অতীন্দ্রিয়লোকে রবীন্দ্রনাথ [কবি-জীবনের শেষ পর্যায়]
০১.
রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভূমি ও ভূমার অনুভূতি সংমিশ্রণে এক অতীন্দ্রিয় লোকের সন্ধান পেয়েছেন। আমরা জানি রবীন্দ্র-প্রতিভারশ্মি বিচিত্র ধারায় হৃদয় ও মনের এবং জগৎ ও জীবনের আনাচে-কানাচে অলিতে-গলিতে প্রবিষ্ট হয়েছে; অদেখা-অজানা ও অভাবিত বিষয়ও তাঁর প্রতিভারশিপাতে উজ্জ্বল ও প্রত্যক্ষীকৃত হয়েছে।
কিন্তু পত্রপুট, ও সেকুঁতির পূর্বপর্যন্ত তিনি হৃদয় দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, intuition দিয়েই জগৎ ও জীবন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, হৃদয় ও মন, মানুষ ও প্রকৃতি এবং রূপ ও সৌন্দর্যের অন্তর্নিগূঢ় রহস্যাবিষ্কারে তৎপর ছিলেন। এ সময়কার বিশ্বমানবতা ও বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাত্মবোধ ছিল একান্তভাবে তাঁর হৃদয়াবেগপ্রসূত। তখন ছিলেন তিনি অনুভাবক, শেষজীবনে হলেন দ্রষ্টা। তখন তিনি হৃদয়, মন, বুদ্ধি দিয়ে করতেন অনুভব, শেষজীবনে করলেন প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে দর্শন। যা ছিল নিছক অনুভূতি, তা-ই হল উপলব্ধি। তখন বলেছেন :
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
এ সময় বলতে পারতেন–
দিঠি না জানি কেমনে গেল খুলি
ত্রিভুবন আবরণ করিছে খোলাখুলি।
আমরা সিন্ধু, বসুন্ধরা, প্রবাসীর কবি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি; সোনার তরী ও চিত্রা জীবনদেবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথকে জানি, গীতাঞ্জলি, গীতালি ও গীতিমাল্যের কবি অধ্যাত্মধর্মী রবীন্দ্রনাথের সাথেও আমাদের অপরিচয় নেই; রূপ, সৌন্দর্য ও প্রণয়ের কবি রবীন্দ্রনাথও অপরিচিত নন, জীবনবেত্তা ও মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘনিষ্ঠতাও বহুদিনের। কিন্তু এই বিশ্বানুভূতি, এই সৃষ্টি ও স্রষ্টায় যোগসূত্র সন্ধান, এই অধ্যাত্মসাধনা, এই জীবন ও প্রণয়ধর্মের রহস্য আবিষ্কার প্রভৃতির ভিত্তি ছিল জিজ্ঞাসা, হৃদয়াবেগ, বিস্ময়, বুদ্ধি ও intuition :
তবু জানি, অজানার পরিচয় আছিল নিহিত
বাক্যের আর বাক্যের অতীত
(জন্মদিনে–১২)
তখন : শুধু বালকের মন নিখিল প্রাণের পেত নাড়া
আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া
তাকায়ে রহিত দূরে।
রাখালের বাঁশির করুণ সুরে
অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে।
নাড়ীতে উঠিত নেচে।
(জন্মদিন—-৯৯)
সেজন্যে আমরা তখন তাঁকে সর্বদা বিস্মিত, সম্মোহিত, আনন্দিত, ব্যাকুলিত, বিচলিত অথবা ব্যথিত দেখতে পেতাম।
যিনি ছিলেন কল্পনা, আশা ও অনুভূতি-প্রদীপ্ত মহাসাধক, তিনিই শেষজীবনে হলেন জগৎ ও জীবনের রহস্যজ্ঞ ত্রিকালদ্রষ্টা মহর্ষি। তিনি এখন আর আশা-কাতর, শঙ্কা-ভীরু সাধক নন, বরং মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। শান্ত ও অবিচলিতভাবে তিনি কখনো ভূমার দিকে কখনো ভূমির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ : করেছেন, কখনো ধরার ধূলার হাসি-কান্নায় যোগ দিচ্ছেন, কখনো দ্যুলোকের অভিযাত্রী হচ্ছেন। তাঁর নিরাসক্ত ভারমুক্ত মন–জীবন, জীবন দেবতা, মৃত্যু প্রভৃতির রহস্যসূত্র আবিষ্কারের আনন্দে, সত্য-লাভের পরম তৃপ্তিতে এ লোকে ও লোকাতীতে আসা-যাওয়া করছিল।
