এ কেন এবং কেমন করে ঘটল, তা-ই বুঝবার চেষ্টা করা যাক। সুরুচি ও সংস্কৃতি হচ্ছে। শিক্ষা, শীল ও চর্যার প্রসূন। কাজেই তা জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হয়, বাইরে থেকে জুড়ে দিলে চলে না। প্রতীচ্য শিক্ষার মাধ্যমে ভারত-ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও মিলন-মুহূর্তে মধুসূদনের জন্ম। ইরেজের মহিমামুগ্ধ পিতার সন্তান, কোলকাতাবাসী ইরেজি-পড়য়া মধুসূদন আবাল্য প্রতীচ্য সংস্কৃতির রূপে মুগ্ধ। দেশী জীবনবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই নতুন-দেখা সংস্কৃতির সাদৃশ্য সামান্যই। কৈশোরেই মধুসূদন এই সংস্কৃতির পূজারী হলেন বটে কিন্তু যে-পরিবেশে কোনো সংস্কৃতি রক্তের-সংস্কারে পরিণত হয়; আজন্ম লালনে অনুভূতিসিদ্ধ অপরিহার্যতায় পরিণতি পায়; দেখে-শেখা ও পড়ে-পাওয়া সংস্কৃতি সে পরিবেশ পায় না, তেমনিভাবে আত্মস্থও হয় না, তা আভরণের মতোই আলগা থেকে যায়, ত্বকের মতো অঙ্গীভূত হয় না। একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক। কোনো অশিক্ষিত বা অশিক্ষিত-পরিবেশে লালিত অল্পশিক্ষিত ব্যক্তি যদি ঠিকেদারী কিংবা ব্যবসা করে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়, তাহলে সেও দেশের সংস্কৃতিবান ঐশ্বর্যশালী অভিজাতের মতো করে দালান-কোঠা তৈরি করে, আসবাবপত্র সাজিয়ে, বাগান-ফোয়ারা বানিয়ে চিত্র ও ভাস্কর মূর্তি রেখে সুরুচি ও আভিজাত্যবোধের প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু দুয়ের মধ্যে তফাৎ রয়েছে বিস্তর, একের পক্ষে যা আজীবন চর্চার অঙ্গ, অপরের পক্ষে তা বিলাস-বাঞ্ছার ও গৌরব-গর্বের সামগ্রী। একজনের যা আত্মোখিত, অপরজনের তা বহিরার্জিত। একে করে অন্তরের প্রবর্তনায়, অপরজনে গড়ে ঐশ্বর্য-শালিতার আস্পর্ধায়। একজনের দৃষ্টি অন্তর্মুখী, অপরজনের নজর বহির্মুখী!
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চর্চায় মধুসূদন এই অপরজন। কেননা, ইংরেজের সংস্কৃতিতে কেবল ইংরেজেরই অধিকার। এ তার পুরুষানুক্রমিক সাধনায় পাওয়া ধন, এ তার স্বরূপেরই বিচিত্র বিকাশ। এতে তারই আত্মার ঐকান্তিক ও অকৃত্রিম প্রকাশ। এ তারই দেহ-মন-আত্মার লাবণ্য, উপলব্ধ জীবনসত্য, এ কেবল তারই অঙ্গের লাবণ্য বাড়ায়, কেবল তারই চলন-বলন ও মননে শোভা পায়। এ তার নৈষ্ঠিক জীবনচর্যার প্রসূন। কাজেই এতে মধুসূদনের উত্তরাধিকার ছিল না। তিনি হলেন usurper–জবর দখলকার। এ সংস্কৃতির মর্মে অধিকার ছিল না তার। কেবল অবয়বে মালিকানা পেয়েই তিনি বাহ্যাড়ম্বর ও আত্মম্ভরিতাকে আভিজাত্য প্রকাশের বাহন করলেন। তাই তাঁর দৃষ্টি ছিল বহির্মুখখা। অন্তরের ঐশ্বর্যের মূল্য-মাহাত্ম্য তাঁর বোধে ধন-সম্পদের কাছে ম্লান। এজন্যে তিনি তার জ্ঞান-মনীষা, পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের কাঞ্চন-মূল্যের প্রত্যাশী ছিলেন। পদমর্যাদা ও ধন-সম্পদের যে ব্যবহারিক দাপট, তা-ই তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, কিংবা মনীষার জন্যে মানুষের অন্তরে ব্যক্তিবিশেষের জন্যে যে শ্রদ্ধার পুষ্পসন রচিত হয়ে থাকে, তা যে অসামান্য ও অতুল্য, সে তত্ত্ব তাঁর মনে জাগেনি। তাই ধনীর প্রতি ছিল তাঁর ঈর্ষা আর সাধারণের জন্যে ছিল তার অনুকম্পা ও অবজ্ঞা। ছাত্রজীবনে মাঝারি ছাত্রের সঙ্গেও তিনি মিশতেন না। আবার মেধাবী ছাত্রের সঙ্গে মেশার দীনতা-সূচক আগ্রহ ছিল তাঁর তীব্র। কবি হবেন–এ বাসনা থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সবচেয়ে বড় কবি হব–এ আকাক্ষা মনে রাখা নয়, কথায় ব্যক্ত করা হল সেই বহির্মুখখা দৃষ্টিজাত ঔদ্ধত্য। আমি কবি হব এই বাসনা প্রকাশে বাধা নেই, কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের চাইতে বড় কবি হব, এ উক্তি কেমন শোনায়,–কোনো অর্বাচীন-অবিমৃষ্য-অসংযত মনের পরিচয় দেয়!
