নজরুল-প্রতিভার পরম বিস্ময়কর দিক হচ্ছে সমকালীন জীবনবোধ। রাশিয়ার সাম্যবাদের বুলি যখন এদেশে পৌঁছেনি, তখন তারা ভারতবর্ষে–হয়তো গোটা এশিয়ায় তিনিই প্রথম জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ফরিয়াদ নিয়ে সমাজের ও রাষ্ট্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং উদাত্তকণ্ঠে প্রতিকারের দাবী জানালেন। এমন অকৃত্রিম দরদী বাঙলাদেশে কমই জন্মেছেন। এইজন্যেই তাকে এককথায় জীবনধর্মী মানবতার কবি বলে আখ্যাত করা হয়েছে।
কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তিনি প্রচার-সাহিত্যের কবি, তাঁর সাহিত্যে সাহিত্যের চিরন্তন উপাদান নেই। এসব মতবাদ একটু সেকেলে। কেননা যে-সাহিত্য মানুষের রসপিপাসা মিটাতে সমর্থ, তা পুরোনো হবার নয়। ধরতে গেলে সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, কবি সাহিত্যিকের প্রতিভার স্পর্শেই নগণ্য বিষয়বস্তুও শিল্পায়ত্ত হয়ে চিরন্তন রসের উৎস হয়ে থাকে। যেমন একটি দুর্ভিক্ষ বা একটি বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের কাহিনী শিল্পীর সক্ষম তুলিকায় চিরন্তন বাণীমূর্তি লাভ করে সর্বকালের পাঠকের কাছে কারুণ্যের নিঝর হয়ে থাকতে পারে। অথচ দুর্ভিক্ষ বা বন্যা এমন কিছু চিরন্তন সাহিত্যের উপাদান নয়। সুতরাং ভাব বা বিষয়বস্তু সাহিত্যের তেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, রূপায়ণশক্তিই সাহিত্যের চাবিকাঠি অন্য কথায় সাহিত্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে কঙ্কালস্বরূপ, ভাব হচ্ছে রক্তমাংস স্বরূপ এবং প্রাণ হচ্ছে প্রকাশভঙ্গি। এই প্রকাশ-প্রতিভা (style) না থাকলে রচনা সাহিত্য হয় না। সুতরাং নজরুল ইসলাম তার যে-কাব্য দিয়ে সমাজে সাহিত্যে-ভাষায় ছন্দে-সুরে যুগপ্রবর্তক কবি বলে অভিনন্দিত হলেন, সে-কাব্যের আবেদন অনাগতকালে থাকবে না এমন ধারণায় সত্য নেই বিশেষ। কেননা যা সাহিত্য তা রসোত্তীর্ণ কাজেই নজরুলের কাব্যের যে অংশ সাহিত্যরসময় সে-অংশ কখনো বিলুপ্ত হবে না। তা পুরোনো সাহিত্যরূপে উত্তরকালেও কদর পাবে। যদি সমালোচকদের যুক্তি মেনে নিয়ে বলি যেহেতু ইহা প্রচার সাহিত্য–এ-যুগের প্রয়োজনেই রচিত, সেহেতু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী যুগে এর কদর হবার কথা নয়, তাহলেও আমরা ভুল ধারণাই পোষণ করব, কেননা সেদিন এই সাহিত্য ইতিহাসের বাণীর ন্যায় সে-অনাগত দিনের জনগণকে আদর্শচ্যুতি বা পথবিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে। কারণ নির্বিশেষ মানুষ কোনোদিন দুষ্পবৃত্তির ও সংকীর্ণতার উপরে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং আজকের মতো সেদিনও পাঠকচিত্তে নজরুলের কাব্য রস ও প্রেরণা যোগাবে।
