রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা।
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা
এভাবেই নজরুল যুগ-জাত এবং যুগন্ধর কবি হয়ে উঠলেন। তিনি সমকালের মানুষের বুকের বেদনার অভিব্যক্তি দিলেন, তাদের রুদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল তার তীব্র লেখনী মাধ্যমে।
যদিও মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি তবু সে-রবির প্রভায় এ যুগ-আর্তি তেমন ধরা পড়ছিল না প্রাকৃতজনের চোখে। তার প্রশান্ত তীক্ষ্ণ কটাক্ষ, তাঁর তিতিক্ষা-মধুর তিরস্কার উপলব্ধি করবার যোগ্যতা ছিল না জনগণের। তাই তার মানবতার বাণী তাদের স্বস্তি দিতে পারে নি।
রবির কিরণ ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে আজ দেশান্তরে
সে কিরণ শুধু পশল না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।
নজরুল ইসলাম সাধারণের বুকের কথা তাদেরই মুখের আটপৌরে ভাষায় যখন বলা শুরু করলেন, তখন বিস্মিত বাঙালি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করল। প্রদীপ্ত সূর্য-শাসিত আকাশে তারার আবির্ভাব যেমন অদ্ভুত, রবীন্দ্র-সৃষ্ট সাহিত্যাকাশে ধ্রুব নক্ষত্রের দীপ্তি ও স্থিরতা নিয়ে নজরুলের উদয়ও তেমনি অভাবিত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হৃদয়ে তাঁকে বরণ করে নিলেন। তিনিও তাঁকে অভিনন্দিত করলেন ভবিষ্যতের নবী হিসেবে নয়, বর্তমানের কবি– রূপে এবং সম্বোধন করেছেন ধূমকেত বলে!
আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!
অতএব নজরুল যেমন ভবিষ্যতের নবী না হয়ে বর্তমানের কবি হবার উদ্দেশ্যে লেখনী ধরেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তাকে যুগের ধূমকেতু বলে, সমকালীন সমস্যার সংগ্রামী বলে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশ্বমানবতার ধারক, বাহক ও প্রচারক এবং মানুষ ও প্রকৃতি রাজ্যের সার্বিক অনুভূতির প্রমূর্তরূপ রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও যার স্বাতন্ত্র স্নান করতে পারেনি, তাকে সাময়িকতার অপবাদে তাচ্ছিল্য দেখানো সহজও নয়, সম্ভবও নয়।
নজরুলের কাব্যে দীপ্তি আছে, সামগ্রিক সৃষ্টি-সুষমা নেই এবং অনুশীলন-পরিশীলন-পরিচর্যার একান্ত অভাব। তাই তাঁর হাতে আকস্মিকভাবে গুটিকয় আশ্চর্য সুন্দর কবিতা সৃষ্টি সম্ভব হলেও তাঁর প্রতিভার ক্রমবিকাশের ও পরিণতির সাক্ষ্য নেই কোথাও। ক্ষোভের কারণ এখানেই। যেভাবে বলা হল তা সূক্ষ্মবুদ্ধির পরিচায়ক হলেও যেখণ্ডদৃষ্টির ফল, তা বোঝা যায় যখন দেখি অনেক চিরন্তনত্বকামী সুকবি–যাদের রচনায় কাব্য-কুশলতার অভাব নেই কিংবা অযত্নের এতটুকু ছাপ নেই কোথাও–পাঠকের সমাদর পাননি। নজরুলের জনপ্রিয়তাই নজরুলের যোগ্যতার ও তাঁর কাব্যের সার্থকতার প্রমাণ। যদি তাঁর কাব্যে কিছু অসাময়িক না-ই থাকবে, তা হলে নজরুল আজো এত জনপ্রিয় কেন? সে কী কেবল তার তুলে-ধরা সমস্যার সমাধান হয়নি বলে, কিংবা তার শুরু-করা সংগ্রামের ইতি ঘটেনি বলে? তা-ই যদি হত, তাহলে এতসব গণসাহিত্য আবর্জনার মতো অপসৃত হচ্ছে কেন?