সাহেবের দোকানে চুল কাটিয়েছি এক মোহর দিয়ে, রাজনারায়ণের ছেলে গুণে পয়সা দেয় না। দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা দেখে বড়লোকের ছেলে তাই … রাজকবি টেনিসনের মর্যাদা দেখে রাজকবি হওয়ার স্বপ্ন ও প্রয়াস, সাহেবপাড়ায় বাস করার জেদ, সাধারণ লোককে অনুগৃহীত করার আগ্রহ, পড়ে বড় হওয়া সত্ত্বেও কড়িতে বড় হওয়ার অস্থির প্রয়াস, ছোটলোকের কাছে বড়পনা ফলানোর জন্যে ধনী বন্ধুর কাছে কাঙালের মতো ধার চেয়ে বেড়ানো আর ছোটলোকের প্রাপ্য মিটিয়ে জবান রাখার আত্মপ্রসাদ লাভের মধ্যেও একই মনোভাব কাজ করেছে।
ত্যাগ ও অনাসক্তির মধ্যেও যে সুখ ও মর্যাদা আছে, তা ভোগকামী মধূসূদন ক্ষণকালের জন্যেও উপলব্ধি করেননি। তাঁর এত বিদ্যা, এত ভাষাজ্ঞান এবং অসামান্য প্রতিভাই তাকে সমাজে প্রথম শ্রেণীর গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তাঁর চোখের সামনে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায় কেশবচন্দ্র প্রমুখ অনেকেই কোলকাতার ধনীসমাজের শ্রদ্ধেয় ও মান্য হয়ে উঠেছিলেন। মধুসূদনের সেদিকে খেয়াল ছিল না। কেননা তিনি যে কোলকাতার ধনী-মানীর অন্যতম রাজনারায়ণ মুন্সীর সন্তান ও বিদগ্ধ সাহেব, তা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারেননি। তাই তিনি ঐশ্বর্য ও পদমর্যাদার মোহে মরীচিৎকার পিছু নিয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁর জ্ঞান, মনীষা-কবিত্ব তাঁকে তৃপ্তি দেয়া দূরে থাক, প্রবোধও দিতে পারেনি। অবশ্যি ভেতরকার আর্তনাদ ঢেকে রাখবার জন্যে তিনি এসবেরও আস্ফালন কম করেননি। কিন্তু এহো বাহ্য। কেননা, প্রজ্ঞা কিংবা আত্মিক ঐশ্বর্য-চেতনা তাতে ছিল অনুপস্থিত কিংবা সুপ্ত। নইলে ভোগ ও ঐশ্বর্থিক উন্নতিকে তিনি তুচ্ছ বলে মানতেন। ভাগ্যের এমনি বিড়ম্বনা, অপ্রমেয় আত্মপ্রত্যয় ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার জীবনের কোনো অভীষ্টই সিদ্ধ হয়নি। যে-কবি হওয়ার বাসনায় তিনি খ্রীস্টান হয়ে বিলেত যেতে চেয়েছিলেন তা অপূর্ণই রয়ে গেল। সময়মতো বিলেত যাওয়া ঘটেনি, তাঁর উদ্দিষ্ট কাব্যও তাই আর রচিত হয়নি। যেভাবে যেমন লোকবন্দ্য কবি হবেন আশা করেছিলেন, তা এমনিভাবে ব্যর্থ হল।