কবি নিজে ছিলেন প্রাণধর্মী। এজন্যে প্রাণধর্মের প্রতীক তরুণ ও তারুণ্যকে কবি সর্বত্র অভিনন্দন জানিয়েছেন :
কুপমণ্ডুক অসংযমীর
আখ্যা দিয়াছে যারে–
তারি তরে ভাই গান রচে যাই
বন্দনা করি তারে।
কবি জীবনধর্মী অভিযাত্রীও বটে, তাই তিনি বলেছেন :
গাহি তাহাদেরি গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে
যারা আজি আগুয়ান।
এসবও হয়তো বাহ্য লক্ষণ। তার সর্বসংগ্রামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার সম্যক উপলব্ধি। তিনি এজন্যেই বলেছেন :
নাই দানব নাই অসুর? চাইনে সুর, চাই মানব।
কারণ–
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নাই কিছু মহীয়ান।
এহেন মানুষের তিনি প্রেমিক। এই মানুষকে ভালোবেসেই তিনি ধন্য হতে চান– জীবনকে চান সার্থক করে তুলতে। এমন মানুষের দুঃখ-বেদনা লাঞ্ছনায় কী তিনি স্থির থাকতে পারেন? তাই তাঁর ভাষা এত তীব্র, বাণী এমন তীক্ষ্ণ এবং জোরালো? এই ভালোবাসাই তাঁকে সাম্যবাদী করেছে– করেছে বিদ্রোহী, করেছে বিপ্লবী। কিন্তু তাঁর সাম্যবাদকে মার্কসবাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করলে ভুল হবে। কারণ তাঁর সাম্যবাদের গোড়ার কথা হচ্ছে মানুষ এক আদমের সন্তান, সুতরাং মানুষ মাত্রেই ভাই ভাই। মানুষ হচ্ছে আনতুমা খয়ায়ে উম্মাতীন। অতএব এক আল্লাহ ব্যতীত কোনো মর্ত্যশক্তির নিকট তার মাথা নত করতে নেই। মানুষের এ মর্যাদায় তিনি পূর্ণ বিশ্বাসী। সর্বপ্রকার কর্ম ও বৃত্তি যখন জীবন ও সমাজ রক্ষার জন্যে অপরিহার্য তখন কোনো কাজ বা পেশাই ছোট নয় এবং বৃত্তির জন্যে কেউ হেয় হতে পারে না। সেইজন্যেই কবি সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। তবু শ্ৰেণীবিলুপ্তির কথা তাঁর বাণীতে নেই। তিনি চেয়েছেন স্ব-স্ব অধিকার, বিত্ত ও বৃত্তি বজায় রেখে স্বাধিকারে স্বাধীনভাবে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদার পূর্ণ স্ফুরণ; চেয়েছেন এমন ব্যবস্থা যাতে স্ব স্ব স্বাতন্ত্র, মর্যাদা ও বৃত্তি বজায় রেখেও মানুষ যেখানে আসিয়া সমবেদনায় সকলে হয়েছে। ভাই। আইন করে চাপানো ধনসাম্য নয়–প্রীতি-বন্ধুত্বের সাম্য তথা সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাম্যই কবির কাম্য।
এই আদর্শই ছিল তাঁর কাব্যপ্রেরণার উৎস। এই আদর্শের বাস্তব রূপায়ণই ছিল তাঁর ব্রত। এই উদ্দেশ্যেই তাঁর সাধনা। এই-ই হচ্ছে তাঁর কাব্যের মূলবাণী–গানের মূল সুর। এইজন্যেই এ আদর্শের রূপায়ণে প্রতিবন্ধকস্বরূপ যতকিছু ছিল, সবকিছুর বিরুদ্ধে সর্বত্র তাঁর বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। তিনি মানবতার পূজারী মহাসাধক, প্রাণ-ও-জীবনধর্মের মূর্ত প্রতীক।
সুতরাং মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। যুগে যুগে সমাজ, সংস্কার, রাষ্ট্র প্রভৃতির অবাঞ্ছিত জঞ্জাল এসে মানুষের এই মৌলিক অধিকারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কবির সংগ্রাম হচ্ছে তাকে সব বাধা ও মালিন্য মুক্ত করে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। সে-সংগ্রাম করতে গিয়েই কবি বাঙালির সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটা বাঙালি জাতিকে (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, আদর্শে, আচারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ধর্মে, সাহিত্যে কোথাও যেন গ্লানি না থাকে। মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে–এই ছিল তাঁর অভিলাষ।
