নসরের কাছে জীবন ও স্রষ্টার অভেদতত্ত্ব এরূপ:
আমি দুগ্ধ তুমি মাখন, আমি পাথর তুমি আগুন
আমি ফুল তুমি ঘ্রাণ — রাখছি জাত সিফাতে
চাঁদের চাঁদনী যেমন, সূর্যের মধ্যে ধূপের কিরণ।
আবের মধ্যে বিজলি গোপন, এইরূপে রয় জাত সিফাতে
জাতে সিফাত সিফাতে জাত, আমি তুমি নয়কো তফাত
তুমি আছ নসরের সাথ, খেতে শুতে পথে যেতে।
এখানে সুমধুর কবিত্বে তত্ত্বকথা কাব্যকথার রূপ নিয়েছে।
রসিক কবির প্রতিবেশ-চেতনা ও তীক্ষ্ণদৃষ্টির পরিচয় মেলে বাঙালি মুসলমানের জীবনচত্র অঙ্কনের প্রয়াসে:
বাঙলা দেশের জঙলা মুসলমান
কই মানে হাদিস-কোরান।
সুদ-ঘুষ-জেনায় মত্ত, বেপর্দা নারী যত
তাদের হাতে সবাই খান।
দারি ছাঁটে এ্যালবার্ট-কাটে
শার্ট কোর্ট ঘড়ি পকেটে
কেউ দেয় লেংটি এঁটে
চশমা চোখে হাতে ঘড়ি
তামাক খান না — পান বিড়ি
তহ্বন-টুপির নাইকো মান।
পানিই জগৎ-কারণ — এ-কথা বলতে গিয়ে পানি-মাহাত্ম্য বর্ণন প্রসঙ্গে ফলমূলের একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন কবি:
পানিতে হল এ সংসার
এই যে পানি দেহ খানি, সৃষ্টি করলে সাঁই আমার
নীরাকারে ডিম্বরূপে ভেসেছিলেন সাঁই
পানি হতে আসমান-জমিন চৌদ্দ ভুবন হয়।
পানির আড়া পানির বেড়া পানি ছাড়া কে এবার।
রাই সরিষা, মটর, মশুরী, তিল গোঁজা ছোলা
ক্ষীরা-কুমড়া-তরমুজ-শশা আর কলা
পেয়ারা-পেঁপে-পোস্তদানা, পানির ‘পরে জন্ম তার
মহুরী-শুপারী, এলাজ-কস্তুরী, বরবটি ধোঁধল
লিচু পিচু গোলাপ জাম, হচ্ছে রাম পটল,
হেট্ কাবাজারী রাই-খেশারী ডুমুর ডালিম হয় এবার।
আম জাম হয় কাঁঠাল এই বাঙলাদেশে
করমচা কামরাঙা ভালো, খেলে জ্বর আসে
আইফল-নাশপাতি ভালো বাংলা দেশে পাওয়া ভার
আছে আঙুর কিনে খেজুর পয়সা জোটে না
লঙ্কা খেলে পেট জ্বলে খাও বরফদানা
নসের বলে পানি নইলে চল্বে না আর এ সংসার।
প্রার্থনাসূচক গানগুলোতে নসরের ভক্তহৃদয়ের আবদার, অভিমান, গোহারী ও মিনতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন:
১. (তুমি) ভক্ত হতে প্রকাশিত, ভক্ত না থাকিলে কে ডাকিত
তুমি মনিব আমি যে দাস, আমা হতে তোমার নাম প্রকাশ
২. রহমান নাম কেন তোমার
পাপীকে যদি না কর উদ্ধার।
পরিশেষে আমারও কবির সাথে প্রার্থণায় যোগ দিয়ে প্রাণের কথা নিবেদন করি:
তুমি দয়া কর দয়াময়
দীনহীনে ডাকে যে তোমায়
তোমার আশায় চিরদিন এ যৌবন বয়ে যায়
দিনে দিনে ফুরাল দিন, আমার ভাবতে ভাবতে
তনু যে ক্ষীণ
আমায় কী ভাবেতে ভেবছ ভিন আমি কী তোর কেহ নয়
কত সহে জীবনে, আমি পুড়ে মলাম আশকৎআগুনে
দেবা পার কত দিনে — দীনহীন নসরে কয়।
পরিণামে সব মানবাত্মারই এক আবেদন, একই মিনতি! অপরিমেয় রূপপ্রতীকের প্রয়োগ বাউল গানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মধুসূদনের অন্তর্লোক
মধুসূদন আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে এক আশ্চর্য জ্যোতিষ্ক। উনিশ শতকের দ্বিতীয় পদে তাঁর জন্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব সে শতকের তৃতীয় পদে। ভৌগোলিক হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানেরই সন্তান।
