প্রশান্ত জবাব না দিয়ে চুপচাপ মুখের দিকে চেয়েছিল। সেই পুরু দুটো কাঁচ, তার ওধারে সেই ডাগর দুটো চোখ, সেই রকমই একমাথা ঝাকড়া চুল। কে বলবে
এই মানুষ একটানা সাত বছর বিদেশের মাটি চষে, মস্ত মস্ত চাকরি করে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছে। মালবী এই মুখ আর এই চাউনি দেখে ভাবতে পারো বড় জোর সাত মাস দেখেনি মানুষটাকে।
চুপচাপ ওই রকম খানিক চেয়ে থেকে প্রশান্ত বলেছিল, আচ্ছা, তিন দিন পরেই আসব তাহলে। তক্ষুণি উঠে দাঁড়িয়েছিল।
হ্যাঁ, এসো, রাগ করলে না তো? ঠিক এসো কিন্তু
ট্রেনের রিজার্ভ কামরার পুরু গদীতে ঠেস দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে। মালবী। বাইরের গাঢ় অন্ধকারের পাতাল ছুঁড়ে ট্রেন ছুটেছে। ওটা আলোয় পৌঁছুবে। কিন্তু মালবী কোথায় ছুটেছে? সে অন্ধকার খুঁজছে। কোনো অস্তিত্বগ্রাসী অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবার তাড়না তার। কিন্তু এমন জায়গা আছে কি…।
সামনের বার্থে অঘোরে ঘুমচ্ছে সারদা। ঝি ঠিক নয়, তার থেকে বয়সে বছর বারো বড় সহচরী বলা যেতে পারে, যে তার ঘর সামলায়। মনিবানীকে হঠাৎ এ ভাবে পড়িমরি করে বেরিয়ে পড়তে দেখে সে ততো অবাক হয়নি যত অবাক হয়েছে। টানা দুটো দিনের থমথমে মুখ দেখে। এত হাসি-খুশি যেন কোথায় উবে গেল! তারপর আজই হঠাৎ হুকুম, বেরুতে হবে। কোথায় যেতে হবে, কতদিনের মধ্যে যেতে হবে না জেনেই তড়িঘড়ি সব গোছগাছ করে নিতে হয়েছে। তা সহৃদয়া মনিবের এই গোছের খেয়ালের ধকল তাকে অনেক সামলাতে হয়। তাই আর থমথমে মুখের কারণ নিয়ে সে বিশেষ মাথা না গামিয়ে তোফা আরামে নিদ্রা দিয়েছে।
একবার তাকে দেখে নিয়ে অবসন্নের মত আবার বাইরের দিকে ফিরল মালবী মিত্র।
…সাত বছর বাদে প্রশান্ত এসেছিল কোনো একদিনের এক সাধারণ মেয়ে রমা মিত্রের কাছে। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলেছে এক অসাধারণ মেয়ে মাধবী মিত্র। যার তুলনা নেই। যার দর্শন পেলে বহু রসিকজন ভাগ্য মানে। খ্যাতির বিড়ম্বনায় যে মালবী মিত্র সর্বসাধারণের নাগাল থেকে বিচ্ছিন্ন-মিনিট চল্লিশ সে মাধবী মিত্র কথা বলেছিল প্রশান্তর সঙ্গে। রমা মিত্র নয়…প্রশান্ত কি তা বুঝেছে? বুঝে গেছে? বোঝার কথা, কিন্তু মালবী সেই মুখের দিকে চেয়ে নিঃসংশয় হতে পারেনি। শুধু তাই নয়, কথা বার্তায়, বিস্ময় আর হাসি-খুশির ফাঁকে মালবী তাকে প্রকারান্তরে এও বোঝাতে চেষ্টা করেছে, সাত বছর বাদে লোকটা এসে যে-কথা বলছে তার মধ্যে অবিশ্বাস অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। কিন্তু লোকটা এও বুঝেছে কিনা সন্দেহ…রমা মিত্র নয়, আপন। মহিমায় বিকশিত এক মালবী মিত্র তাকে বলেছে আপাতত দিন-তিনেক তার মরবার ফুরসত নেই, তিন দিন পরে যেন আসে। প্রশান্ত বলেছে তাই আসবে।
