তারপর বাঞ্ছহত প্রায় বেকার মধুসূদন যৌবনের প্রান্তে এসে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখের ইয়ার্কিসুলভ Challenge গ্রহণ করে নিতান্ত কৌতুকবসেই বাঙলায় প্রতীচ্য আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। এ হল অনেকটা খেলতে খেলতে সাহিত্য সৃষ্টি। অতএব জীবন- প্রভাতে যে কবি হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা অপূর্ণই রয়ে গেল। অথচ তন্ময় কাব্য-সার্থক মহাকাব্য রচনার জন্য যে-বিদ্যা ও বৈদগ্ধ্য প্রয়োজন তা তাঁর পুরোমাত্রায় ছিল। আবার ইংরেজি-বাঙলায় যা লিখলেন সমকালে তা-ও ন্যায্য কদর পেল না। উচ্চপদ কিংবা রোজগারের জন্যে যে-যোগ্যতা প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। ব্যারিস্টারি পাস করেও তিনি কোনোটাই পেলেন না। এমনি বিড়ম্বিত জীবন তার। এই হল মধু-জীবনে নিয়তির নির্যাতন–রাবণেরও ট্রাজেডি। লোক-বাঞ্ছিত পদ আর প্রতুল ঐশ্বর্য পেলেন না বলে তিনি ভাবলেন জীবন ব্যর্থ হল। উচ্চাভিলাষী, বিলাসপ্রিয়, ভোগলিলু, যশকামী, মানলোভী ও সুখপিপাসু মধুসূদন–গভীর আত্মবিশ্বাস ও অপরিমেয় সাহস থাকা সত্ত্বেও–ধন-যশ-মানের সাধনায় ব্যর্থ হলেন নিদারুণভাবে। তার অন্তরের ঐশ্বর্য ও মনীষা সম্বন্ধে যথাযথ মূল্যবোধ ও চেতনার অভাবে, কস্তুরী-সৌরভ মত্ত মৃগের মতো ছুটোছুটি করেই হয়রান হলেন।
এই বহির্মুখিতা এই বহিরার্জিত শক্তি-নির্ভরতা তাঁর সাহিত্যেও পাই। তার প্রধান চরিত্রের কেউ ত্যাগে সুন্দর নয়; বিভিন্ন ভাবে ভোগপ্রবণ। কৃষ্ণকুমারী নাটকের ভীম সিংহ শিশুর মতো সরল! পৌরুষ তাঁর একফোঁটাও নেই। কন্যার মৃত্যুর বিনিময়েও তিনি রাজ্যসুখ-ভোগ করতে চান। এ ব্যাপারে তার মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। বহির্শক্তির কবল থেকে ধনপ্রাণ বাঁচাবার কাপুরুষোচিত নির্বোধ উপায় খুঁজছেন ভীম সিংহ অথচ পুরুষোচিত গুণ ও আত্মমর্যাদাবোধের কণামাত্র তার মধ্যে উপস্থিত থাকলে সুকৌশলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিয়ে কিংবা নিজে প্রবলপক্ষে যোগদান করে আসন্ন বিপদ এড়াতে পারতেন। তা না করে তিনি অনাথা নারীর মতো নিজ কন্যার মৃত্যুতেই বিপন্মুক্তি খুঁজেছেন। তিনি শত্ৰুশক্তির ভয়ে এমনি কাবু রইলেন যে নিজের শক্তি যাচাই করবার কথা তার মনে একবারও জাগল না। বাইরের আঘাত প্রতিহত করবার শক্তি পান না তিনি নিজের মধ্যে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেন শক্তির পায়ে। জয়-পরাজয় ও দৈব মর্জি নির্ভর। তিলোত্তমাসম্ভবে দেখি ব্রহ্মার হাতের ক্রীড়নক তিলোত্তমার রূপমুগ্ধ ভোগলিন্দু সুন্দ-উপসুন্দ মারামারি করেই মরে, দেব গোষ্ঠীর জয় হয়, কারো মনে চিত্তোঙ্খিত দ্বন্দ্ব-সংশয় দেখা দেয় না। আত্মিক বলে–মনোবলে কেউ বলী নয়। অন্তরের খোঁজ কেউ রাখে না। আত্মিক চেতনা সেখানে দুর্লক্ষ্য।
ব্রজাঙ্গনাও তেমনি তার বিরহবোধের উপাদান খুঁজছে প্রকৃতিতে–অন্তরে নয়। বীরাঙ্গনায়ও মহৎ আদর্শচেতনা নেই, প্রকৃতি চালিত ঋজু ও অসংকোচ বাসনার প্রকাশই অভিনন্দিত হয়েছে। ভোগলিন্দু কবির কাছে।