ধনী ও মানী রাজনারায়ণ মুন্সীর একমাত্র সন্তান মধুসূদন আজন্ম সর্বপ্রকার প্রশ্রয়ে লালিত। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দম্ভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ছোটকে তুচ্ছ করা আর বড়র বন্দনা করা ছিল তাঁর স্বভাবজ। জীবনে ও মননে ছিল তাঁর বিলাসপ্রবণতা ও আভিজাত্য। ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রতাকে তিনি আবাল্য এড়িয়ে চলতেন। এটি তাঁর জীবনে আদর্শ ও লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। ধন, যশ ও মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁর জীবনের শুরু। আর এ তিনটের সাধনায় ও সন্ধানে তার জীবন অবসিত! ধনী, মানী ও জীবনবিলাসী বুর্জোয়া ইংরেজ ছিল তাঁর আদর্শ। ইংল্যান্ড ছিল তাঁর স্বপ্নের জগৎ–আকাক্ষার স্বর্গলোক। তাই ধনী, মানী ও যশস্বী হবার বাসনায় কৈশোরেই বরণ করলেন খ্রীস্টধর্ম, শিখলেন ইংরেজি, হতে চাইলেন ইংরেজ কবি। ফলে যা কিছু দেশী তা পেল তার তাচ্ছিল্য এবং যে-কিছু য়ুরোপীয় তা হল তাঁর বন্দ্য। বিয়ে করলেন য়ুরোপীয় মহিলা, পোশাক পরলেন য়ুরোপীয়, বাসা নিলেন সাহেব পাড়ায়, মদ খেলেন তাও সাহেবের মতো। কিন্তু কোনোটাই তার উচ্ছলতা জাত নয়, জীবন রচনার ও সাধনায় সিদ্ধির অবলম্বন মাত্র। এজন্যেই মধুসূদনের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা নেই, রয়েছে গাঢ় মমতা ও সহানুভূতি।
আজীবন মধুসূদন ছিলেন এক স্বাস্থ্যবান প্রাণধর্মী দুরন্ত শিশু। শিশুর মতোই তিনি প্রাণধর্মের প্রেরণায় চালিত হয়েছেন, হৃদয়াবেগই তাঁর সম্বল। সে-আবেগ তাঁকে সংকল্পে দৃঢ়তা এবং লক্ষ্যে অটলতা দিয়েছিল, তাই প্রয়াসবিহীন প্রাপ্তিতে তার আস্থা ছিল না। ধন উপার্জনের জন্যে সে-যুগের সর্বোচ্চ যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন–ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, কবি হয়ে যশ লাভ করবার জন্যে সে-যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। মধুসূদনের মতো বহুভাষাজ্ঞ সাহিত্যপাঠক এদেশে আজো দুর্লভ। আর কলকাতার সম্ভ্রান্ত উকিল ধনী রাজনারায়ণের যোগ্য ছেলে বিদ্বান ও ব্যারিস্টার এম. এম. ডাট-এর সম্মানে ছিল সহজ-অধিকার।
কিন্তু জীবৎকালে ধন, যশ ও মান কোনোটাই মধুসূদনের ভাগ্যে জোটেনি। এত বড় বিড়ম্বনা মানুষের জীবনে বেশি দেখা যায় না। ধন তিনি উপার্জন করেছিলেন কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না; যশ তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু তা আশানুরূপ ছিল না; আর তাঁর প্রাপ্য সম্মানও তিনি পাননি। রোজগার করতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ, তার হাজারে হাজারেও হয়নি। হতে চেয়েছিলেন ভুবন-বন্দ্য ইরেজি কবি, হলেন স্বল্পপ্রশংসিত বাঙলা-কবি। আশা করেছিলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতাপ, কিন্তু রইলেন সমাজচ্যুত হয়ে। জীবকালে বাঁচার মতো বাঁচতে পারেননি, মরে হলেন অমর।