মধুসূদনের এই চরিত্র, এই আকাঙ্ক্ষা ও হতবাঞ্ছই তার সৃষ্ট-সাহিত্যে প্রতিবিম্বিত। যে-পার্থিব জীবনপ্রীতি মধুসূদন-চিত্তে চাঞ্চল্য, আবেগ ও জ্বালা সৃষ্টি করেছিল, সেই চাঞ্চল্য ও আবেগ, ভাগেচ্ছা ও হতবাঞ্ছার যন্ত্রণাই মধুসূদনের কাব্য-নাটকে অভিব্যক্তি পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর প্রত্যেকটিই জীবনবাদী, ভোগপ্রিয়, আবেগপ্রবণ ও হতবার বেদনায় কাতর ও দিশাহারা। সেখানে রূপানুরাগী সুন্দ-উপসুন্দ নারীর রূপবহ্নিতে আত্মাহুতি দেয়, ভীমসিংহ কন্যার জীবনের বিনিময়ে রাজ্যভোগ করতে চায় এবং পুত্রের বিক্রমগবী রাবণ হতমান হয়ে হাহাকার করে, পুত্র-গর্বিত চিত্রাঙ্গদা পাগল হয়, পতি-গর্বিতা সীতা রোদন করে, স্বামী-সোহাগিনী প্রমীলা সহমরণেও গর্ববোধ করে, বলবীর্যগর্বী ইন্দ্রজিতের জীবনও ক্ষোভে-অপমানে অবসিত হয়। সেখানে কৈকেয়ী-জনা-দ্রৌপদী হতবাঞ্ছার ক্ষোভে-জ্বালায় আগুন ছড়াতে চায়, অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তারা-সুর্পণখা হৃদয়ের আবেগে বিচলিত ও তার জন্যে লাঞ্ছিত। তার গোপবালা অতৃপ্ত বাসনার বেদনায় ব্যাকুল। শর্মিষ্ঠা-পদ্মাবতীও প্রমূর্ত আবেগ। তাঁর Captive lady-ও বন্দী আত্মার কান্না। তার সনেটগুলোতেও একটি বেদনাবোধ–একটি দীর্ঘশ্বাস যেন প্রচ্ছন্ন।
বেদনাহত নির্যাতিত মানবাত্মার যন্ত্রণা ও কান্নাই মহৎ সাহিত্যের অবলম্বন। মধুসূদনের কবি মনে এ সত্যটি সহজেই ধরা দিয়েছিল। কোথাও তাই তাঁর কবিদৃষ্টি বিভ্রান্ত হয়নি। নিয়তি-নিয়ন্ত্রিত জীবনে ক্ষোভ, হতবাঞ্ছার কান্না, নির্যাতিতের যন্ত্রণা, নির্দোষের লাঞ্ছনা প্রভৃতিকেই মধুসূদন তাঁর রচনার অবলম্বন করেছিলেন। অতএব, মহৎ শিল্পের কোনো উপকরণেই তাঁর অবহেলা ছিল না। বলেছি, মধুসূদনের নিজের জীবনও ছিল একটি প্রমূর্ত কান্না একটি প্রচণ্ড হাহাকার–তাঁর আত্মবিলাপে তাঁর অন্তরাত্মারই আর্তনাদ শুনতে পাই,আত্মবিলাপ কবিতাটিই তাঁর আত্মজীবনী।
তাঁর জীবনবোধ ও জগৎ-চেতনায় ছিল গ্রীক নিয়তিবাদের ও পুরুষকারের দ্বান্দ্বিক প্রভাব। তাই গ্রীক-ট্র্যাজেডির ভাব-সত্য যেমন তিনি গ্রহণ করেছেন, তেমনি Paradise Lost-এর শয়তানের স্বাতন্ত্রবুদ্ধি ও মর্যাদাবোধজাত দ্রোহকেও অভিনন্দিত করেছেন, অনুগতের শান্ত-নিশ্চিন্ত জীবনের চেয়ে দ্রোহী জীবনের মহিমময় পরাজয় এবং মহৎ-মৃত্যু তাঁর কাম্য ছিল।
আমাদের সৃজনশীল সাহিত্যিকদের মধ্যে মধুসূদনই প্রতীচ্যের প্রথম চিত্তদূত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের য়ুরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর অনুধ্যানের বিষয়। তিনি ছিলেন grand and Sublime-এর অনুরাগী। grandeur ও grandoise উনিশ শতকী য়ুরোপে ছিল বিরল, তাই তাঁর মানস-পরিক্রমের ক্ষেত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগেই রইল সীমিত। আধুনিক য়ুরোপ কিংবা ভারত তাঁকে আকৃষ্ট করেনি।