নজরুল ইসলাম স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক কবি। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি নির্যাতিত মানবতার কবি। স্বদেশের দুঃখী জনসাধারণের দুঃখ-বেদনা-নিপীড়নের ফরিয়াদ ও প্রতিকার প্রচেষ্টায় তিনি কলম ধরেছিলেন। সর্বপ্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অত্যাচারমুক্ত করে মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর ব্রত : যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস। যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেশ-জাতি ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে মানুষের যেখানে নির্বিশেষ পরিচয়, সেই পরিচয়ের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত এবং নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন করে তোলাতেই তাঁর সাধনা নিবদ্ধ ছিল। বিত্ত-বৃত্তি নিরপেক্ষ মানুষের যে–ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তির আত্মিক মর্যাদা আছে– সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এ স্বীকৃতি আদায় করাই ছিল তাঁর কাব্যসাধনার লক্ষ্য। তিনি চেয়েছিলেন মনুষ্যত্বের অবাধ স্ফুরণ ও বিকাশের অধিকার। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মানুষ নির্বিশেষের অবাধ ও সহজ মিলনের; যে-মিলনে বিত্ত-বৃত্তি-বেশাত বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, যে-মিলন সম্ভব হয় পরস্পরের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদার স্বীকৃতির উপর। তিনি চেয়েছেন এমন মিলন ময়দান যেখানে মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যাত্মা লাঞ্ছিত হয় না এবং যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে ভাই।
নতুন দৃষ্টিতে মধুসূদন
মধুসূদনকে আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষাপুষ্ট, আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসু, নবমানবতার উদ্গাতা আভিজাত্যগর্বী পরিশীলিত রুচির কবি এবং ধন-যশ-মান-লিন্দু উচ্চাভিলাষী মানুষ বলেই জানি এবং মানি। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ছিল অসামান্য, প্রয়াস ও সাধনা ছিল নিখাদ, আর আকাঙ্ক্ষা ছিল ধ্রুব। আকাক্ষা তো নয় যেন যোগ্যতালভ্য দাবী! তাঁর অটল আত্মবিশ্বাসই তার উদ্ধত উক্তি ও দাম্ভিক আচরণের উৎস। কৈশোরে ও যৌবনে তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তার চাওয়া আর পাওয়া নিয়তির মতো অমোঘ। তার এমনি আত্মপ্রত্যয় তাঁকে শিশুর মতো খেয়ালি, প্রাণবন্ত, বেপরওয়া ও উদ্ধত করেছিল। আমাদের চোখে যা অবিমৃষ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শিতা, তার কাছে তা-ই ছিল লক্ষ্য-নির্দিষ্ট অকৃত্রিম জীবন-প্রয়াস। তাঁর সীমাহীন আত্মপ্রত্যয় তাঁকে নিশ্চিত সিদ্ধির যে প্রত্যক্ষ মরীচিকায় নিশ্চিন্ত রেখেছিল, উত্তর-তিরিশে তা যখন নিয়তির ছলনারূপে প্রতিভাত হল, তখন হতাশায় ও হাহাকারে তাঁর মন-মরু কুঁকড়ে কেঁদে উঠল! তারই প্রতিচ্ছবি পাই আমরা তাঁর অমর কাব্যে ও রাবণ চরিত্রে।
পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট ইয়ংবেঙ্গলের ঐহিক জীবনবাদ ও পুরুষকারের বিঘোষিত মহিমার প্রতিমূর্তি ছিলেন মধুসূদন। আর তারই প্রতিচ্ছবি হলেন রাবণ। কিন্তু এই পুরুষকারের মূল আত্মায় নয়, আত্মম্ভরিতায়। কেননা পাশ্চাত্য জীবনবোধে ভূঁইফোড় মধূসূদনের চেতনায় পৌরুষ, ঐশ্বর্যগর্ব ভোগলিপ্সা স্কুল ও অমার্জিতই রয়ে গেছে; তার জীবনে কিংবা কাব্যে তা সূক্ষ্ম ও পরিসুত রুচি বা রসবোধে পরিণত হয়নি বরং দাম্ভিকতায় তার প্রকাশ এবং হতবাঞ্ছার হাহাকারে ঘটেছে তার পরিণতি।