মাথা নেড়ে রাজি হয়ে ঘরের বাইরে পা দিয়ে বাঁচলাম আমি। কমল গুহ আগে আগে চলেছে। এই মূহুর্তে আমার সব থেকে রাগ হচ্ছে ওর ওপর।
ওর আপিস-ঘরে আসার পর গম্ভীর মুখে হাসি দেখলাম। জিজ্ঞাসা করল, অক্ষত আছিস?
বললাম, তোর আসতে আর দুমিনিট দেরি হলে হার্টফেল করতাম। কী ব্যাপার?
নট এ ওয়ার্ড টু-ডে, আবার কাল।
সত্রাসে বলে উঠলাম, কাল আবার ওই ঘরে?
ও হাসতে লাগল, তুই একটা কাপুরুষ-ইজন্ট সী রিয়েলি চার্মিং?
পরদিন বিকেলে কমল আবার আমাকে ধরে নিয়ে গেল। কথা দিল, আজ আর আমাকে ফেলে ঘর ছেড়ে যাবে না। তাছাড়া আমারও কৌতূহল ছিলই।
আজ দ্বিতীয় প্রস্থ বিস্ময়। গতকালের পরিচয় মহিলার মনেও নেই। কমল বলল, আমার লেখক বন্ধু, আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। স্মৃতি গুপ্ত স্বাভাবিক মুখেই দুটি হাত জুড়ে নমস্কার করল, কি ভাগ্য, বসুন।
গলা খাটো করে কমল যেন আমি শুনছি না এইভাবে মহিলাকে বলল, লিখে আরো কত নাম করতে পারত ঠিক নেই, বাড়িতে বড় অশান্তি, বউয়ের সঙ্গে এক মুহূর্তের বনিবনা নেই…হয়ত ছাড়াছাড়িই হয়ে যাবে। বড় দুঃখের জীবন…
গতকালের বিপরীত দৃশ্য দেখলাম আমি। আমার দিকে মহিলা তাকলো একবার। আয়ত চোখে বিমনা ব্যথার ছায়া। প্রায় ফিসফিস করে কমলকে বলল, আ-হা! আমার কাছে এ-সব লোককে কেন আনেন বলুন তো, বড় মন খারাপ হয়ে যায়।
আজকের আলাপের মেয়াদ পাঁচ মিনিটও নয়। লেখার প্রসঙ্গেই দু-এক কথা জিজ্ঞাসা করল স্মৃতি গুপ্ত। আসার সময় শান্ত দুচোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, জীবনে শক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে পারাটাও কম কথা নয়, বুঝলেন…তখন দেখবেন সব বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ হয়ে গেছে। তারপর কমলের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, শুকনো দেখছি কেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে, না সে-সময়ও হয় নি?
হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে কমল আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।
সন্ধ্যার পর এক পেয়ালা কফি নিয়ে বসে কমলকে বললাম, এবারে কী আমাকেই তুই পাগল করে ছাড়বি? কৌতূহল আর কত সহ্য হয়?
পাইপ ধরাবার ফাঁকে কমল হাসল একটু। আমি প্রসঙ্গ বিস্তারের আশায় আবার বললাম, মহিলাকে বেশ শিক্ষিতা মনে হলো?
–হ্যাঁ, এম-এ পাশ।…তা বয়েসকালে দেখতে কেমন ছিল মনে হয়?
