বঙ্কিমচন্দ্র যা-কিছু লিখেছেন তা কেবল হিন্দু ও হিন্দুয়ানীর উন্নতির জন্যেই। এমন যে রোমান্টিক রচনা কপালকুণ্ডলা, তাতেও মতিবিবির মাধ্যমে হিন্দুয়ানীকেই (হিন্দুসতীর পতিপ্রাণতাকে) মহিমান্বিত করেছেন। যে বঙ্কিমচন্দ্রের দিনের সাধনা ও রাত্রির স্বপ্ন ছিল ধর্মে, সমাজে ও রাষ্ট্রে হিন্দুকে আদর্শ মানুষ ও জাতি হিসেবে দাঁড় করানো, তার এ ধরনের প্রচেষ্টার আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে?
বঙ্কিমচন্দ্র নিজে সাহিত্যে একমাত্র utility-বাদেই বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সাহিত্যের সেই বিচারে যদি আজ তিনি ঘায়েল হন, তবে কর্মদোষে আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কী? বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গাঁয়ের বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন সেকালের হুগলী কলেজে। তাঁর মানস গড়ে উঠেছিল বই পড়ে আর গাঁয়ের পুরোনো ধরনের পরিবেশে। কাজেই কলকাতা শহরের মুক্তবুদ্ধি শিক্ষিত তরুণের মনের স্পর্শ তিনি পাননি। তাঁর অহেতুক ও নিরর্থক অভিমান জিইয়ে রাখার অবাঞ্ছিত সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন এভাবেই।
এসব সত্ত্বেও বঙ্কিমচন্দ্র এযাবৎ শ্রদ্ধার আসনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই আসীন রয়েছেন। উনিশ তকে এ শ্রদ্ধা তিনি পেয়েছিলেন অসামান্য শিল্পী ও রোমান্স-রচয়িতা হিসেবে। তিনি লেখক তথা শিল্পী হিসেবে ছিলেন উনিশ শতকের বাঙলার বিস্ময়। আর বিশ শতকের গোড়ার দিককার বিপ্লবীদের (অরবিন্দ ঘোষ প্রভৃতির) বদৌলতে আনন্দমঠ, রাজসিংহ, সীতারাম প্রভৃতির জন্যে তিনি হলেন ঋষি। এ পর্যায়ে তাকে আর শিল্পী কিংবা সমাজবেত্তা হিসেবে যাচাই করবার অবকাশ বা প্রবৃত্তি কারুরই রইল না। তিনি হিন্দুজাতীয়তা ও স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রদ্রষ্টা ও উদ্গাতা ঋষিরূপেই কেবল পূজা পেতে থাকলেন। [ অথচ তখনই স্বাধীনতা চাওয়া অনুচিত- এটাই ছিল উপন্যাসগুলোতে বঙ্কিমের প্রতিপাদ্য। তখন য়ুরোপীয় আদলে শিক্ষিত ও উদ্যোগী মানুষ তৈরি করাই তার লক্ষ্য।
আজ স্বাধীনতা-উত্তর যুগে যখন সে প্রয়োজন মিটে গেছে, তখন বঙ্কিমের মন-মনন ও লেখা নিয়ে সমালোচনা–বিজ্ঞানসম্মত চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ চলবে। এ ধোপে utility-বাদী সমালোচকের দৃষ্টিতে বঙ্কিম জাতির শিরোমণিও হতে পারেন, আবার শিল্পী ও মনীষীকুলকলঙ্ক বলে নিন্দিতও হতে পারেন, দুই সম্ভব। আমার ধারণা, হবেনও তাই। কিন্তু কেবল শিল্পী হিসেবে যেসব সমালোচক তার যোগ্যতা যাচাই করবেন, সেসব রসগ্রাহী পাঠক-সমালোচকের বিস্ময়মুগ্ধ চিত্তলোকে তার মর্যাদার আসন অক্ষয় হয়ে থাকবে। এ শ্রেণীর লোকের কাছে বঙ্কিম কী বলেছেন তা বড় নয়, কেমন করে বলেছেন তা-ই দ্রষ্টব্য।
উনিশ শতকী শূন্যতায় বঙ্কিমের আবির্ভাব ও সৃষ্টি এক বিস্ময়কর ব্যাপার। মধুসূদনও প্রতিভা কিন্তু তার প্রভাব ছিল সীমিত। আমরা যদি প্রত্যেক মানুষের স্বভাবের ও মননের বৈচিত্র্য স্বীকার করে নিই, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবাদর্শের জন্যে তাকে মোটেই দোষ দেয়া যায় না। আমাদের পছন্দসই হল না বলে তা মন্দ হতে পারে না।
কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমাদের ক্ষোভ এই যে তাঁকে আমরা যুগন্ধর ও যুগোত্তর প্রতিভা বলে জানতাম। এতকাল পরে যখন তার সম্বন্ধে আচ্ছন্নভাব কেটে গেছে, তখন দেখতে পাচ্ছি–তাঁর অপূর্ণতা এবং প্রতিভাসুলভ মৌলিকগুণের অভাব। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক, পেয়েছি তার চাইতে কম, তাই এত ক্ষোভ।
