আত্যন্তিক আত্মরতি পরপ্রীতির পরিপন্থী। বঙ্কিম স্বজাতিকে বড় ভালোবাসতেন। তাঁর চিন্তা, ধ্যানধারণা সবই একান্তভাবে হিন্দুর জন্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোনো নীতি-উপদেশে মানুষকে সহজে উদ্বুদ্ধ করা যায় না-বরং প্রতিহিংসা বৃত্তি উসকিয়ে দিলে সহজেই উত্তেজনা সৃষ্টি করা সম্ভব। তিনি বাস্তবে করলেনও তাই। যেহেতু ইংরেজ শাসক, সেহেতু ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিহিংসা-বৃত্তি জাগিয়ে তুললে সমূহ বিপদ। তাই তিনি হিন্দুদের মনে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির জন্যে পুরাতন দুশমন (বর্তমানে মৃত হলেও) মুসলমানদের বিরুদ্ধে (আসলে তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠীই লক্ষ্য) হিন্দুদের উত্তেজিত করে তুললেন–নানা সত্য ও কাল্পনিক অত্যাচারের ও অমানুষিকতার চিত্র তুলে ধরে। হিন্দু উত্তেজিত হল। বলা চলে হিন্দুমনে মুসলিম বিদ্বেষের সাথে সাথে স্বাজাত্য ও স্বদেশপ্রেম জাগল–হিন্দু জাতি গড়ে উঠল, কিন্তু ভাঙল মুসলমানের মন। ক্ষুব্ধ হল শিক্ষিত মুসলমান। [মুসলমান-এর পরিবর্তে তুর্কী কিংবা মুঘল শব্দ ব্যবহার করলে কোনো বিদ্বেষ-তিক্ততাই হয়তো সৃষ্টি হত না।]
মুসলমান ছিল এদেশে শাসক জাতি। তাদের উত্তম্মন্যতা শাসিতের প্রতি হয়তো অবজ্ঞার সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু বিদ্বেষ তাদের ছিল না। তাই ইংরেজ যখন তাদের শাসন-ক্ষমতা কেড়ে নিল, তখন ইংরেজকে তাড়াবার জন্যে তারা নিজেরা সগ্রাম করল এবং হিন্দুদের সহযোগিতাও করল কামনা। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যই তাদের প্রধান কাম্য ছিল; এবং ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দ অবধি মুসলমানগণ হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামী মনোভাব বজায় রেখেছিল। এরপরে স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে মুসলমানরা ব্রিটিশের প্রতি সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। অবশ্য এরপরও যারা ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজ-বিরোধী হয়ে রইলেন, তাঁরাই পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক জাতীয়তা গড়ে তুলবার সাধনা করেন। ভারতবর্ষের অপরাপর অঞ্চলে এ সাধনা সাফল্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাঙলাদেশে মুসলমানেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুদের হাতে পীড়িত হচ্ছিল বলে বঙ্কিমকেই হিন্দুমানসের প্রতীক ধরে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ১৯৩৭ সাল থেকে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বাঙলায় নয়, বঙ্কিম সাহিত্য প্রভাবিত বাঙলাতেই অখণ্ড জাতীয়তায় ফাটল ধরল এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙলাদেশে মুসলিমলীগের ভিত্তি দৃঢ় মূল হল। এরপর এল দাঙ্গা, এল আজাদী। পাকিস্তান কায়েম হল। আমাদের ধারণা প্রতিভামাত্রই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, স্থিতধী ও বাস্তব সমস্যা-সচেতন। কিন্তু এ তৌলে বঙ্কিম টেকেন না।
.
০৩.
