যে করেই হোক, নজরুল পূর্ববাঙালিদের প্রিয় ও সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যাপারে প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন। সেজন্যেই নজরুল-কাব্যের চর্চা যত বেশি হয়, ততই মঙ্গল। তাঁকে বারোয়ারিভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের রেওয়াজ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের আজকের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনজিজ্ঞাসায় নজরুলের কাব্যের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক। যেজন্যে নজরুলের সগ্রাম, তা আজো আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে। নজরুলেরই সংকল্প–আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম-গণমানসে সংক্রামিত হোক।
নজরুলের কাব্যপ্রেরণার উৎস
কবি হতে হলে হৃদয়বৃত্তির বিশিষ্ট বিকাশ প্রয়োজন। এতে মন তীব্রভাবে অনুভূতিপ্রবণ ও স্পর্শচঞ্চল হয়ে উঠে। কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে এ বিকাশ পূর্ণমাত্রায় হয়েছিল। যে-বয়েসে মন শুধু গ্রহণ করতে থাকে এবং বিবেচনাহীন উচ্ছ্বাসে পরিচালিত হয়, সেই কিশোর বয়েসে কবি লড়াই-এর ময়দানে গিয়েছিলেন, দূর থেকে দেখেছিলেন বর্বরতার নির্লজ্জ অভিনয়, নিষ্ঠুরতার তাণ্ডব লীলা, পাশব-বৃত্তির নগ্ন আত্মপ্রকাশ, মানবতার অপমৃত্যু। জীবনের গ্লানি আর মৃত্যুর বীভৎসরূপ তাঁর কাছে প্রকট হয়ে ওঠে একান্তভাবে। এতে কবির অনুভূতিপ্রবণ স্পর্শচঞ্চল মন ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়। তার আত্মায় জ্বলে উঠল বিদ্রোহ, বিপ্লব আর মানবতাবোধের অপূর্ব দ্যুতিময় শিখা।
কবি ফিরে তাকালেন তাঁর দেশবাসীর দিকে। দেখলেন–সেখানেও দাসত্ব, দারিদ্র্য ও অশিক্ষায় মানোষের মুমূর্ষ আত্মা ধুকছে। কবির বিক্ষুব্ধ আত্মা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। মারমুখী হয়ে তিনি সংগ্রাম শুরু করলেন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বাহুবল তাঁর ছিল না; তাই শোষণ অনাচারের বিরুদ্ধে চলল বাণীর অভিযান :
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা
তাই লিখে যাই এ রক্তলেখা।
তার সে কী তীব্রতা! সে কী আশ্চর্য আবেগমুখরতা! ক্ষোভে, জ্বালায়, যুক্তির সারবত্তায়, বাচনভঙ্গির তীক্ষ্ণতায়, উচ্ছ্বাসের দুর্বার গতিবেগে সহস্র বজ্রনিনাদে তাঁর বাণীবর্শা নিপতিত হতে লাগল এটমবোমার মতো সমাজদেহে ও রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর। কবি উদাত্তকণ্ঠে সবিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন তার ব্রত :
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খঙ্গ-কৃপাণ ভীমরণভূমে
রণিবে না।
শুরু হল সংগ্রাম–আপোষহীন, বিরামহীন। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ লাভ-ক্ষতির খতিয়ান গেল তলিয়ে। একান্তভাবে ভালোবেসেছিলেন তিনি স্বদেশকে ও স্বজাতিকে। হিংসা, ঘৃণা, দ্বেষ ছিল না কারো প্রতি। কারো ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্যায়ের প্রতি তাঁর ছিল না নালিশ। তাঁর সংগ্রাম আদর্শগত; ব্যক্তি, রুচি বা স্বার্থগত নয়। তাই দেশের মানুষ নির্বিশেষকে তিনি ভালোবাসতে পেরেছিলেন হৃদয়-মন দিয়ে, দ্বিধাহীনচিত্তে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন ব্যক্তিজীবনের স্থলন-পতন-ত্রুটি। এইজন্যেই নারীপুরুষ, কৃষকমজুর, এমনকি বারাঙ্গনাকেও তিনি সমান উদারতায় মর্যাদা দিতে পেরেছেন। শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছেন মানুষ নির্বিশেষকে অকুণ্ঠচিত্তে।
