এভাবে তিনি উপলব্ধি করলেন :
আনন্দ অমৃত রূপে বিশ্বের প্রকাশ।
অন্তহীন দেশকালে পরিব্যাপ্ত সুত্যের মহিমা।
যে দেখে অখণ্ড রূপে
এ জগতে জন্ম তার হয়েছে সার্থক।
(রোগশয্যায়-২৬),
এবং—
যে চেতনা উদ্ভাসিয়া উঠে
প্রভাত আলোর সাথে
দেখি তার অভিন্ন স্বরূপ,
কেননা—
আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি
জড়তার নাগপাশে দেহ-মন হইত নিশ্চল।
(রোগশয্যায়-৩৬)
এই উপলব্ধিতেই—-
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি।
(আরোগ্য-১)
এবং —-
পরম সুন্দর আলোকের স্নান পুণ্য প্রাতে।
অসীম অরূপ
রূপে রূপে স্পর্শমণি।
রসমূর্তি করিছে রচনা,
সব কিছুর সাথে পশে মানুষের প্রীতির পরশ
অমৃতের অর্থ দিয়ে তারে।
মধুময় করে দেয় ধরণীর ধূলি,
সর্বত্র বিছায়ে দেয় চির-মানবের সিংহাসন।..
(আরোগ্য-২)
.
০৩.
একদিকে ভূমার এইরূপ উপলব্ধি, অন্যদিকে ভূমির মানব-সংসারের বিচিত্র জীবন-প্রবাহও কবিকে নতুন দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দান করেছে। মূলত এ তার চিত্ত-সাধনার দুটো শাখা : সৃষ্টির রহস্য-চেতনা আর মানব-ঐতিহ্য মন্থন। একসাথে চলল রূপ আর অরূপের সাধনা।
মানব-ইতিহাসের বাণী আজ তাঁর কাছে সুস্পষ্ট। কেননা কবি দ্রষ্টা। তিনি দেখেছেন :
মানব আপন সত্তা ব্যর্থ করিয়াছে দলে দলে।
বিধাতার সংকল্পের নিত্যই করেছে বিপর্যয়।
ইতিহাসময়
সেই পাপে, আত্মহত্যা অভিশাপে আপনার সাধিছে বিলয়।
(জন্মদিনে–২২)
অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের চূর্ণীভূত পতনের কালে,
দরিদ্রের জীর্ণদশা বাসা তার বাঁধিবে কঙ্কালে
(জন্মদিনে–২২)
আবার—
দুঃখে দুঃখে পাপ যদি নাহি পায় ক্ষয়
প্রলয়ের ভস্মক্ষেত্রে বীজ তার রবে সুপ্ত হয়ে
নূতন সৃষ্টির বক্ষে
কণ্টকিয়া উঠিবে আবার।
(রোগশয্যায়–৩৮)
অন্যায়েরে টেনে আনে অন্যায়েরই ভূত।
ভবিষতের দূত।
(জন্মদিনে–১৬)
সুতরাং
এ পাপযুগের অন্ত হবে তখনই যখন
মানব তপস্বী বেশে
চিতাভস্ম শয্যাতলে এসে
নবসৃষ্টি ধ্যানের আসনে
স্থান লবে নিরাসক্ত মনে,
(জন্মদিনে–২১)
এবং
আত্মার অমৃত অন্ন করিবারে দান
যাঁরা সাধনা করেছিলেন :
অকৃতার্থ হন নাই তারা
মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ মাঝে
শক্তি যোগাইছে যাহা অগোচরে চির-মানবেরে
তাহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি।
আজি এই প্রভাত আলোকে
তাঁহাদের নমস্কার করি। (জন্মদিনে–১৭)
মৃত্যু এসে একদিন তাকে বিচ্ছিন্ন করে নেবে রূপ জগৎ হতে জীবন মিলে যাবে অচিহ্নিত কালের পর্যায়ে (জন্মদিনে-৪)। তাই কবি অনুভব করছেন।
জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদ বেদনা (আরোগ্য–৪)
এবং
হিংস্ররাত্রি যে চুপি চুপি অন্তরে প্রবেশ করে।
হরণ করিতে থাকে জীবনের গৌরবের রূপ (আরোগ)-৭)।
