সামনের গাছটার দিকে তাকিয়ে কাব্যই করল প্রশান্ত। বলল, আমি যদি গাছ। হতাম, আর তুমি ওই লতার মত আমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে, বেশ হত।
রমা তক্ষুনি তার কাঁধে গা ঠেকিয়ে আর একটা হাতে তার গলা বেষ্টন করে বলল, লতা হবার দরকার কী, এই তো জড়িয়ে থাকলাম।
সেদিন ওই ঠাণ্ডা মানুষটার রক্তে কেন যে অত দোল লাগল রমা জানে না। এরকম তো আগেও হয়েছে। আগেও কাছে টেনে নিয়েছে। দুই উষ্ণ ঠোঁটের আবেগ ওর অধরের বাধা বিচূর্ণ করেছে। কিন্তু এই দিনের তৃষ্ণার মূর্তিটাই অন্যরকম। ওর দেহটা যেন ক্রমে একটা আবিষ্কারের বস্তু হয়ে উঠতে লাগল। নিবিড় নিষ্পেষণে সর্বাঙ্গে কী রকম একটা যন্ত্রণার শিহরণ, রমা যেন কোথা থেকে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে!
হঠাৎ ওকে দুহাতে ঠেলে দিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল সে। বিস্রস্ত বসন ঠিক করতে করতে ধমকের সুরে বলে উঠল, এই!
একটা ভুত নামল যেন প্রশান্তর কাঁধ থেকে। আত্মস্থ, বিব্রত।–কি?
রাক্ষুসেপনা কোরো না, সময় ফুরিয়ে গেল নাকি!
.
কিন্তু শিগগীরিই একটা ধাক্কা খেয়ে দুজনেরই মনে হল সময় ফুরিয়ে গেল বুঝি। প্রশান্তর সঙ্গে তার বাবার মুখোমুখি একটা সংঘাত হয়ে গেল এক বড়লোকের বাড়ির মেয়ে দেখতে যাওয়া নিয়ে। খুব বিনীত আর খুব স্পষ্ট ভাবে প্রশান্ত এবার বাবাকেই জবাব দিয়েছে, তার দেখতে যাওয়া সম্ভব নয়, এবং কারোরই না যাওয়া ভাল।
প্রাথমিক ঝড়টা প্রশান্তর উপর দিয়ে গেল। তারপর ভেবেচিন্তে ভদ্রলোক রমার বাবাকে ডেকে পাঠালেন একদিন। রমার বাবা এলেন।
প্রশান্তর বাবা রূঢ়মুখে জানতে চাইলেন, মেয়ের বিয়েতে তিনি কী করতে পারবেন?
রমার বাপ জবাব দিলেন, আপনি চাইলে শুধু বিয়েই দিতে পারব, আর কিছু করার সঙ্গতি নেই।
তপ্ত বক্রস্বরে প্রশান্তর বাবা বললেন, সেটা কি বেশী আশা করা হচ্ছে না?
রমার বাবা জবাব দিলেন, এর মধ্যে আমার কোন হাত নেই।
আপনার মেয়েকে বোঝাবার হাত বা দায় আমার?
আপনার ছেলেকে বোঝাবার হাত বা দায় আপনার।
নিঃস্ব লোকের এই উক্তিতে প্রশান্তর বাবা অপমানিত বোধ করলেন। আর আসল অপমানিত মানুষটি নিঃশব্দে উঠে গেলেন।
সব শুনে রমা রাগে জ্বলতে লাগল। বাবা ওর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নিয়ে ও-বাড়ি থেকে ফেরেননি। তবু বাবার অপমান ওকে মর্মান্তিকভাবে বিধল। ঘরে মা নেই-ভাইবোনদের কাছে বাবা অনেকখানি।
ওদিকে এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রশান্তর বাবা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ছেলেকে কলকাতা থেকে আপাতত সরাতে না পারলে এ মোহ কাটবে না, তাই বোম্বেতে বড় ছেলের সঙ্গে এ নিয়ে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান চলছিল। রমার বাবার সঙ্গে কথা হবার পনের দিনের মধ্যে হেড-অফিস অর্থাৎ বম্বেতে পত্রপাঠ। বদলির অর্ডার পেল প্রশান্ত। সেটা যে দাদারই চেষ্টার ফল, বুঝতে কারো বাকি থাকল না।
এ খবরও রমা শুনল প্রশান্তর মুখ থেকেই। শোনার পর গুম সে। একটু বাদে বিরস মুখে জিজ্ঞাসা করল, বম্বে যাচ্ছ?