..এই রাতটা পোহালে তিনটে দিনের অবসান। কালই বিকেলের দিকে প্রশান্ত আবার আসবে। ঢোকবার সময় বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ দেখে একটু অবাক হবে। তারপর দরজায় তালা ঝুলছে দেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকবে।…
মালবীর ঠোঁটের ডগায় কৌতুকের মত রেখা পড়ল একটু। কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচক করছে। বিগত এই কটা বছর শিল্পের তাগিদে ঠোঁটে তার অজস্র কৌতুক ঝরেছে, আর চোখ তার অজস্রবার চকচকিয়ে উঠে দুগাল বেয়ে ধারা নামিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে সে-সবের মিল নেই।
রমা নিত্ৰ এখনো ভস্মস্তূপে পরিণত হয়নি। আর সেই ভস্মস্তূপ থেকে তখন। কোনো মালবী মিত্রর আবির্ভাব ঘটেনি।
এম. এ. পড়া একটি অতি সাধারণ মেয়ে রমা মিত্র। মামুলি প্রেমে পড়েছিল একটি বনেদী ঘরের সাধারণ ছেলের সঙ্গেই যার নাম প্রশান্ত ঘোষ। কিন্তু রমা মিত্র প্রায় অসাধারণই ভাবত তাকে। ভাবতে ভালো লাগত।
রমা রূপসী কিছু নয় যে নিজের সম্পর্কে বাড়তি গর্ব পুষবে। গায়ের রং বলতে গেলে কালোই। স্বাস্থ্যটা ভালো এই যা। আর যাদের দরদ আছে তারা নাক মুখ চোখও ভালো দেখে। তবে ফটো ওর খুব সুন্দর ওঠে, সত্যিকারের চেহারা থেকে ঢের বেশি সুন্দর মনে হয়। ফটোতে তো আর গায়ের রঙ ধরা পড়ে না। বি.এ. পাস করার পরেই তার বাবা এক বড় ঘরে মেয়ে দেবার আশায় ওর একখানা ছবি পাঠিয়েছিল পাত্রপক্ষের কাছে। ছবি দেখেই পাত্রপক্ষ সাগ্রহে এগিয়ে এসেছিল মেয়ে দেখতে। কিন্তু রঙ দেখে ফিরে গেছে। মোটামুটি ফর্সা হলেও হয়ত আটকাতো না, কিন্তু রমাকে ঠিক মোটামুটি ফর্সাও কেউ বলবে না।
কিন্তু গর্ব করার কত রমার গুণও একটু ছিল। খুব সুন্দর থিয়েটার করত স্কুল আর কলেজে পড়তে। মেয়ে-কলেজের সেই থিয়েটার দেখে অনেক ছেলে অনেক রূপসী মেয়ের থেকেও তার দিকে বেশি ঝুঁকত। ওর বাবা কোন ফার্মের বাঁধা মাইনের কমার্সিয়াল আর্টিস্ট হলেও আর্টিস্ট তো বটেন। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। মেয়ের এই সখে বাধা দেননি কখনো। এম.এ. পড়ার সময়ও কি এক ব্যাপারে পাড়ার মেয়েরা মিলে থিয়েটার করেছিল। রমা মিত্র তার নায়িকা এবং সর্বাধিনায়িকা। সেই যশের দুদুটো অ্যামেচার থিয়েটার দলের ভদ্রলোকেরা ওর বাবাকে পর্যন্ত ধরে পড়েছিল, মেয়েকে থিয়েটার করতে দিতে হবে। নিরুপায় ভালমানুষ বাবা মেয়ের কাছেই পাঠিয়ে ছিলেন তাদের। রমা তাদের তাড়িয়েছে।
যাক, ওটা জীবনের ক্ষেত্র নয়–অন্য সব ক্ষেত্রেই রমা মিত্র নিজেকে অতি সাধারণের উর্ধ্বে ভাবত না কখনো। আর তার এই মাধুর্যটুকুই কারো কারো চোখে পড়ত, মনেও বোধহয় ধরত। বিশেষ করে চোখে পড়েছিল আর মনে ধরেছিল প্রশান্তর।