কবির এমন উপলব্দি বেশিক্ষণ টেকে না। আকাশচারী দুরন্ত মন আবার মাটিতে নেমে আসে, জৈব-সমস্যার কথা ভাবে, তখন গোহারী জানায়:
দেখে তোমার কাজগুলা
যায় না কো সাঁই দয়াল বলা
তোমার দয়াল নামের এমনি গুণ,
পান্তা ভাতে মেলে না নুন;
কেউ খায় ঘৃত মাখন কার কান্ধে দেও ঝোলা,
কার নাহি জোটে খেটেখুটে,
পড়ে থাকে ছেঁড়া চটে,
দিবারাতি নানান কষ্টে, শোক-অনলে হয় কয়লা।
কেউ সুখ-সাগরে ডুব দিয়া রয়,
কারো কেঁদে কেঁদে জনম যায়,
ফুলবাস উদ্দীন ভাবে সদাই–কার নামে ‘জপি মালা!’
কোনো যুক্তি দিয়ে নয়, ভালোবাসা দিয়েই আল্লাহ্কে লাভ করতে হবে। নিজের চিত্তের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করাই মানুষের ব্রত; কেননা আল্লাহ ‘যখন গড়েছিল আদম, এক চিজ রেখেছে কম — এই ভালোবাসার কাম।
আর, 'জপতপ, ভজন সাধন, সে ধন বিনে (ভালোবাসা) সব অকারণ আবার যদিও শুনি আলিফে লাম লুকায় যেমন, এই মানুষে সাঁই আছে তেমন, জাতে আর সিফাতে খোদা, মিশে সদায় এবং 'কুলুবেন মোমিন আরশ আল্লাতালা' কোরানেতে আছে খোলা, যেদিকে ফিরাই আঁখি, সেইদিকে তোমারে দেখি যেখানে ফুল সেখানে বাস, থাকে মিশামিশি, তবে কেন দেও না দেখা বল, করি কী উপায়। ...সাঁই-এর আজব লীলা আমার বুঝার সাধ্য নাই। আহাদে আমহদ হল মোহাম্মদে লুকাইল আদমরূপে প্রকাশ হল, তিনে হল এক বরণ।
কবি তাঁর মনের মধ্যে এর উত্তর খুঁজে পান:
সাঁই আমার আসমান জমিন, পবন-পানি কভু ছাড়া নয়।…
…..মোকামে আছে রব সাঁই আমি দেখিতে শুনিতে পাই,
সে যে ‘বাক্’-রূপেতে খেলছে সদায়
যে দেখেছে তাঁর প্রাণ জুড়ায়,
ছয় মোকামে ছয় লতিফাতে,
চার ঘণ্টা করিয়া তাতে
বিরাজ করেন সেই যে রব সাঁই
বেখুদী হবে যে জন সেই তো পাবে দরশন।
বাউল সাধনায় পরম গুরু হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্। যেমন:
আমি ডাকি তোমায় বারংবার
এসে আমায় দেও গো দিদার
তুমি বিনে কেউ নাই আমার
ওগো মুরশীদ খোদা।
সাধনতত্ত্ব বিষয়ে ফুলবাস বলেন:
সাদেকী প্রেমিক হলে, কামরতি তাহার থাকে না
সহস্র দলে উজান চলে, কামত্যাগী প্রেমিক যেজন।
সুজন হলে উজান চলে, নাহি টলে রতিমাসা।
আত্মাতত্ত্ব:
জনমভর যত্ন করে একদিনও দেখলাম নারে
আমি এই দেখবার আশায় ফাঁদ পাতিলাম
তবু পাখি পড়ে না ফাঁদে, ‘পুড়ুত’ করে উড়ে যায়।
জীবনের এই হচ্ছে বিড়ম্বনা।
অভেদ তত্ত্ব:
জাত বিজাতি যে বাছে
তার চেয়ে আর বোকা কে আছে?
