ সহোদর বলেছেন। তেমন মহৎ কাব্যরস রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষায় আমাদের দিয়ে গেছেন। আমাদের এ সৌভাগ্যের তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণের ও কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। জয়তু রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্ৰমানসের স্বরূপ সন্ধানে
০১.
১৯৬১ সনে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের উপর পাশ্চাত্য প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে বিপন্ন। হয়েছিলেন। হয়তো তাঁর উক্তিতে সৌজন্যের অভাব ছিল, হয়তো ছিল রুক্ষতা। নইলে তিনি চক্রব্যুহে পড়বেন কেন! রবীন্দ্র-পাঠক-সমালোচক সবাই জানেন, রবীন্দ্রনাথের উপর য়ুরোপের প্রভাব প্রচুর। সমালোচকরা তা কখনো গোপন রাখেননি, ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বাঁকিয়ে বলেছেন মাত্র। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ প্রভাব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, তিনি কোথাও গোপন করবার চেষ্টা করেছেন বলে তো মনে হয় না। বুদ্ধদেব বসুর কথাগুলো বড় কাটা কাটা ছিল, তিনি রেখে- ঢেকে বলবার চেষ্টা করেননি। ঋজু-পষ্ট কথায় শক্ত বাড়ে। বুদ্ধদেব বসু তাই নিন্দা-গালি পেয়েছেন। মানস-সংকীর্ণতা যাদের রয়ে গেছে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে প্রাচীন ভারতের ও ঔপনিষদিক ঋষির আধুনিক রূপান্তর হিসেবে গ্রহণ করে আনন্দিত ও গৌরবান্বিত হতে চান। বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যে তাঁরাই হয়েছিলেন অসহিষ্ণু।
.
০২.
পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের ছোঁয়া প্রথম যে বাঙালির অন্তরে লেগেছিল তিনি রামমোহন রায়। এই রামমোহনের ভক্ত ছিলেন দ্বারকানাথ আর ভাব-শিষ্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। রামমোহনের মনীষা ও উদারতা এঁদের ছিল না বটে, কিন্তু রামমোহন পশ্চিমের যে-জানালা খুলে দিলেন, তা বন্ধ করবার সাধ্য ছিল না কারো। রবীন্দ্রনাথ আশৈশব পেয়েছিলেন পশ্চিমের এই বাতায়নিক হাওয়া। তাঁর বড়ভাইরা বাড়িটাকে পাশ্চাত্য শিল্প, সাহিত্য ও সংগীত চর্চার কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের উক্তিতে প্রকাশ: আমি এসেছি যখন … (বাড়িতে) নতুন কাল সবে এসে নামল। –এ নতুন কাল পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে। তাছাড়া য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের বিভায়, ফরাসি বিপ্লবের মহিমায় এবং তাঁর সমকালীন প্রতীচ্য বুর্জোয়া সমাজের কল্যাণবুদ্ধি ও আত্মার ঐশ্বর্য দর্শনে তিনি মুগ্ধ ছিলেন। এ মানস-সম্পদ আহরণে তাঁর প্রযত্নও কম ছিল না। ইংরেজকে তিনি জেনেছেন য়ুরোপের চিত্তদূতরূপে, মানুষের মূল্য, মানুষের শ্রদ্ধেয়তা হঠাৎ এত আশ্চর্য বড়ো হয়ে দেখা দিল কোন্ শিক্ষায়?… বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি সম্বন্ধেও ঠিক সেই একই কথা।… প্রতি দিন জয় করেছে সে জ্ঞানের জগৎকে, কেননা তার বুদ্ধির সাধনা বিশুদ্ধ, ব্যক্তিগত মোহ থেকে নির্মুক্ত। (কালান্তর)।
কোনো বা কারো ভাব-চিন্তা-আচরণ নিজের মতো করে গ্রহণ করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। স্বীকরণ বা স্বাঙ্গীকরণও সামর্থ্য-সাপেক্ষ কাজ। সে সবাই পারে না–সাধারণে পারে না। তার জন্যেও প্রতিভার প্রয়োজন। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলেই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রপ্রতিভার অসামান্যতা বোঝা যাবে।
.
০৩.
