বাবার হুমকির খবরটা সেদিনই রমাকে দিল সে। এই গুণটা আছে। নিজের সমস্যাটা দুজনের সমস্যা ভাবে। তাই সব কথাই রমাকে বলে। শোনামাত্র দুচোখ কপালে–সর্বনাশ! তাহলে?
ঠোঁট উল্টে প্রশান্ত জবাব দিল, সর্বনাশ আবার কি, ও-সব পুলিশী দাপটে দেশের স্বাধীনতা ঠেকানো গেছে?
রমা বলল, দুটো এক হল! তাতেও তো কত লোকে জীবন দিয়েছে।
আমিও তো একজনকে আমার জীবন দিয়েছি।
কী ভালো যে লেগেছিল শুনতে রমাই জানে। সেদিন সন্ধ্যার আড়ালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কোণের চত্বরে বসে দুজনে যত কাছাকাছি হয়েছিল এর আগে ততটা আর কখনো হয়নি। সেদিন রাতে ভালো ঘুমুতে পারেনি রমা। দুটো ঠোঁটের সেই ঘন আবেগের স্পর্শ সমস্ত রাত ধরে তার সর্বাঙ্গে আবেশ ছড়িয়েছে আর বিহ্বল করেছে।
এমন অদ্ভুত ছেলেমানুষি প্রস্তাবও করে মানুষটা যে রমা হেসে বাঁচে না। সেদিন। ওর বাবার হুমকির প্রসঙ্গেই রমা বলেছিল, কিন্তু আমার বাপু সত্যি কেমন ভয় করছে!
প্রশান্ত তক্ষুনি বলেছিল, আমারও করছে।
তাহলে?
তাহলে চলো পালাই দুজনে। কিন্তু বাবা যা লোক, ঠিক আবার ধরে আনবে।
তাহলে?
তাহলে আর এক কাজ করা যাক। চলো কোন সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে যাই, মন্ত্রের জোরে তারা বাবার মন বদলে দিক।
রমা হেসে উঠেছিল। তারপর বলেছিল, বিয়েটা হয়ে গেলে মন আমিই বদলে দিতে পারি বোধহয়।
প্রশান্ত সাগ্রহে বলে উঠেছিল, তাহলে তাই করে ফেলি এসো। রেজিষ্ট্রি বিয়ে করে সোজা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
ও বাবা! রমা আঁতকেই উঠেছিল, তোমার বাবার সামনে?
এরকম উদ্ভট উদ্ভট অনেক প্রস্তাব করে সে। কখনো বলে বাড়ি গিয়ে মাকে শাসাবে, এ বিয়ে না দিলে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। কখনো ভাবে মাকে শেখাবে, এ বিয়ের জন্য ইষ্টদেবার স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছে সেই গোছের কিছু ভাঁওতা দিয়ে বাবাকে বশ করতে।…সেদিন তো এমন মোক্ষম প্ল্যান মাথায় গজালো তার যে আপিস ফেলে রমাদের বাড়িতে এসে হাজির। রমার য়ুনিভার্সিটি ছুটি সেদিন। চুপি চুপি তাকে বাইরে টেনে আনল। সাগ্রহে বলল, তোমার সাহসে কুলোলে এবার আর কেউ আটকাতে পারবে না–পারবে?
সত্যি তেমন কিছু আশা করেছিল রমা। কী করতে হবে?
দু তিনদিনের মধ্যেই দুজনে পালাব আমরা।
এ তো পুরনো প্রান!
আঃ! আগে শুনোই না, তার কয়েকদিনের মধ্যে কাগজে চিঠি পাঠাব আমরা মানে ওমুক মেয়ে আর ছেলে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছে, ব্যস!
রমার দুচোখ বিস্ফারিত। কী ব্যস, কাগজে খবর পাঠিয়ে আমরা আত্মহত্যা করব?
দূর পাগল, আমরা বিয়ে করব–সকলে জানবে আমরা আত্মহত্যা করেছি!