তবু য়ুরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাব তার মধ্যেও দেখি—-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতিপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি, পুরুষকারে আস্থা; ঐহিক জীবনবাদ, বিদ্রোহানুরাগ, ব্যক্তিসত্তায় ও মানবপ্রীতিতে গুরুত্ব এবং হৃদয়াবেগে মর্যা দান প্রভৃতি তাঁরও রচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। ফলে আঙ্গিকে তিনি ক্লাসিক হলেও প্রেরণায় পুরোপুরি রোমান্টিক। আমরা জানি, মধুসূদন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে অমর হবার বাসনায়। বাজি রেখে বাঙলা রচনায় হাত দিলেন, এজন্যে তার প্রস্তুতি ছিল না। সে বাজিতে তিনি জিতেছিলেন। বাঙালিকেও জিইয়ে ছিলেন নিস্পন্দ ধড়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, মননে ও মেজাজে মধুসূদনই প্রথম সার্থক বিদ্রোহী ও বিপ্লবী, পথিকৃৎ ও যুগস্রষ্টা। ভাবে ও ভাষায়, ভঙ্গিতে ও ছন্দে এবং রূপে ও রসে অপরূপ করে তিনি নতুন জীবন ও জগতের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাঙালির সঙ্গে। এ দক্ষতা সেদিন আর কারো মধ্যে দেখা যায়নি, যদিও ইংরেজি শিক্ষিত গুণী-জ্ঞানীর সংখ্যা নেহাত নগণ্য ছিল না সেদিনকার কলকাতায়।
মধুসূদনের জন্মের আগে থেকেই য়ুরোপে এবং তাঁর সমকালে এদেশেও শিক্ষিত সমাজে বিজ্ঞানবুদ্ধির প্রভাবে জীবনবোধ ও জগৎচেতনা দ্রুত রূপান্তর লাভ করছিল। এজন্যে মধুসূদনের প্রভাব বাঙলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিশেষ করে তার সমকালীন য়ুরেপীয় জীবনচেতনার স্বরূপ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। এ-যুগের মর্মবাণী গীতিকবিতায় অভিব্যক্তি পেয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি যুগের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারেননি–তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষ।
তবু আমাদের দেশে তিনি নতুনের বাণীবাহক, নতুনের ধ্বজাধারী যুগস্রষ্টা চিন্তানায়ক। আমরা তাঁকে ভুলিনি, ভুলতে পারবও না। জয়তু মধুসূদন!
মহাকবি কায়কোবাদ
আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম ধারার অন্যতম উদ্গাতা মহাকবি কায়কোবাদের এন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আশ্রয় নিল।
কায়কোবাদ যে- যুগে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, সে-যুগে মধুসূদন, সুরেন্দ্রনাথ, হেমচন্দ্র, বিহারীলাল, নবীন সেন প্রমুখ ছিলেন প্রতিষ্ঠাবান কবি। তাঁদের প্রবর্তিত রাজপথে ও তাঁদের আদর্শের অনুসরণে কায়কোবাদের সৃষ্টি রূপ লাভ করে। অতএব কায়কোবাদের সমসাময়িক কবি রবীন্দ্রনাথ বাঙলা সাহিত্যে যে-নতুন কাব্যাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করলেন, গীতিকবিতার যে-উচ্ছল বন্যা বাঙলা দেশ ও বাঙালির মন প্লাবিত করেছিল, তার সঙ্গে কায়কোবাদের যোগ ছিল না। তিনি এ ধারাকে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি উনিশ শ তেত্রিশ সালেও কাহিনীকাব্য রচনা করেছেন। অতএব তাঁকে আমরা আধুনিক যুগে পেলেও তিনি ছিলেন বিগতযুগের শেষ প্রদীপ–সে প্রদীপ বিচিত্র অলঙ্কারে ও রূপসম্ভারে ঝড়ের ন্যায় মনোহারী আর ঔজ্জ্বল্যে সমৃদ্ধ।