পতিত স্বদেশ ও নির্যাতিত স্বজাতিকে ভালোবাসতে গিয়ে কবি বিশ্বের সমস্ত নির্যাতিত মানবতাকে ভালোবেসেছেন। স্বদেশ ও স্বজাতির জন্যে ফরিয়াদের হাত উঠিয়ে তিনি দাসত্ব, শোষণ ও অত্যাচার-জর্জরিত বিশ্বমানবের জন্যে আন্তরিকভাবে ফরিয়াদ জানিয়েছেন। এ কারণেই দুর্গত এশিয়ার সমস্ত অনুন্নত, পেষণক্লিষ্ট জাতির সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষায় সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত হতভাগ্য এশীয় জাতিগুলোর সবকটাই মুসলমান। তাই কোনো কোনো পাঠক সমালোচক তাকে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবাদী বা pan Islamism-এ বিশ্বাসী ঠাউরেছেন। আমাদের মনে হয়, তাঁদের এ বিশ্বাসে গলদ আছে, কেননা তাঁর মুসলিম দেশ ও বীর-প্রশস্তি বিষয়ক কবিতাগুলো মুসলিম প্রীতির চেয়ে দুঃখীর প্রতি সমপ্রাণতার পরিচয়ই যেন বেশি বহন করছে। যেমন–
ইরাকবাহিনী! এ যে গো কাহিনী
কে জানিত কবে বঙ্গবাহিনী
তোমারও দুখে জননী আমার
বলিয়া ফেলিবে তপ্তনীর?
পরাধীনা! এই একই ব্যথায় ব্যথিত
ঢালিল দু-ফোঁটা অশ্রু ভক্ত বীর। অথবা–
তাই
মিশরের নহে এই শোক
এই দুর্দিন আজি,
এশিয়া-আফ্রিকা দুই মহাভূমি
বেদনা উঠিছে বাজি।
অধীন ভারত তোমারে স্মরণ
করিয়াছে শতবার।
এরূপ আরো কবিতায় কবি এশিয়ার অনুন্নত দেশসমূহের নব-জাগরণে উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে স্বদেশীয়দের নিষ্ক্রিয়তার জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন;
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে হে ঋষি
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল।
চলিতেছে দিবানিশি।
অথবা
খররোদ পোড়া খর্জুর তরু তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর।
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা ভারতের বুকে নাই রুধির!
অপর কয়েকটা কবিতায় তিনি অন্যদেশের ন্যায় স্বদেশেও জাগরণ কামনা করেছেন :
জেগেছে আরব ইরান তুরান।
মরক্কো আফগান মেছের
এয় খোদা! এই জাগরণ রোলে।
এই মেষের দেশও জাগাও ফের।
অথবা
মলয় শীতল সুজলা এদেশে
আশিস করিও খালি–
উড়ে আসে যেন তোমার দেশের
মরুর দু মুঠো বালি!
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূলত আত্যন্তিক স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রেমের যে-অভিব্যক্তি বাণীরূপ লাভ করল, তা বৃহত্তর ক্ষেত্রে আচার, সংস্কার, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নক্লিষ্ট মানবসাধারণের মুক্তি-জেহাদের রূপ গ্রহণ করেছে। এ জেহাদ একাধারে ত্রিমুখী : বিদেশী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি-সগ্রাম, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কুৎসিত মনোভঙ্গির উৎসাদন প্রয়াস এবং ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি প্রচেষ্টা। এ-জেহাদে নজরুল অকপট মুহিদ ছিলেন। সংকল্পের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ছিল নিবিড়। যে-ব্ৰত তিনি হৃদয়-মন-বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করলেন, তার উদযাপন প্রচেষ্টায়ও তিনি উক্ত বৃত্তিনিচয়ের উদার ও অবাধ সহযোগিতা পেলেন। ফলে তার মুখনিঃসৃত বাণী জ্বালায়, দরদে, ভাবে, ভাষায়, ছন্দে, সুরে তীক্ষ্ণ-তীব্র মধুর হয়ে উঠেছে।