আর ব্রহ্মাণ্ডময় একই খোদা–
এই মানুষ ছাড়া নয়কো জুদা
এক চিজেতে সবাই পয়দা,
ধাঁধায় পড়ে ঘুরতেছে।
বামুন কায়েত হাড়ি মুড়ি
একই জলে হলেন শুচি
সেখানে নাই বাছাবাছি
সকলে শুচি হচ্ছে।
আর চন্দ্র সূর্য নক্ষত্রগণ
এই মাটির উপরে সবারি আসন
এক মনিবের সব প্রজাগণ
ফুলবাস উদ্দীন ভাবতেছে।
এই অভেদ-দৃষ্টি লাভ করা কেবল লোকান্তরে প্রসারিত জীবন অধ্যাত্মবাদীর পক্ষেই সম্ভব। বাউলেরা বৈষ্ণবদের মতো সমাজ প্রতিবেশ সম্বন্ধে উদাসীন নয়। বাউল গানে ব্যবহারিক জীবনের নানা বস্তু থেকে রূপকাদি গৃহীত হয়েছে। সাধারণত দেহতত্ত্ব ও আত্মবোধন বিষয়ক গানেই রূপপ্রতীকের আধিক্য দেখা যায়। বাউলেরা জীবনকে নৌকা এবং দুনিয়াকে দরিয়া ভাবতে বিশেষ অভ্যস্ত।
ফুলবাসের শিষ্য নসরুদ্দীনের ধারণায়, আল্লাহ্ ভক্তবৎসল। আল্লাহ্ বলেন:
‘আমি ভক্তের অধীন আছি চিরকান
ধনী মানী দুঃখী তাপীরে — কাহাকেও ভাবি না ভিন।
যেভাবে রাখে যেবা জন,
তার কাছে রই তেমনি মতন,
যোগাই তাহার মন।’
নসরুদ্দীনের সৃষ্টিতত্ত্ব:
নীর হইতে নূরের আকার ধরে,
আলিফ রূপে সেই পরওয়ার
আহাদ নামটি হল তাহার
নূর-নিরঞ্জন যারে কয়
আলিফের ‘কালেব’ হইতে
আহাদ এল মিম রূপেতে
আহমদ রয় মিমের মধ্যে
মিমরূপে সেই জগৎ সাঁই
মিম ফেটে হয় মোতির মতন
সেই নূরে আদম হয় চেতন
জাতে জাতে এল তখন
পেল বিবি আমেনায়।
নসরের মতে:
দেহের বিচে দেখ আছে আজব কারখানা
তিনশত ষাট দিয়ে জোড়া করেছে দেহ খাড়া
দুই খুঁটি একটি আড়া — বেড়া চারখানা
দশ দরজা আট কুঠুরি — চার কুতুব ষোলো প্রহরী
বায়ান্ন গলি, তিপান্ন বাজার, তের নদী সাত সমুদ্দর
তাহার মধ্যে চোদ্দটা ঘর, কেউ করে না তাহার খবর —
তিন উজির তিন বাদশা তার, এক মনিব দুই খরিদ্দার
দালাল তাহার দুইজনা।
দেহের খবর বড় খবর
তিন তারেতে হচ্ছে সব খবর।
বারো বুরুজ সাত সিতারা,
দেহের ভিতর আছে পোরা।
আর দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে বিভিন্ন শক্তির অধীন। নসরের ভাষায়:
ওয়াজেবল অজুদের মাঝি — রহমানি নফস আছে
ওয়াহেদল অজুদের বিচে — মাতাইন্না নফস রয়
আর মমকেনল অজুদের ধারা — বাস করে নফস আম্মারা
মমতেনাল অজুদে পোরা, লওমা সেই নফস কয়
মলহেমা বলে যারে, আরফেল অজুদে ফিরে
পাঁচ অজুদকে চিনতে পারলে নসর কয়, অধর ধরা যায়।
স্বরূপ-রূপে নিয়ে নয়ন চেতন হয়ে দেখ এবার
মিমমোকামে ভজন সাধন, ‘হাহুতে’ সেই সাঁই-এর আসন।