তাঁর মেঘনাদবধের ইন্দ্রজিতেও দেখি বাহুবলেরই দম্ভ। আমি স্বামীসোহাগিনী সতী–এই দম্ভই প্রমীলাকে মৃত্যুবরণে অনুপ্রাণিত করেছে–এ মধুর জীবন, এ সুন্দর পৃথবী ছেড়ে যাওয়ার বেদনা তাকে যেন বিচলিত করতে পারছে না। রাবণের চিত্তক্ষেত্রও দেখতে পাই নির্কিকার। সে প্রজ্ঞাবান কিংবা বিবেকবান নয়। তবু বহির্শক্তির ভরসায় সে আত্মতৃপ্ত, কৃতার্থনুন্য ও নিশ্চিন্ত। তার শক্তির উৎস ঐশ্বর্য ও আত্মীয়-পরিজনের বিশেষ করে মেঘনাদেরই বাহুবল। তাই এক এক আত্মীয়ের মৃত্যুতে সে বিচলিত হচ্ছে, দুর্বলতা তাকে গ্রাস করছে। কান্নায় সে ভেঙে পড়ছে, তবু আত্মবিশ্লেষণের নাম করে না, নিজের কাছে নিজেকে ধরা দেয় না। অর্জিত ঐশ্বর্য ও জনবল-নির্ভর দাম্ভিকতা কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল। রাবণও শিশুর মতো সরল, খেয়ালি ও বেপরওয়া। বাইরের থেকে আঘাত আসলে সে-আঘাত প্রতিরোধ করবার শক্তি পায় না সে অন্তরে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে আত্মপ্রবোধ পেতে চায় নিয়তির নির্যাতনের নামে।
বাঞ্ছহত বিড়ম্বিত মধুসূদনের মন প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর শেষ অসমাপ্ত রচনা মায়াকানন ও বিষ না ধনুগুণ নামের মধ্যেও।
মধুসূদনও এমনি উদ্ধত সুন্দর শিশু। মধুচরিত্রের মাধুর্য এখানেই, মধু-জীবনের ট্রাজেডির বীজও এতেই উপ্ত আর মধু-সাহিত্যের তত্ত্বও এতে নিহিত।
বঙ্কিম-মানস
০১.
আলোচনার সুবিধের জন্যে সাহিত্য-শিল্প সম্বন্ধে আমার স্কুল ধারণাটি প্রথমেই জানিয়ে রাখছি। মাটি থেকেই ঘাস জন্মায়, তাই বলে মাটি আর ঘাস এক জিনিস নয়। তেমনি কাঁচামাটি আর পোড়া ইট এক বস্তু নয়। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তাদের জ্ঞাতিত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব, হয়তো সহজও, কিন্তু সাহিত্য সে-রকম কোনো পদার্থ নয় যে তাকে কতগুলো উপাদানের সমষ্টি মাত্র বললেই তার স্বরূপ বোঝা যাবে। শব্দের মধ্যে পদের যে অর্থগত তফাৎ, অভিধানের শাব্দিক অর্থ আর কাব্যের চরণান্তৰ্গত পদের অভিধা যেমন ভিন্ন, তেমনি সাহিত্য আর সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে তফাৎ বিস্তর। এ কারণেই বিষয়বস্তুর উচ্চতা কিংবা তুচ্ছতা সাহিত্য-রসের পরিমাপক নয়। শিল্প বলতে যে-কথাটি আমরা বুঝতে ও বোঝাতে চাই তা বিশ্লেষণ-সাধ্য নয়। মাটি থেকে ঘাস হল, এ আমরা দেখলাম, কিন্তু কেমন করে হল তা বোঝানো যায় না। যে-কোনো লিখিত রচনাকেই যদি সাহিত্য বলে ধরা যায় তাহলে লেখাপড়া-জানা লোক মাত্রই লেখে এবং সব লেখাই সাহিত্য। কিন্তু সেসব রচনাকে সাহিত্য বলি না। সে কি কেবল বিষয়বস্তুর তুচ্ছতার জন্যে? তাহলে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির ঘরোয়া চিঠিপত্র পর্যন্ত সাহিত্য হল কী করে? আদিকালের সেই তত্ত্ব এবার স্মরণীয় শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্টত্যগ্রে আর নীরস তরুবরঃ পুরতো ভার্তি। অথবা একালের সোনার হাতে সোনার কাকন কে কার অলঙ্কার কিংবা তেলা মাথায় তেল–এগুলির যে-কোনো একটি শব্দ পাল্টালেই সব সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। যেমন কোনো মুখের ছবিতে একটি তিল এদিক-ওদিক করলেই মুখের আদলই যাবে বদলে। সাহিত্য-শিল্প তেমনি একটি অনুভব-সাধ্য ব্যপার। ওটি থাকে তো রসও রইল, শিল্পও রইল। আর যা শিল্প তা-ই রস এবং তা-ই সাহিত্য। শিল্প-রস, কিংবা সৌন্দর্য সবকিছুর মূলে রয়েছে মানবিক রস, ইংরেজিতে যাকে বলে Human interest- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ না থাকলে তা মানুষের পছন্দসই হতেই পারে না। আর যা তৃপ্তি দেবে না, চেতনায় ঘা দেবে না, তা সাহিত্য নয় নিশ্চয়ই। আবার অনেক সময় মানবিকতা থাকলেও যেমন মানবিক রস জন্মাতে পারে, তেমনি এর অভাব ঘটলেও মানবিক রসের অভাব হয় না। চিত্তের উল্লাসই শুধু কাম্য নয়, চিত্ত বিক্ষোভও উৎকৃষ্ট সাহিত্য-রস হতে পারে; যেমন করুণ, ভয়ঙ্কর, বীভৎসাদি রস।