আস্ত পাগল তুমি! আচ্ছা স্কলারশিপ পেলে কী করে? অত ভালো এনজিনিয়ারিং পাসই বা করলে কী করে?
কেন?
— উড়ো খবর কাগজে ছাপবে কেন?
দুজনে একসঙ্গে ছবি তুলে কাগজে পাঠিয়ে দেব বাইরে থেকে–এই দুজন আত্মহত্যা করেছে–অন্য লোক খবর পাঠিয়েছে।
আত্মহত্যা করলে আমাদের বডি যাবে কোথায়? পুলিস চুপ করে বসে থাকবে? আমাদের টেনে বার করবে না? তখন আত্মহত্যাই করতে হবে!
এমন প্ল্যানটাও বাতিল হয়ে যেতে প্রশান্ত বিমর্ষ। রমা না থাকলে সে যে এতদিন একটা কিছু চমকপ্রদ বিভ্রাট বাঁধিয়ে বসত তাতে সন্দেহ নেই।
রমা এম.এ. পাশ করার পর দুজনেই অনেকখানি বেপরোয়া হয়ে উঠল। ওদিকে প্রশান্তর ছোড়দার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা তখন কৃতী ছেলের বিয়ের তোড়জোড় করছেন। প্রশান্ত স্পষ্টই তার মাকে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে কোথায় করবে। তার ফলে বাপ আগুন, মাও অসন্তুষ্ট। বাড়িতে অশান্তি। বাবাও ঘোষণা করেছেন, অবাধ্য হলে ছেলের সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকবে না।
রমা এম.এ. পাস করার পর প্রশান্ত জিজ্ঞাসা করল, এবার?
রমা জবাব দিল, এবারে চাকরি।
কী চাকরি? কোথায় চাকরি?
স্কুলে স্কুলে-মাস্টারি ছাড়া আমি কী আর পেতে পারি?
খবরদার!
বা রে, তাহলে কি করব? বাবা আর কতকাল টানবেন?
খপ করে তাকে কাছে টেনে প্রশান্ত বলেছে, বাবা কেন, আমি টানব।
রমা হেসে ফেলেও ভ্রূকুটি করেছে–বিয়ের আগেই?
প্রশান্ত ভেবে-চিন্তে বলেছে, না, চোখ-কান বুজে এবারে বিয়েটাই আগে করে ফেলা যাক। কী আর হবে, বাপ মেরে ফেলতে তো আর পারবে না, বড়জোর আলাদা করে দেবে।
কিন্তু রমার মনে সায় দেয় না। কারণ অভিশাপ দিয়ে ঘর বাঁধবো কেমন করে?
ছুটির দিনে বেশ সকাল সকাল এক এক দিকে বেরিয়ে পড়ে দুজনে। কখনো ব্যাণ্ডেল, কখনো কাঁচড়াপাড়া, কখনো বা গঙ্গার বুকে ডিঙি নৌকায়। আর সমস্যার সমাধান কেমন করে হবে তাই ভাবে দুজনে। বিশেষ করে নির্জন বন-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে দুজনেরই। সেই নির্জনতার একটা ভাষা আছে। হাত ধরা ধরি করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগোয় দুজনে। গাছের ছায়ায় ঘন হয়ে বসে। দুপুরে পাখির অলস ডাক কান পেতে শোনে। সমস্যা-টমস্যা সব দুজনেরই ভুল হয়ে যায় তখন।
রমা একদিন ঝগড়া টেনে আনে।-তুমি আমাকে ভালোবাস না ছাই, আসলে চিত্রাঙ্গদা পছন্দ তোমার!
তুমি তো চিত্রাঙ্গদা।
আমি রমা। তবে চিত্রাঙ্গদার মত কুৎসিত বটে
চিত্রাঙ্গদা কুৎসিত?
না তো কি?
তাহলে তুমি একটি অন্ধ, ভেতর দেখতে জানো না।
কথাগুলো যেন কান পেতে আস্বাদন করার মত। রমার অনেকদিন মনে হয়েছে লোকটা এনজিনিয়ার বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কবি। শুধু কবি নয়, একেবারে অবুঝ কবি।