বাঙলা সাহিত্যের তিন ক্ষেত্রে যে- তিনজন শক্তিমান পুরুষ আত্মবিস্মৃত দিশেহারা জাতিকে পথের দিশা দিয়েছিলেন, তারা হচ্ছেন–মীর মশাররফ হোসেন, মহাকবি কায়কোবাদ ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। অবশ্য এঁদের সহযোগী ছিলেন আরো কয়েকজন। কিন্তু এঁরাই ছিলেন পুরোভাগে। মীর মশাররফ হোসেন গদ্য-সাহিত্যে, কায়কোবাদ কাব্যে এবং আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মধ্যযুগের বাঙলা-সাহিত্যে মুসলিম অবদান ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জনসাধারণের পরিচয় ঘটিয়ে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম প্রভাব ও অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এভাবে নতুন করে মুসলমানেরা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারক, বাহক ও সাধক হয়ে ওঠেন। সাহিত্য জাতির প্রাণ। এইজন্যে বাঙালি মুসলমান তাঁদের মরা দেহে প্রাণসঞ্চারকারী বলে এই তিন মহাসাধকের কাছে চিরদিন ঋণী থাকবেন।
সুতরাং কবি কায়কোবাদ আধুনিক বাঙলা-সাহিত্যের মুসলিম ধারার অন্যতম প্রবর্তক, বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় জাগরণ ও জাতীয়তাবোধের উদ্বোধক এবং আধুনিক মহাকাব্য রচনায় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান।
এককথায়, আমরা তাঁর কাছে আধুনিক সাহিত্যে হাতে-খড়ি, জাতীয়তাবোধের এসম ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রেরণা লাভ করি–এ-ই তাঁর গৌরব, এখানেই তাঁর সাধনার সার্থকতা, এ কারণেই তিনি আমাদের স্মরণীয় ও বরণীয়। আজকের দৃষ্টিতে সাধারণভাবে বলতে গেলে উনিশ শতকী মুসলিম সাহিত্যিকদের সৃষ্টি প্রশংসনীয় নয়। কিন্তু তাদের প্রয়াস শ্রদ্ধেয়। তারা গন্তব্যে পৌঁছেননি বটে, কিন্তু পথের দিশা পেয়েছিলেন। তাঁদের অসাফল্যের জন্যে তাঁরা নন–তাঁদের অসম্পূর্ণ প্রতীচ্য-শিক্ষাই দায়ী। তারা পথিকৃৎ, তাঁরা দিশারী–এজন্যে তাঁরা আমাদের আদর্শ নন–অবলম্বন। তাঁরাই বটতলার মজলিশের মোহ কাটিয়ে লালদীঘির প্রভাব স্বীকার করে মুসলিম সমাজে বাসন্তী হাওয়া ছড়ালেন। তাঁদের কৃতিত্ব এখানেই। আমাদের কৃতজ্ঞতাও এজন্যেই।
যুগন্ধর কবি নজরুল
সৃজনীশক্তি আর সৃষ্টিশীলতা মানুষের ব্যক্তিগত গুণ। কিন্তু সে-সৃষ্টির অবলম্বন দেশ-কাল নিরপেক্ষ নয়, পরিবেশকে আধার আর প্রতিভার অভিব্যক্তিকে আধেয় হিসাবে কল্পনা করলে, যে-কোনো প্রতিভার কিংবা সৃষ্টির স্বরূপ উপলব্ধি করা সহজ হয়।
স্থান-কালের প্রভাবেই মানুষের দেহ-মন নিয়ন্ত্রিত হয়। কাজেই মানুষের যে-কোনো আচরণে বা অভিব্যক্তিতে স্থানিক ও কালিক ছাপ না-থেকেই পারে না।
প্রতিভা মাত্রেই একাধারে যুগন্ধর ও যুগোত্তর, এতে সমকালীন মন-মেজাজের চাপ যেমন থাকে, তেমনি থাকে ভাবীকালের মন-মানসের আভাস– যা প্রাকৃতজনকে দেয় ভবিষ্যতের দিশা।
নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে বক্তব্য পেশ করার আগে এ ভূমিকাটুকু করতে হল এ জন্যে যে, আজকাল কথা উঠেছে নজরুল-কাব্য সাময়িকতা দোষে দুষ্ট, কাজেই তা কালোত্তীর্ণ হতে পারবে না। ফলে তাঁর কবিতা হবে না অমৃত আর তিনি রইবেন না অমর। এ অভিযোগ তাঁর বন্ধু ও হিতৈষীরা গোড়া থেকেই করে আসছিলেন, নজরুল জবাবও দিয়েছিলেন :
বর্তমানের কবি আমি ভাই
ভবিষ্যতের নই নবী
কবি অকবি যা বল ভাই।
নীরবে আমি সই সবি,
বন্ধুগো আর বলিতে পারি না
বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি
তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি নাতো একা
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা
বড় কথা বড় ভাব আসেনাকো মাথায়, বন্ধু বড় দুখে
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে।
প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায়
তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।
তবু হিতৈষীদের ক্ষোভ কমেনি, তাই আজো ভক্ত পাঠক-মনে বেদনা জাগে।
বালক-কিশোর কবি কবিতা লেখে, সে-লেখা যত না নিরুর্দিষ্ট পাঠকের জন্যে, তার চেয়ে অনেক বেশি অবচেতন মনের অনুভূতি প্রকাশের প্রেরণায়– বেদনা-মুক্তির কারণে। কিন্তু বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে তার দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়, সে হয় প্রতিবেশ সচেতন। তখন প্রকাশের প্রেরণাই প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট বিবেচিত হয় না। তখন স্রষ্টার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে– কী লিখব, কেন লিখব, কার জন্যে লিখব এবং কেমন করে লিখব? এতেই মিলে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিশা। তখন বক্তব্য প্রাণ, পায়, অর্থপূর্ণ হয় এবং পাঠকহৃদয়ে জাগায় সমানুভূতি। মানুষের স্বভাবে রয়েছে বৈচিত্র্য, মতে আছে বিভিন্নতা এবং মননে আছে লঘু-গুরু ভেদ। এতেই ঘটে একই বস্তু সম্বন্ধে জনে জনে দৃষ্টির পার্থক্য ও মতের বিভিন্নতা।
প্রকাশের প্রেরণাবোধ করতেন, তাই নজরুল ছেলেবেলায় লিখতেন। তখন চেষ্টা ছিল কেবল সুন্দর করে বলার দিকেই, যাতে করে শ্রোতারা বলে বেশ হয়েছে, চমৎকার লাগল। তখন বক্তব্য নয়, বলার ভঙ্গি-সুষমাই লক্ষ্য।
কৈশোরুত্তীর্ণ কবির অভিজ্ঞতা অনেক দূর থেকে হলেও জগৎ-জীবনের নগ্নরূপ বড় বীভৎস আকারে তাঁর চোখে ধরা পড়েছে। সমাজে, ধর্মে ও রাষ্ট্রে মানবতার লাঞ্ছনা তাঁকে ব্যথিত-ব্যাকুল করে তুলেছে। একদিকে পুঁজিপতি বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের নর-রক্তমুণ্ড নিয়ে দানবীয় উল্লাস, অপরদিকে চির-নির্যাতিত আর্তমানবতার মরিয়া ভাবের বিপ্লব। মধ্য-য়ুরোপের যুদ্ধক্ষেত্র আর রাশিয়ার বিপ্লব ময়দান–এ দুটোর সার্বিক বৈপরীত্য কবির বক্তব্যের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করল অপরিমেয়! প্রত্যয়দৃঢ় কবি লেখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম শুরু করলেন–