জবাব দিলাম, বয়েসকাল তো এখনো মায়া কাটাতে পারে নি মনে হল।
খুশি মুখে কমল মাথা নাড়ল। তারপর খুব চাছাছোলাভাবে একেবারে সংক্ষেপে যে ঘটনাটা ব্যক্ত করল, তাই শুনে আমি স্তম্ভিত।
***
স্মৃতি গুপ্ত ইউ-পিতে থাকত। সেখান থেকেই এম-এ পাস করেছিল। তার বাবা সেখানকার ডাক্তার। ছেলেবেলায় দুই-একবার বাংলা দেশ, অর্থাৎ কলকাতা দেখেছে।
ভারী এক সুপুরুষ স্মার্ট ছেলের প্রেমে পড়ল সে। নাম পরাশর দত্ত। সেই ছেলেরও কলকাতায় ব্যবসা–ডাক্তারি সরঞ্জাম আর পঙ্গু মানুষদের সরঞ্জাম সরবরাহ করে। নিজের হেলথ ক্লিনিক আছে।
পরাশর দত্ত যখন সেখানকার কলেজের ছোকরা, স্মৃতি গুপ্তর দিকে তখন থেকেই চোখ ছিল তার। কিন্তু স্মৃতি তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়িও ধরে নি। আলাপ ছিল, প্রেম বোঝার বয়েস তখনো সেটা নয়। কিন্তু খুব চৌকস মনে হত ছেলেটাকে তখন।
ভাগ্যের সন্ধানে পরাশর ইউ-পি ছাড়ল। আট বছর বাদে এই ইউ-পিতেই ব্যবসার কাজে এসে আবার যোগাযোগ। স্মৃতি তখন এম এ পড়ছে–সামনের বারে পরীক্ষা দেবে। আর পরাশর দত্তও তখন উঠতি অবস্থার মানুষ। দুজনে দুজনকে দেখে মুগ্ধ। স্মৃতিকে দেখে মুগ্ধ তখন অনেকেই। কিন্তু পরাশর আসাতে সকলে বরবাদ হয়ে গেল। ব্যবসার কাজে ঘন ঘন বার-দুই-তিন ইউ-পি আসার ফাঁকেই তাদের প্রেম জমাট বেঁধে গেল। তারপর বিয়ে।
স্মৃতির জীবনের সব থেকে সেরা কটা দিন কেটে গেল। পরাশর কলকাতায় ফিরল। স্মৃতি ছমাস বাদে এম-এ পাস করার পর তাকে নিয়ে যাবে। তখন পরাশর থাকে কলকাতার এক নামকরা হোটেলে। সেখানকার ঠিকানা হিসেবে একটা পোস্ট-অপিসের নাম লিখে দিল সে। তার চিঠিপত্র সব ওই পোস্ট-অফিসের কেয়ারে যায়। ব্যবসার তাগিদে প্রায় সমস্ত ভারতবর্ষেই ঘুরতে হয় তাকে–কখন থাকে না। থাকে ঠিক নেই। হোটেলের চিঠি মারা যায় বলে এই ব্যবস্থা।
এর পরের খানিকটা অংশ জানা গেছে পুলিশের রিপোর্ট থেকে।…অলক বিশ্বাস নামে একটা লোক সেই পোস্ট-অফিসে এসেছিল তাদের ব্যবসার অথবা সুধীর ঘোষের নামে চিঠিপত্র কী আছে সংগ্রহ করতে। পোস্ট-অফিসের লোক তাকে চেনে, সুধীর ঘোষের অনুপস্থিতিতে সেই এসে চিঠিপত্র নিয়ে যায়।
ব্যবসা এবং সুধীর ঘোষের নামে একগোছা চিঠিই ছিল। অলক বিশ্বাস দেখল তার সঙ্গে পরাশর দত্ত নামে একজনের একটা খাম ভুল করে এসে পেছৈ। খামের ওপরে মেয়েলি হাতের লেখাটা বড় সুন্দর মনে হল তার। বাইরে এসে খামটা খুলল। লিখেছে স্মৃতি নামে এক মেয়ে। বেশ চাপা উচ্ছ্বাসের ঝকঝকে চিঠি। বেশিদিন বিয়ে হয় নি বোঝা যায়।–নিজের এম-এ পাশের খবর দিয়েছে। তারপর লিখেছে, ওমুক দিন ওমুক গাড়িতে কলকাতা আসা স্থির করেছে। ছোট ভাইয়ের পরীক্ষা সামনে, তাই একলাই রওনা হতে হবে। চিঠির শেষ, পত্রপাঠ প্রাপ্তিসংবাদ পেলে আমি নিশ্চিন্ত মনে রওনা হব। তুমি অবশ্যই ঠিক সময়ে স্টেশনে থেকো। জ্ঞান-বয়সে তো কলকাতা দেখি নি, ট্রেন থেকে নেমেই তোমার মুখখানা না দেখতে পেলে তালকানা হয়ে যাব।
অলক বিশ্বাস তিন দিন বাদে স্মৃতি দত্তর ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাম পাঠালো। পরাশর যখন দত্ত, স্মৃতিও তখন দত্তই হবে। টেলিগ্রামের বয়ান ও স্টার্ট-পরাশর।