এবার বঙ্কিমচন্দ্রকে আদর্শবান শিল্পী ও উদ্দেশ্যমূলক রোমান্টিক উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বিচার করা যাক। এজন্যে কিছু ভূমিকার দরকার।
শহর কলকাতা গড়ে ওঠে পালিয়ে আসা লোক নিয়ে। জব চার্নক থেকে শুরু করে হিন্দু মুসলমান সবাই এল এভাবেই। কেউ এল আত্মরক্ষার জন্যে, কেউ এল আত্মগোপনের জন্যে আর বেশির ভাগ এল আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রসারের উদ্দেশ্যে। কাজেই দেশ ও সমাজ থেকে বিচ্যুত জনসমষ্টি নিয়ে গড়ে উঠল নতুন বন্দর কলকাতা। এসব লোকের কিছুটা অনন্যতা স্বীকার করতে হয়; তাদের উচ্চাভিলাষ, অধ্যবসায়, বিপদের ঝুঁকি নেবার সাহস, বুদ্ধিমত্তা প্রভৃতি নিশ্চয়ই ছিল। ইংরেজ বেনের বানিয়ান হয়ে ওরা নিজেদের ভাগ্য তৈরি করতে থাকে। তারপর পলাশীর যুদ্ধের পর যখন শাসক-শাসিতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে ও ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে পাশ্চাত্য মন-মনন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হল, তখন তাদের মানস-দৈন্য ও ঘরোয়া দীনতা তাদের মনে তীব্র গ্লানিবোধ জাগাল। য়ুরোপীয় রেনেসাঁস প্রসূত Rationalism যে-স্বরূপে সেদেশে প্রকাশ পেল, তা সেদেশেরই ধর্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে ও ব্যক্তিজীবনে বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন এনেছিল। নবলব্ধ বিজ্ঞানবুদ্ধির আলোকে তারা পুরোনো বিশ্বাস ও সংস্কারের সঙ্গে পুরাতন সমাজ, ধর্ম, আর ব্যক্তি-জীবন-ধারণাকেও পাল্টাল। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে এই নতুন মূল্যবোধের ফলে সেদেশের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারীর মর্যাদা, স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, মানবতা, যুক্তিবাদ প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্ব পেল। যার ফলে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, সমাজজীবনে সংস্কারমুক্তি, ধর্মে আচার শৈথিল্য, ব্যক্তিজীবনে ন্যায়নিষ্ঠা ও বন্ধনমুক্তি, মুখে মানবপ্রীতি, মন-মননে দ্বন্দ্ব অত্যধিক বিজ্ঞানানুগত্য, যুক্তিবাদে আস্থা প্রভৃতি শিক্ষা, সুরুচি ও আভিজাত্য প্রকাশের কৃত্রিম-অকৃত্রিম অবলম্বন হল। বিজ্ঞানভিত্তিক নাস্তিক্য ও সংশয়বাদই এ-যুগের দর্শনের মূল আলোচ্য।
ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের মাধ্যমে কলকাতার শিক্ষিতজনেরা য়ুরোপের এই মানস-সম্পদ লাভ করে আশায়-উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়ে উঠল। তাদের নিস্তরঙ্গ নিশ্চিন্ত জীবনে যে বিচলন এল, অনভ্যস্ত চোখে হঠাৎ যে-আলো ঝলসিয়ে উঠল, তাতে টাল সামলানো সম্ভব ছিল না। রাজা রামমোহন রায় থেকে এজুরা পর্যন্ত সবাই তাই বেশ কিছুকাল উত্তেজনায় অস্থিরচিত্তে ছুটোছুটি করেছেন। সবারই মনের কথা, বদলাও–পাল্টাও, নতুন কিছু করো। এর তাৎপর্য ও স্বরূপটি বুঝে নিতে হবে। গরিব যখন অপ্রত্যাশিতভাবে ধনী হয়, কিংবা কোনো ভুঁইফোড় ব্যক্তি শিক্ষিত হয়ে বড় চাকুরে হয়, তখন সে তার জীবনের মান উন্নয়নের জন্যে বড় ব্যস্ত হয়ে ওঠে! রুচি পালটিয়ে রাতারাতি সংস্কৃতিবান হয়ে অভিজাতশ্রেণীর একজন হবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। গত শতকের কলকাতার শিক্ষিত-মনেও পাশ্চাত্য প্রভাবে এমনি আকুলতা জেগেছিল পাশ্চাত্য আদর্শে জীবনযাপনের জন্যে এবং পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলবার আগ্রহে! তাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের পরিবার ও সমাজ। গোটা জাতির কথা কেউ ভাবেনি। বিশেষ করে তা তখনি সম্ভব বলে কল্পনা করাও ছিল দুঃসাধ্য। তাই রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর রামকৃষ্ণ প্রমুখ সবাই যা-কিছু করেছেন তা কলকাতার ভেতরেই। এ হচ্ছে কলকাতার হঠাৎ-জাগা ধনী ও ভূঁইফোড় ইংরেজিশিক্ষিতদের পরিবার ও সমাজ গড়ে তোলার আন্দোলন। এ যুগে শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন গোটা জাতির উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হতে পারে এবং হয়ও। তার কারণ মফস্বলের লোকেরাও শিক্ষিত এবং খবরের কাগজ ও বইপত্রের মাধ্যমে শহর ও গ্রামের বাহ্য ও মানস-দূরত্ব ঘুচে গেছে। কিন্তু উনিশ শতকী আন্দোলনের এ ব্যাখ্যা চলতে পারে না। তাদের অবচেতন মনে গোটাজাতির চিন্তা যদি থাকেও তা ছিল একান্তভাবে পরোক্ষ, আকস্মিক এবং অপ্রধান। সুতরাং আমাদের উনিশ শতকী রেনেসাস ছিল একান্তই আত্মকেন্দ্রিক এবং সংকীর্ণ চেতনার প্রসূতি। তখনো তার হিন্দু চেতনার উর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়ে বাঙালি জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারেনি। তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণের কর্ম ও চিন্তার মধ্যে সংখ্যাগুরু মুসলমানকে পাইনে।