তা-ই কবিকে বিচলিত করে এবং অনাগত কালে বেঁচে থাকবেন না বলেও কবি ব্যথিত হচ্ছেন :
সে আমার ভবিষ্যৎ
যারে কোনো কালে পাই নাই
যার মধ্যে আকাক্ষা আমার
ভূমিগর্ভে বীজের মতন
অঙ্কুরিত আশা লয়ে
দীর্ঘরাত্রি স্বপ্ন দেখে ছিল
অনাগত আলোকের লাগি। (রোগশয্যায়-২২)।
কিন্তু এসব ক্ষণস্থায়ী, কেননা কবি জেনেছেন :
প্রভাতের প্রসন্ন আলোকে
দুঃখ বিজয়ীর মূর্তি দেখি আপনার
জীর্ণ দেহ দুর্গের শিখরে। (আরোগ্য–৭)
এবং
প্রভাতে প্রভাতে পাই আলোকের প্রসন্ন পরশে
অস্তিত্বের স্বর্গীয় সম্মান।
জ্যোতিস্রোতে মিলে যাক রক্তের প্রবাহ,
নীরবে ধ্বনিত হয় দেহে মনে
জ্যোতিষ্কের বাণী। (রোগশয্যায়–৩২)
অপূর্ব আলোকে মানুষ
দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ
সাবিত্রী পৃথিবী এই আত্মার মর্তনিকেতন, (জন্মদিনে–৫)
এই মর্ত্যলীলাক্ষেত্রে সুখে দুঃখে
অমৃতের স্বাদ পেয়েছি তো ক্ষণে ক্ষণে
বারে বারে অসীমেরে দেখেছি সীমার অন্তরালে
বুঝিয়াছি, এ জন্মের শেষ অর্থ ছিল সেইখানে।
সেই সুন্দরের রূপে
সে সংগীতে অনির্বচনীয়। (জন্মদিনে–১৩)
কিন্তু
আকাশবাণীর সাথে প্রাণের বাণীর।
সুর বাঁধা হয় নাই পূর্ণ সুরে।
ভাষা পাই নাই। (রোগশয্যায়-৩)
সুতরাং কবির এই যা দুঃখ, কেননা—
বৈদিক মন্ত্রের বাণী
কণ্ঠে যদি থাকিত আমার
মিলিত আমার স্তব
স্বচ্ছ এই আলোকে আলোকে
ভাষা নাই ভাষা নাই। (আরোগ্য–৩)
তাই কবি কণ্ঠে জেগেছে আকুল আবেদন :
করো করো অপাবৃত্ত হে সূর্য, আলোক আবরণ
তোমার অন্তরতম পরম জ্যোতির মধ্যে দেখি
আপনার আত্মার স্বরূপ। (জন্মদিনে–১৩)।
এবং
হে সবিতা তোমার কল্যাণতম রূপ।
করো অপাবৃত্ত,
সেই দিব্য আবির্ভাবে
হেরি আমি আপন আত্মারে মৃত্যুর অতীত। (জন্মদিনে–২৩)
.
০৪.
উপরি উদ্ধৃত কবিতাদ্বয়ে এবং রোগশয্যায় কাব্যের ২৬, ২০ আরোগ্য কাব্যের ৩২ এবং জন্মদিনে কাব্যের ২৭ সংখ্যক কবিতায় সূর্যকেই সৃষ্টির মূলীভূত কারণরূপে কল্পনা করা হয়েছে :
পাঠায়েছি নিঃশব্দ বন্দনা
সেই সবিতারে যার জ্যোতিরূপে প্রথম পুরুষ
মর্তের প্রাঙ্গণতলে দেবতার দেখেছি স্বরূপ।
তাই কবি সূর্যকেই সম্বোধন করেছেন উপরোক্ত ও অন্যান্য বহু কবিতায় :
হে প্রভাত সূর্য।
আপনার শুভ্রতম রূপ
তোমার জ্যোতির কেন্দ্রে হেরিব উজ্জ্বল (রোগশয্যায়–১৫)
শুধু নিজের নয়, কবি সবকিছুর রূপ সূর্যের আলোকেই প্রত্যক্ষ করেছেন : (রোগশয্যায়–৫, ১৬, ২১, ২৪, ২৬, ২৭, ৩২, ৩৩) এবং এইভাবে পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন :
আলোকের অন্তরে যে আনন্দের পরশন পাই
জানি আমি তার সাথে আত্মার ভেদ নাই,
এক আদি জ্যোতি উৎস হতে
চৈতন্যের পূণ্যস্রোতে
আমার হয়েছে অভিষেক,
ললাটে দিয়েছে জয়লেখ,
জানায়েছে, অমৃতের আমি অধিকারী
পরম আমির সাথে যুক্ত।
পেতে পারি বিচিত্র জগতে
প্রবেশ লভিতে পারি আনন্দের পথে। (আরোগ্য–৩২)