ব্যবসার বারো আনার অংশীদার সুধীর ঘোষকে এ ব্যাপারে সে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানালো না। তাদের ব্যবসায় কৃতিত্ব ভাগাভাগি করাটা রেওয়াজ নয়। তাছাড়া সুধীর ঘোষের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তার একটা চাপা বিরোধ চলেছে। জানলে ফোপরদালালী করবে। তারপর মেয়েটা যদি মনে ধরার মত না হয়, তাহলে ঠাট্টা-ঠিসারা করবে। কিন্তু কে জানে কেন, চিঠি পড়েই অলক বিশ্বাসের আশা, মনে ধরার মতই হবে মেয়েটা। তা যদি হয়, তাহলে সে-রকম শিকার ধরার বাড়তি প্রাপ্যও কম হবে না। অতএব পার্টনারের কাছে গোপন।
তারপরের ব্যাপারটা জল-ভাতের মত সহজে ঘটে গেল। উনিশশ সাতচল্লিশের শুরু সেটা। উদ্বাস্তুর চাপে শিয়ালদহ স্টেশন তখন নরক। কলকাতার বহু জায়গাই নরক।
ট্রেন থেকে নেমে স্মৃতি চেনা মুখ দেখল না। উদগ্রীব মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। আর দূর থেকে অলক বিশ্বাসের মনে হল–এই হবে। কিন্তু রূপ দেখে সে নিজেই হকচকিয়ে গেল প্রথম; ভরসা করে তক্ষুনি সামনে এগোতে পারল না। আরো খানিক বাদে নিঃসংশয় হয়ে ব্যস্তসমস্তভাবে তার কাছে এলো।–এক্সকিউজ মি, আপনি কি মিসেস স্মৃতি দত্ত?
স্টেশনের সেই নরকের মধ্যে চেনামুখ না দেখে স্মৃতি ভয়ানক উতলা হয়ে পড়েছিল। সাগ্রহে মাথা নাড়ল।
– সরি, আমার একটু দেরি হয়ে গেল আসতে। মিস্টার দত্ত মানে পরাশর দত্ত আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাই আসতে পারলেন না…চলুন।
বেশ অসুস্থ শুনে স্মৃতি ঘাবড়ে গেল–কী অসুখ?
–পেটের নিচের দিকে খুব যন্ত্রণা, চলাফেরা করতে পারছেন না। আপনি ঘাবড়াবেন না, আসুন।
চিন্তিত মুখে স্মৃতি তার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল।
অলক বিশ্বাসের জীবনে আজ ভাগ্যের সূর্যোদয় যেন। বারোআনার মালিক সুধীর ঘোষ রাত সাড়ে আটটার আগে আসবে না। সাড়ে আটটার পর বাবু এসে মালিকের আসনে জাঁকিয়ে বসে টাকা গোনেন। তার ওপর আজ কোনো টোপের আশায় চন্দননগর গেছে। আগে এসে হাজির হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভালোই হয়েছে। এ জিনিস দেখলে কিছুদিন অন্তত আর কাউকেই সে ধারে-কাছে ঘেঁষতে দিত না। ও নিজেই একটা রাঘব বোয়াল। আর একবার বেশ সুশ্রী এক শিকার ধরে আনার পর এক মাস পর্যন্ত নিজেই তাকে গিলে বসে থাকল। এভাবে ব্যবসা চলে!…জায়গায় গিয়েই অলক বিশ্বাস অচিন্ত্য সরখেলকে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানাবে। অঢেল টাকার মালিক অচিন্ত্য সরখেল। সরকারী-বেসরকারী মহলে তার প্রবল প্রতাপ। কখনো বিপদের গন্ধ নাকে এলে সে-ই তাদের ত্রাণকর্তা। মেয়েটাকে একবার তার কবলে ফেলে দিতে পারলে নিশ্চিন্তি। সুধীর ঘোষ তখন নো-বডি। অচিন্ত্য সরখেলের কাছ থেকে সে আজ মোটা কিছুই খসাতে পারবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