তিনি উনিশ শতকের শেষার্ধের লোক হয়েও এবং তাঁর সমকালের য়ুরোপীয় নাস্তিক্য দর্শন, সংশয়বাদ, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রদর্শন, সমাজ প্রভৃতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান এবং ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, মার্কস ও ডারুইন মতবাদের সঙ্গে পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তিনি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রথায় হিন্দু-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর ধারণায় হিন্দু রাজত্ব হলেই হিন্দুজাতির প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙলাদেশে উনিশ শতকের শেষার্ধেও হিন্দু রাজত্ব ছিল দিবাস্বপ্ন মাত্র। যে য়ুরোপ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেখানে যে গণতন্ত্রের বীজ সর্বত্র উপ্ত হচ্ছে এই উচ্চাভিলাষী মনীষীর তা নজরে পড়ল না। কেবল শাসনে নয়, শিক্ষা ও ধনাগম সংস্থাতেই যে তথা অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপরই যে এ-যুগের উন্নতির বীজ নিহিত একালের রাষ্ট্রসংস্থার ভিত্তি রচিত, তা ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের উপলব্ধির বাইরে। তিনি হিন্দুর বাহুবল ও চরিত্রবলের ধ্যান করতেন। জ্ঞানবল ও ধনবল তাঁর চিন্তায় গুরুত্ব পায়নি; অথচ এ-যুগে শক্তির উৎস হচ্ছে এ দুটোই। বাঙলাদেশে মুসলমানকে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দুর স্বাধীনতা-বাঞ্ছ যে পূর্ণ হবার নয়– এ বাস্তব বুদ্ধি তাঁর কাছে প্রশ্রয় পায়নি। ফলে তাঁর সাধনা আপাত সফল হলেও পরিণামে ব্যর্থ হল।
হিন্দু-মুসলমান কি কোনোকালে একজাতি ছিল যে বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া যাবে? বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বিজাতি-বিদ্বেষী। সাধারণভাবে বিচার করলে এতে অন্যায়-অস্বাভাবিকতা কিছুই পাওয়া যাবে না। কেননা বঙ্কিম যে-মুসলমানকে গাল দিয়েছেন, তারা তুর্কী-মুঘল শাসকগোষ্ঠী। যে বিদেশী বিজাতি ও বিধর্মী এদেশে চেপে বসল আর দেশবাসীর স্বাধীনতা ও সম্পদ কেড়ে নিল, তাদের প্রতি বিরূপ থাকাই তো স্বাভাবিক ও শোভন। সহজাত এই বিরূপতা দেশী মুসলমানের গায়েও লাগল, কেননা ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে এবং আভিজাত্যবোধে দেশী মুসলমানেরাও নিজেদের তুর্কী-মুঘলের জ্ঞাতি ভাবতে শিখেছে। যেমন দেশী খ্রীস্টানরা স্বজাতি ভেবেছে ইংরেজকে। শাসক-শাসিতের পূর্বসম্পর্ক স্মরণ করে উনিশ শতকের হিন্দু লেখকমাত্রই মুসলমানদের প্রতি কমবেশী বিরূপতা দেখিয়েছেন। সে-বিরূপতা বিদ্বেষ ও বিদ্রূপ-রূপে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি মধুসূদনের মতো সংস্কারমুক্ত প্রতিভাও এ দোষ থেকে মুক্ত নন। তার প্রহসনে মিয়াজান ও কৃষ্ণকুমারী নাটকে যবন–অপহৃতা পদ্মিনী প্রসঙ্গ স্মত। তবু অন্যদের কথা আলোচ্য নয় এজন্যে যে তাঁরা কেউ প্রভাবশালী ছিলেন না। কিন্তু বঙ্কিম যুগস্রষ্টা প্রতিভা বলে স্বীকৃত। কাজেই তাদের পক্ষে এ অনুদার ও অবিজ্ঞজনোচিত মনোভাব দুষণীয়। শাসক-শাসিতের পূর্ব সম্পর্ক যা-ই থাক না কেন, ইংরেজ-শাসনে যখন হিন্দু-মুসলমানের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা, তখন দূরদর্শী জাতিপ্রাণ মনীষীর কর্তব্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের সংহতি সাধনা করা। বঙ্কিমের মনন-দৈন্য এখানে যে, তিনি প্রয়োজন-সচেতন ছিলেন না। একচক্ষু হরিণের মতো তিনি হিন্দু-জাগরণের চারণ কবি ব্রতকেই বড় মনে করেছেন, দেশের সামগ্রিক স্বার্থের দিকে নজর রাখেননি। তাই তিনি হিন্দুর ঋষি হলেন বটে, কিন্তু দেশের চিন্তানায়কের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রইলেন।