যতই তিনি মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছিলেন ততই এই সুখ-দুঃখময় মানব-সংসারের নতুন রূপ, নতুন অর্থ এবং বিশ্ববিধাতার নিগূঢ় অস্তিত্ব ও তাঁর লীলা-বৈচিত্র্যের গভীরতর অর্থ এবং স্বীয় সত্তার রূপ, মৃত্যুর রহস্য তাঁর কাছে সুপ্রকাশিত হচ্ছিল।
সেই অজানার দূত আজি মোরে নিয়ে যায় দূরে,
অকূল সিন্ধুরে নিবেদন করিতে প্রণাম
সকল সংশয় তর্ক যে-মৌনের গভীরে ফুরায়।
(জন্মদিনে–১২)
জীবনের শেষপ্রান্তে উদাসীন শিবের মতো এই প্রজ্ঞা-দৃষ্টি কবির সাধনায় পরিণতি দান করেছে। তিনি বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা নিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন, আর প্রত্যয় ও তৃপ্তিতে তার জীবন সমাপ্তি পেয়েছে। আমরা বিশেষ করে তাঁর শেষ তিনটে কাব্য : রোগশয্যায়, আরোগ্য ও জন্মদিনের কথাই বলছি। কিন্তু আগে থেকেই এ আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। পত্রপুটের কাল থেকেই কবি ক্রমশ এই সুখ-দুঃখময় মানব- সংসারের গভীরতর সত্তার এবং বিশ্ববিধাতার নিগূঢ় অস্তিত্ব গভীরভাবে ও নতুনরূপে উপলব্ধি করছিলেন। তাই তার কাছে ভূলোক ও দ্যুলোকের পার্থক্য-ব্যবধান ঘুচে গিয়েছিল : এ-দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। এতে তিনি দেশহীন, কালহীন আদিজ্যোতির ধ্যান করবার সুযোগ পেলেন, সেই ধ্যানের দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা, এককথায় ভূমি ও ভূমার রহস্য অদ্ভুতভাবে উদঘাটিত হয়েছে।
.
০২.
কবি নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাত্মসাধনায় জগৎ-জীবনের সত্য আবিষ্কার করেননি, মানবচিত্তের সাধনাতেই তা সম্ভব হয়েছে।
মানব চিত্তের সাধনায়
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ।
সেই সত্য সুখ দুঃখ সবের অতীত
তখন বুঝিতে পারি,
আপন আত্মায় যারা।
ফলবান করে তারে।
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির;
একমাত্র তারা আছে, আর কেহ নাই।
(রোগশয্যায়-২৯)।
এ চিত্ত-সাধনায় চৈতন্য-জ্যোতি শুধু অন্তরে আবদ্ধ নয়, চরাচরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে (এই চৈতন্য-জ্যোতির নাম আত্মা) এবং তা জগৎ-রহস্য উদঘাটিত করে–
যে চৈতন্যজ্যোতি
প্রদীপ্ত রয়েছে মোর অন্তর গগনে,
নহে আকস্মিক বন্দী প্রাণের সংকীর্ণ সীমানায়
আদি যার শূন্যময়, অন্তে যার মৃত্যু নিরর্থক,
মাঝখানে কিছুক্ষণ
যাহা কিছু আছে, তার অর্থ যাহা করে উদ্ভাসিত।
এ চৈতন্য বিরাজিত আকাশে আকাশে
আনন্দ অমৃতরূপে
আজি প্রভাতের জাগরণে
এ বাণী গাঁথিয়া চলে সূর্য গ্রহ তারা
শৃঙ্খলিত ছন্দসূত্রে অনিঃশেষ সৃষ্টির উৎসবে।
(রোগশয্যায়-২৮)।