শৌখিন এলাকার অনেক ফ্ল্যাটের একটা বিশাল বাড়ির দোতলায় উঠে হেলথ ক্লিনিকের সাইন বোর্ড দেখল স্মৃতি। তাকে তিনতলায় নিয়ে এলো অলক বিশ্বাস। সুন্দর একটা সাজানো ঘরে এনে ঢোকালো। বাড়ির মধ্যে এটাই সাউণ্ড-প্রফ ঘর। বাইরে থেকে বা ভিতর থেকে গলা ফাটালেও দুদিকের কেউ শুনতে পাবে না।
তাকে বসতে বলে অলক বিশ্বাস বেরিয়ে গেল। পাঁচ মিনিট বাদেই এসে আবার খবর দিল, মিস্টার দত্ত গেছেন বেরিয়ামমিল এক্স-রে করাতে, তাই ফিরতে দেরি হবে। মিসেস দত্ত চা-টা খেয়ে রেস্ট নিন, চান-টান করুন, মিস্টার দত্ত ততক্ষণে এসে যাবেন।
বিভ্রাটের কথা শুনে স্মৃতির আবার মুখ শুকালো। বলল, আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন।
অলক বিশ্বাস সবিনয়ে বলল, কোন ডাক্তারের চেম্বারে গেছেন তিনি তাদের জানা নেই।
একটু বাদে বেয়ারা চা ইত্যাদি দিয়ে গেল।–তার চাউনিটা কি-রকম বিশ্রী লাগল স্মৃতির। চা খেতে খেতে ঘরটা দেখেও অবাক লাগল একটু। সুন্দর শয্যা পাতা, বসার শৌখিন আসবাব, ড্রেসিং টেবিল, টয়লেট সেট–সবই আছে, কিন্তু ঘরে কোন বাক্স বা স্যুটকেস বা জামা-কাপড়ের চিহ্নও নেই।…ভাবল, কোথায় কোথায় ঘোরে লোকটা, তাই এ-সব রাখার জায়গারও হয়ত ঠিক নেই।
ঘরের সঙ্গে সুন্দর বাথরুম। ক্লান্তি দূর করার জন্য বেশ করে চান করে নিল। দুপুরের দিকে সত্যিই বিচলিত সে। একলাই খেয়ে নিতে হল, বেলা তিনটে বেজে। যায়–লোকটার পাত্তা নেই।
রাত হওয়া পর্যন্ত তার দুশ্চিন্তার বিবরণ বাদ দেওয়া যাক। বিকেলে বহুবার ঘর থেকে বেরুতে চেষ্টা করে দেখেছে–বাইরে থেকে বন্ধ। চিৎকার করেও সাড়া মেলে নি।
তারপর নরক। শক্তিশালী একটা জঘন্য পুরুষের সঙ্গে দিশেহারার মত ধস্তাধস্তি করতে হয়েছে তাকে। লোকটা আধঘণ্টার চেষ্টায় কাবুই করে ফেলেছিল তাকে, হঠাৎ দাঁতে করে তার বাহুর মাংস প্রায় ছিঁড়ে নেবার উপক্রম করে কয়েক মুহূর্তের জন্য মুক্তি পেয়েছিল সে। আর্তত্রাসে এবার ছুটে এসে হ্যাণ্ডেল ঘোরাতেই দরজা। খুলে গেছল। এস্ত-বসনে আলুথালু অবস্থায় পাগলের মত নিচে ছুটল।
নিচের সাজানো আপিস-ঘরে তখন সুধীর ঘোষ বসে। চার আনার পার্টনার অলক বিশ্বাস সন্ধ্যে থেকে মনের আনন্দে অঢেল মদ গিলে কোথায় নিপাত্তা হয়ে আছে জানে না। এসে অন্য লোকের মুখে শুনেছে বড় জবর শিকার ধরে এনেছে পার্টনার আজ। এবং খানিক আগে অচিন্ত সরখেল সে-ঘরে গেছে।
সিঁড়িতে অস্ফুট কাতর শব্দ শুনে কান খাড়া হল তার।
সামনে একটা আপিস-ঘর এবং আলো দেখে উদ্ধারের আসায় আত্রাসে প্রচণ্ড বেগে দরজা টেনে স্মৃতি ভিতরে ঢুকল, বাঁচান!