তুমি কী বলো, চাকরি ছেড়ে দেব?
আবার একটু চুপ করে থেকে রমা বলল, না, যাও।
প্রশান্ত অসহিষ্ণু, উতলাও।
তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? সব তো জানো, আমার কী দোষ? তাছাড়া এই করে বাবা বা দাদা বা দুনিয়ার কেউ আমাদের আটকাতে পারবে?
পারবে না?
পাগল! এক বছরে হোক, দু বছরে হোক, পাঁচ বছরে হোক–বিয়ে আমাদের হবেই। যতদিন না হয়, আমার প্রতীক্ষায় তুমি থাকবে, তোমার প্রতীক্ষায় আমি থাকব।
সত্যি?
সত্যি।
সত্যি?
সত্যি সত্যি সত্যি। মুখের দিকে চেয়ে থেকে প্রশান্ত বিষণ্ণ মুখে হাসল একটু, কিন্তু আমাকে এখনো তুমি বিশ্বাস করলে না!
বিশ্বাস করলাম না?
প্রশান্ত মাথা নাড়ল, না।
দরদে রমার ভিতরটা ভরে গেল। দুহাত বাড়িয়ে তার মাথাটা বুকে টেনে আনল। বলল, বিশ্বাস করেছি। তুমি আমার অপেক্ষায় থাকবে, আমিও তোমার প্রতীক্ষায় থাকব।
তিন দিনের মধ্যে প্রশান্ত বম্বে চলে গেল। আর তিন মাসের মধ্যে তার চিঠি পেল লণ্ডনগামী জাহাজ থেকে। সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে সে সাগর পাড়ি দিচ্ছে! রমা যেন প্রতীক্ষায় থাকে।
এই সবই ঘটে গেল রমা এম. এ. পাশ করার ছমাসের মধ্যে।
আর আরো দুমাস বাদে রমার মাথায় বুঝি বাজ পড়ল একটা। খবরটা দিল সুমিতা। তার অনেকদিন বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখা। কথায় কথায় বলল, বিলেত গিয়ে প্রশান্তদা মেম বিয়ে করেছে, শুনেছিস?
রমা চমকে উঠল। তারপর অবিশ্বাস করল। বিশ্বাস করবে কী করে–মাত্র তিন সপ্তাহ আগেও সে প্রশান্তর আবেগভরা চিঠি পেয়েছে। তার এত অবিশ্বাস দেখেই পরে সুমিতা মাসির বাড়ি গিয়ে একখানা ছবি আর মাকে লেখা প্রশান্তর নিজের হাতে লেখা চিঠি নিয়ে এলো। তাদের বাড়িতে নাকি হুলুস্থুল ব্যাপার চলেছে সেই থেকে।
অবিশ্বাসের আর কিছু নেই। এক তরুণী শ্বেতাঙ্গিনীর বাহু বেষ্টন করে প্রশান্ত দাঁড়িয়ে। দুখানি হাস্যোজ্জ্বল মুখ। চিঠিতে লিখেছে, তোমরা আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না জানি, পারো তো আমাদের আশীর্বাদ করো।
এরপর দিনকয়েক পর্যন্ত রমার মাথায় শুধু আগুন জ্বলেছে।
এদিকে রমার বাবাও কিছু ঝামেলার মধ্যে ছিলেন, বাড়ি ছাড়ার কেস চলছিল বাড়িঅলার সঙ্গে। প্রতিপক্ষ ডিক্রি পেয়েছে, তিনমাসের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার হুকুম হয়েছে। তার মধ্যে মেয়ের এই আঘাত। একমাসের ছুটির দরখাস্ত করে ভদ্রলোক ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। আর তারপর ফিরে এসে অন্যত্র উঠলেন।