নতুনকে বরণ করার ব্যাকুলতা সত্ত্বেও ঈশ্বরগুপ্ত যে নতুনকে গ্রহণ করতে পারলেন না, সে তো শক্তির অভাবে নয়– শিক্ষার অভাবে। আসলে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালির চোখ ধাঁধিয়ে ছিল, মন রাঙাতে পারেনি; তাই অমন যে বিদ্বান ও প্রাণবান মধুসূদন, তিনিও পারলেন না কোলরিজ-ওয়ার্ডসওয়ার্থ-শেলী-কীটস্-টেনিসনের ভাবাকাশের ভাগী হতে। বিএ পাস হেম-নবীনও পেলেন না গীতিকবিতার প্রাণের সন্ধান। বিহারীলালের সম্ভাবনাও যে তাত্ত্বিকতার মরুবালিতে দিশা হারাল, সে তো ইংরেজি না-জানার জন্যেই। দেবেন্দ্রনাথ সেন কিংবা অক্ষয়কুমার বড়ালের গীতোচ্ছাসেও কৃত্রিম অনুকৃতি যতটা আছে, আত্মার সাড়া নেই ততটা। আর কত বলব!
রামমোহনের পরে পাই বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তকে, যারা য়ুরোপীয় ভাব-চিন্তা ও বিজ্ঞানকে বরণ করবার জন্যে ছিলেন উন্মুখ, কিন্তু তাঁরা সৃজনশীল নন। সৃজনশীল প্রতিভা নিয়ে যিনি য়ুরোপকে নিজের মতো করে এবং প্রয়োজন বুদ্ধি নিয়ে গ্রহণ করতে জেনেছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। তার কথা পরে হবে। তার আগে খাস ঠাকুর পরিবারেই দেখা যাক। দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে হিন্দুয়ানীর উপরে উঠতে পারলেন না, সেকি ঔপনিষদিক জ্ঞানের অভাবে! তা হলে মানতেই হবে, গাহিকাশক্তি ও গ্রহণের আগ্রহ থাকা চাই। মনের দুয়ার খুলে দিয়ে চিত্তলোকে আসন পেতে দেবার মতো সংস্কার-মুক্তি ও উদারতা না থাকলে কোনো নতুনকেই বরণ করা যায় না পাওয়া যায় না নতুনের প্রসাদ!
নতুনের তরঙ্গাভিঘাত গায়ে দাগ কাটতে পারে কিন্তু মনে রঙ লাগাতে পারে না। তার প্রমাণ দুশ বছর ধরে ঘরে-বাইরে দেখা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য-প্রভাবিত আধুনিক জীবনের কিছুই গ্রহণ করতে পারেনি টোল-মাদ্রাসার লোক। এসব যে তারা এড়িয়ে চলে, সে কি মন্দ বলে, না বিচারশক্তির অভাবে? সে-জগতে এখনো মধ্যযুগ– এখনো বিদিশার নিশা কেন, ইংরেজি ভাষাবাহী আলোর অভাবেই তো। য়ুরোপের চিত্তদূত ইংরেজ বা ইংরেজির সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে আমরা কি অন্তহীন মধ্যযুগ অতিক্রম করতে পারতাম, পাশ্চাত্য প্রভাব ব্যতীত আফ্রো-এশিয়ার কোথাও মধ্যযুগের অবসান ঘটেছে কি? এ সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই যে, পাঁচশ বছর আগে সূর্য উদিত হয়েছে পশ্চিমে–সেই যেদিন ইতালিতে রেনেসাঁসের শুরু। পাঁচশ বছর ধরে ভাব-চিন্তা-জ্ঞানের রশ্মি বিকীর্ণ হচ্ছে পশ্চিম থেকেই। সে-রশ্মি থেকে যে মুখ ফেরাবে সেই বেঁচে-বর্তে থাকার অধিকার থেকে নিজেকে করবে বঞ্চিত। বিজাতীয় বলে সঞ্জীবনী-রশ্মির আলোয় অবগাহনে লজ্জাবোধ করা নির্বোধের আহাম্মকি মাত্র। কেননা কল্যাণপ্রসূ ভাব-চিন্তা-জ্ঞান চন্দ্র-সূর্যের মতোই মানুষ অবিশেষের সাধারণ সম্পদ। আকাশে চন্দ্র-সূর্যের স্থিতি অনুসারে প্রভাবের তারতম্য ঘটে, কিন্তু প্রয়োজনের হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না।