প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। কাজী নজরুলও এমনি একজন প্রতিভা। তিনি সমাজে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে নতুন যুগের প্রবর্তন করেছেন। যা অভিলাষ করেছিলেন, তা অনেকাংশে পূর্ণও হয়েছে। ভবিষ্যতে একদিন তাঁর স্বপ্ন হয়তো পুরোপুরিভাবেই সফল হবে। সেদিন তিনি থাকবেন না, কিন্তু তার আদর্শানুসারী লক্ষ লক্ষ প্রবুদ্ধ জন-কণ্ঠে সেদিন নিবেদিত হবে তাঁর প্রতি অকপট শ্রদ্ধা।
নজরুলের কাব্যসাধনার লক্ষ্য
নজরুল ইসলামই মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র কবি–যার অনন্য প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা ছিল। প্রতিভাবানেরা সমসাময়িক যুগের দিশারী ও নিয়ন্তা এবং ভবিষ্যৎকালের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। নজরুল ইসলামের মধ্যেও আমরা এসব লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে, সাহিত্যে, ভাষায়, ছন্দে ও সুরে একযোগে বিপ্লব আনয়ন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিরাট ও মহান। তাঁর স্বপ্ন ছিল গোটাজাতিকে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে দাঁড় করানো। শিক্ষায়, সভ্যতায়, আচারে, আদর্শে যেন কোথাও গ্লানি না থাকে, মনুষ্যত্বের সুউচ্চ সাধনায় যেন তার দেশবাসী আত্মনিয়োগ করে– এ-ই ছিল তার অভিলাষ। এইজন্যেই তিনি বিপ্লবী কবি।
এইরকম আর একজন মাত্র প্রতিভা বাঙলাদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। তাঁরও সাধনা ছিল বাঙালি হিন্দুকে উন্নত সমাজাদর্শ, ধর্মাদর্শ, রাষ্ট্রাদর্শ ও জাতীয়তাবোধ দান করা। সমাজাদর্শে দেবী চৌধুরাণী, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল এবং রাষ্ট্র ও জাতীয়তার প্রতীক তাঁর সীতারাম, আনন্দমঠ, রাজসিংহ প্রভৃতি উপন্যাস এবং অনুশীলন, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র প্রভৃতির দ্বারা তিনি ধর্ম-সংস্কারের প্রয়াসী হন। নজরুল ইসলামও অগ্নিবীণা, সন্ধ্যা, সর্বাহারা, সাম্যবাদী, বিষের বাঁশী, জিঞ্জির, ভাঙ্গার গান প্রভৃতি কাব্য; আমপারা, মরুভাস্কর প্রভৃতি গ্রন্থ এবং কোরবানী, মোহররম, ফাতেহা দোয়াজদহম আর আমানুল্লাহ, জগলুলপাশা, খালেদ, কামালপাশা প্রভৃতি ব্যক্তিত্বের প্রশস্তি দ্বারা একাধারে মুসলমান ও বাঙালি জাতির উন্নতি কামনা করে গেছেন। একদিক দিয়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে বড়। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু হিন্দুর কথা ভেবেছেন, প্রতিবেশী মুসলমানকে তিনি আপনজন ভাবতে পারেননি। স্বামী বিবেকানন্দও মুচি, মেথর, চণ্ডাল ভারতবাসীকে ভাই বলেছেন, কিন্তু মুসলমানকে ভাই বলে বরণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রও এ ত্রুটি থেকে মুক্ত নন। নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখেননি কখনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময়েও নয়। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে বাঙলার যমজ সন্তান বলেই জানতেন। বস্তুত সমগ্র বাঙলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামই একমাত্র লেখক–যিনি ভুলেও কখনো বিধর্মীকে বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ করেননি। পক্ষান্তরে বাঙলা সাহিত্যের প্রায় সব হিন্দু-লেখকের লেখায় অল্প-বিস্তর মুসলমান-বিদ্বেষ বা বিদ্রূপ প্রকাশ পেয়েছে।