ভিতরে ভিতরে যাতনার মত একটা তাগিদ অনুভব করত রমা। সাধারণ মেয়ের অসামান্য হয়ে ওঠার তাগিদ। ভিতরটা যেন একটা জ্বলন্ত অঙ্গার হয়ে উঠছে তার, আর এই তাগিদ বাড়ছে।
আগে স্কুল-মাস্টারির চেষ্টা করছিল, এখন সে চেষ্টা ছেড়ে দিল।
এই অবস্থার মধ্যে হঠাৎ এক নামজাদা চিত্রপরিচালকের নামে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল একটা। নায়িকার ভূমিকার জন্যে একজন শিক্ষিতা অভিনেত্রী চাই। ফোটোসহ আবেদন করতে হবে।
মাথায় একটা ঝোঁকই চাপল রমার। নতুন করে নিজের ছবি তুলিয়ে আবেদন। পাঠিয়ে দিল।
অসামান্য হবার যোগ্যতা ছিল রমা মিত্রের। ডাক এসেছে। কথা বলে আর ছাত্রজীবনের অভিনয়ের মেডেল দেখে পরিচালক খুশি একটু। ট্রায়েল দিয়ে আরো খুশি। চমৎকার ফোটোজনিক মুখ, সুন্দর বয়েস, নাক মুখ চোখ ভালো–তার ওপর অভিনয়ে বুদ্ধিদৃপ্ত সহজ দক্ষতা আছে। আশাতীত পছন্দ হল তার।
.
রমা মিত্র মরে গেল। ছবিতে এক মালবী মিত্রের আবির্ভাব দেখল সকলে। প্রথম। ছবিতে এমন বিপুল বন্দনা কম নায়িকার ভাগ্যেই জুটেছে।
তারপর এই দুবছরে দিনে দিনে তার আবির্ভাব স্থায়ী হয়েছে, উজ্জ্বলতর হয়েছে। আজ মালবী মিত্র একটা নাম। সে অসামান্যা। তার নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই।
কটা ছবির কাজ একসঙ্গে শেষ হতে মালবী একটু হাঁপ ফেলেছিল। নতুন কোন কোন ছবি হাতে নেওয়া যেতে পারে ভাবছিল। ধরছে তো এসে কতজনই। বম্বে থেকে ডাক এসেছে, তাতেও সাড়া দেবে কিনা চিন্তা করতে হবে।
এমন দিনে প্রশান্ত ঘোষ এসে হাজির। সারদার হাতে চিরকুট দেখেও নির্বাক খানিক। সেই পুরনো জ্বালা আর অনুভূতিটা নতুন করে আবার মাথার দিকে উঠছে। প্রথমে ভাবল সারদাকে বলে দেয়, দেখা হবে না বলগে যা। কিন্তু তা বলল না। বলল, এখানে নিয়ে আয়।
নিয়ে এলো। সেই মুখ, সেই পুরু কাঁচের চশমা, ঠোঁটের ডগায় সেই কাঁচা হাসি। দেখামাত্র রাগে সর্বাঙ্গ চিনচিন করে উঠল ভেতরটা।
প্রশান্ত দুচোখ ভরে দেখল তাকে খানিক।-কেমন আছ রমা?
রমা আবার কে, আমি তো মালবী! মালবী মিত্র!
প্রশান্ত হেসে উঠল, কি ফ্যাসাদেই যে ফেলেছিল এই নাম নিয়ে–যাকে সকলে চেনে তাকে কেউ চেনে না! বাইরে থেকে ফিরে এই একটা মাস হন্যে হয়ে খুঁজেছি তোমাকে। শেষে সুমিতার কাছে শুনলাম তুমি এখন উজ্জ্বলতম তারকা মালবী মিত্র। ..বিলেত থেকেও তোমাকে কত যে চিঠি লিখেছি, জবাব না পেয়ে শেষে হাল ছেড়েছি।
…বাড়ি ছেড়েছিল তাই চিঠি পায়নি৷৷ পেলেও জবাব দিত না। চোখে চোখ রেখে মালবী চেয়ে আছে।একা ফিরেছ না মেম-বউকেও এনেছ?
প্রশান্ত অবাক।–মেমবউ!
ভিতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন। এমন নির্লজ্জও মানুষ হয়! ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাদের কাঁধে হাত রাখা যুগল ছবি আমি দেখেছি, আর তোমার মাকে লেখা তোমার সেই চিঠিও আমি পড়েছি।
প্রশান্তর দুচোখ বিস্ফারিত প্রথম। তারপরেই হা-হা হাসি।–সে-সব তুমিও কি বিশ্বাস করেছ নাকি? কি আশ্চর্য! আমার প্রত্যেকবারের প্ল্যান তুমি বাতিল করেছিলে–তাই বিলেতে গিয়েই বাবাকে জব্দ করার মোক্ষম প্ল্যান ফেঁদেছিলাম। বাবার ওপর আমার তখন দুনিয়ার সব থেকে বেশি রাগ–আর কাঁধে হাত রেখে ছবি তোলার মত অন্তরঙ্গতা ও-দেশে একটু চেষ্টা করলেই হয়।
মুহূর্তের মধ্যে এ কি হল মালবীর? মাথাটা এমন প্রচণ্ডভাবে ঝিমঝিম করে উঠল কেন? তার অস্তিত্ব সুদ্ধ এভাবে নড়েচড়ে উঠল কেন? প্রাণপণে এই কথাগুলো ভণ্ডামী ভাবতে চেষ্টা করল কেন? আর ঘরে এত আলো, অথচ সামনে রাজ্যের অন্ধকার ভিড় করে আসছে কেন?
প্রশান্তও বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।
প্রাণপণ চেষ্টায় মালবী সামলে নিল নিজেকে।–বিশ্বাস করতে বলছ?
কী আশ্চর্য, আমি বলছি তাও বিশ্বাস করবে না?
মালবী দেখছে তাকে। অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।–তারপর?
তারপর আবার কি, এবারে বিয়ে। বাবা তো আর নেই, আর মায়ের যা অবস্থা, তোমাকে ঘরে আনতে পারলে বাঁচেন।
বসার চেয়ারটা, মাটি, বাড়িঘর যেন দুলছে মালবীর চোখের সামনে। তবু হাসি মুখেই বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু আমি যে অভিনেত্রী হয়েছি!
মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশান্ত বলল, কথা যদি রেখে থাকো, মানে আমার জন্যে প্রতীক্ষা যদি করে থাকো, তাহলে আর কোন কিছুতে যায় আসে না।
চেয়ার মাটি ঘর দুয়ার আর একবার বিষম দুলে উঠেছে। তারপর মালবী হেসেছে। নিজের জরুরী অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে পড়েছে। কাজের চাপে আপাতত মরবার ফুরসৎ নেই বলেছে। বলেছে, মাথায় কোনো কথা ঢুকছেই না এখন। তিন দিন বাদে তাকে আসতে বলেছে। তখন কথা হবে।
কিছু একটা ব্যতিক্রম অনুভব করেই প্রশান্ত লক্ষ্য করেছে তাকে। তারপর তিনদিন বাদে আসবে জানিয়ে উঠে চলে গেছে।
তিনদিনের মধ্যে দুরাত এক মিনিটের জন্যেও মালবী ঘুমোয়নি। আজ তার পালাবার তাগিদ।
কারণ সে তার মন দিয়ে বুঝেছে, প্রশান্ত এক বর্ণও মিথ্যে বলেনি।
তার কারণ, মালবী তার জন্য প্রতীক্ষা করেনি।…অসামান্য হয়ে ওঠার দুর্বার তাগিদে তার যৌবন-বাস্তবে একাধিক পুরুষের অভ্যর্থনা ঘটে গেছে। মালবী এতটুকু পরোয়া করেনি।
অন্ধকার বিদীর্ণ করে ট্রেন ছুটেছে। আলোয় পৌঁছুবে। কিন্তু মালবী ছুটেছে তেমনি অন্ধকারে নিজেকে মিলিয়ে দেবার তাড়নায়।
রমা মিত্রর ভস্ম থেকে একদিন মালবী মিত্র উঠে এসেছিল। আজ মালবী মিত্র ভস্ম হয়ে গেলেও এ জীবনে আর রমা মিত্রের হদিশ মিলবে না।
স্মৃতি যদি ফেরে
কমল গুহ আমার সহপাঠী ছিল আর প্রতিবেশী ছিল। সেই নরম বয়সে দিনের মধ্যে বেশ কয়েক ঘন্টা ওকে আটকাতে না পারলে দিনটাই জলো ঠেকত। উঁচু-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। পড়াশুনায় আমাদের পাঁচজনের থেকে অন্তত ঢের ভালো। তবু ওর জ্ঞানগম্যি সম্পর্কে আমাদের বরাবরই একটা কৌতুককর সংশয় ছিল।