নজরুল যুগের চারণ-কবি, যুগের মুযাহিদ এবং চিরকালের আতমানবতার প্রমূর্ত কান্না এবং বিদ্রোহ দু-ই। তাই তাঁর কাব্যে মহাভাবের মহৎ কথা নেই, ব্যবহারিক জীবনের অনুভূত সত্যের বেদনাময়-আগুনে অভিব্যক্তি আছে, এই জ্বালাময়ী বেদনার অগ্নিক্ষরা বাণীর পেছনে একটি সুস্থ সমাজ-দর্শন কিংবা রাষ্ট্রাদর্শ আশা করেছিল পাঠক মন। তা তারা পায়নি, ক্ষোভের মূল এখানেই। এই অবচেতন অভিযোগই তারা অক্ষম-ভাষায় প্রকাশ করছে সাময়িকতার অপবাদ দিয়ে এবং আঙ্গিক সৌন্দর্যের অভাব দেখিয়ে।
যে-নজরুলের দৃষ্টিতে এমন মর্মভেদী তীক্ষ্ণতা আছে, তাঁর জীবনজিজ্ঞাসায় যদি তেমনি গভীরতাও থাকত!–পাঠক- মনে এ সক্ষোভ প্রশ্ন জাগে। অর্থাৎ তারা একটা দর্শন চায়। কিন্তু কবির কাছে দর্শন পাই তো ভালো, না পেলেও দুঃখ কী? আমার মনের কথা, ভাবনার ভাষা পেয়েছি, এই কী যথেষ্ট নয়! আর কার্য-কারণ বিশ্লেষণ না-ই বা থাকল, সিদ্ধান্ত সমাধান না-ই বা পেলাম! আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, নজরুল ইসলামে বোলশেভিকবাদ কিংবা অন্য কোনো ইজমের আনুগত্য ছিল না। তার ব্যক্ত মানবতাবোধ মানুষের সুপ্ত মানবিকতারই বিমূর্ত প্রকাশ তাই এর গতি দুর্বার, এর আবেদন ঋজু এবং আকস্মিক। আঘাত ও অনুভূতিজাত বলেই এ উচ্ছ্বাস ঝড়ের মতো কুঁসিয়ে চলে এবং এ উত্তেজনা বন্যার মতো ভাসিয়ে দেয় আর সাগরের মতো কল্লোল তোলে।
নজরুল ইসলাম আসলে রবীন্দ্রনাথেরই পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথে যে রেনেসাঁস প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে নতুনকে সুন্দরকে গড়ার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথেরই। ঘুণেধরা পুরোনোকে ভাঙার দায়িত্ব পড়ল নজরুলের উপর। রবীন্দ্রনাথের মনীষা (brain), আর নজরুলের হাত (action)। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতি ও প্রজ্ঞা তাঁকে কঠোর-নির্মম হতে দেয়নি, শিক্ষা-বিজ্ঞানীর মতো তার চেষ্টা ছিল পরোক্ষ। নজরুল পাঠশালার পণ্ডিত। তিনি লাঠৌষধির প্রত্যক্ষ ফল লাভে উৎসুক। দুজনের লক্ষ্য ছিল এক এবং অভিন্ন–প্রেম পাওয়া ও দেওয়া, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে অসুন্দরকে অপসারিত করে কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। অপ্রেম-অসুন্দরই নজরুলকে করেছে সংগ্রামী। বোধিপুষ্ট রবীন্দ্রনাথের ছিল সইবার ও অপেক্ষা করবার ধৈর্য। কিন্তু তারুণ্য নজরুলকে করেছিল অসহিষ্ণু ও বিদ্রোহী। আর জীর্ণ আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে নতুন ইমারত গড়ে তোলা যে দুঃসাধ্য এ বাস্তববোধ রবীন্দ্রনাথের ছিল। যা তিনি পারছিলেন না বলে অস্বস্তিবোধ করছিলেন, তা-ই করবার ব্রত নিয়ে একজনের সদম্ভ আবির্ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ উল্লাস ও অভিনন্দন না জানিয়ে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আর নজরুলের কর্মে বাঙালির রেনেসাঁস পূর্ণতা পেল।