কেন?
কারণ দি ওয়ার্লর্ড ইজ ফর দি ইয়ং। যৌবন যার দুনিয়া তার। এতে দ্বিমত কেউ নয়।
অতএব আজকের দার্শনিক বলেন যদি কিছু, যৌবনের বদলে সম্প্রসারিত যৌবনের কথা বলবেন। অর্থাৎ কাল ফুরালেও যে যৌবনের বহিরঙ্গ অনেক কাল পর্যন্ত অটুট রাখা যায়–তার কথা। আর বলবেন বোধ হয় একেবারে উল্টো কথাই। বলবেন, টেনে বাড়ানো এ যৌবন ধী-শূন্য যদিবা, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য কদাপি নয়। সর্বকৃত্রিমতা আড়াল করার প্রতি তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিধোঁকা আর ফাঁকি তার একমাত্র পুঁজি।
খবরের কাগজে সেদিন একটা কার্টুন দেখে আপনারা অনেকে হাসাহাসি করেছেন জানি।…এক ভিড়ের ট্রাম থেকে একজন মহিলা নেবে যাচ্ছেন, তার চুলের (পরচুলের) বোঝা এক ভদ্রলোকের ছাতায় আটকে আছে, আর ভদ্রলোক তাকে চেঁচিয়ে ডাকছেন, ও ম্যাডাম, আপনার সব চুল যে আমার ছাতায় আটকে থাকল, নিয়ে যান, নিয়ে যান! ২০০
যাঁরা হেসেছেন তারা হেসেছেন, কিন্তু আমার ধারণা, যদি কোনো ম্যাডামের বরাতে অমন দুর্দৈব ঘটেই, তার পুঁজি খোয়ানোর দুঃখে আজকের দিনে কাদবার লোকেরও অভাব হবে না।
যাক, আমি কোনো গুরু-গম্ভীর তত্ত্ব বিস্তারে বসিনি। যৌবন আগলে রাখার প্রেরণা বা তাড়নার বহু বিচিত্র নজির সকলেই হামেশা দেখছেন। অবকাশ সময়ে আমিও দেখি। আমার দেখার রঙ্গপট একটি হাল-ফ্যাশনের চুলছাটার সেলুন। নাম প্রসাধনী। প্রসাধনীর হেড কারিগর যে, মালিকও সেই। নাম অমল, বয়েস এখন তিরিশ-বত্রিশ হবে। চৌকস চটপটে ছেলে। আমি তাকে গত বারো বছর ধরে দেখছি। তখন বাড়িতে এসে চুল ছেটে দিয়ে যেত। নিজের উদ্যমে দোকান করেছে, তারপর কবছরের মধ্যে সেটাকে এমন ঝকঝকে করে তুলেছে। আশপাশের দুটো সেলুন কমপিটিশনে টিকতে না পেরে উঠে গেছে। তাদের বাছাই-করা তিনটি কারিগর প্রসাধনীতে কাজ পেয়েছে। অমলের আশা অদূর ভবিষ্যতে সেলুনটাকে সে এয়ার কণ্ডিশন করে ফেলতে পারবে। আর তার একটা বড় খেদ, এ লাইনে একটিও দিশি মেয়ে-কারিগর মেলে না। তাহলে আলাদা একটু পার্টিশন করে মেয়েদের ব্যবস্থাও রাখত। দোকান জমজমাট হত তাহলে। এ তো আর সাহেব-পাড়ার দোকান নয় যে মেয়েরা এসে পুরুষ কারিগরের হাতে। চুলের বোঝা ছেড়ে দেবে! মেয়েরা না থাকলে কোনো ব্যাপারই ঠিক কমপ্লিট হয় না, কী বলেন সার?
ওর হাত যেমন চলে, রসালো জিভখানাও তেমনি অবিরাম নড়ে। আমাকে দেখলে আরো বেশি নড়ে। গল্প উপন্যাস লিখি ও জানে। একটু-আধটু পড়ে। তাই দেখামাত্র অন্য। খদ্দেরদের শুনিয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানায়। তারপর সোৎসাহে বলে, আপনার অমুক লেখাটা পড়ছি স্যার। ওমুক বইটা খুঁজছি, বা আপনার ওমুক ছবিটা দেখলাম, হাই ক্লাস!
গোড়ায় গোড়ায় বিড়ম্বনা বোধ করতাম, বিরক্তও হতাম। কিন্তু ও সেটাও খুব। সহজেই বুঝত। তাই ফাঁক পেলেই গলা খাটো করে বলত, কিছু মনে করবেন না। স্যার, এরকম বললে আপনার তো কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু আমার বড় উপকার। হয়–কতজন এসে আপনার কথা জিজ্ঞেস করে আপনি জানেন না স্যার।
প্রসাধন-কলা ছেড়ে তোষামোদ-কলাতেও লোকটা যে কম পটু নয়, এ বোধহয়। ওর শত্রুও স্বীকার করবে।
ওর বচনের জ্বালায় হোক বা ভিড় এড়ানোর জন্যে হোক, ইদানীং প্রতি মাসে। আমি রাত্রের নিরিবিলিতে আসি। তখনো যে খদ্দের একেবারে থাকে না এমন নয়, তবু অপেক্ষাকৃত কমই থাকে। যাই হোক, এখান থেকে মানুষের যৌবনপ্রীতির অনেক সকৌতুক নজির আমি দেখছি। আর এই দেখাটুকু লক্ষ্য করেই অমল খদ্দেরদের অনেক মজাদার কাণ্ডকারখানা আমাকে শোনায়। এই নিয়ে আমি একবার একটা হাসির গল্প। লিখেছিলাম। এরপর থেকে ওকে আর পায় কে! রসদ যোগাবার তরল আনন্দে ও আপনা থেকেই মুখর হয়ে ওঠে।
সেদিন রাত নটা নাগাদ গিয়ে দেখি, অমলের দোরে ঝকঝকে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভিতরে অমল অপরিমিত মনোযোগ সহকারে এক সৌখিন ভদ্রলোকের চুলে কলপ লাগাচ্ছে। বলতে ভুলে গেছি, সাদা চুল পরিপাটিভাবে তকতকে কালো করাটাও প্রসাধনীর এক বড় আকর্ষণ। অমল বলে, এ কাজে ও স্পেশ্যাল ট্রেনিং নিয়েছে। চুল কালো করার মাশুল দু-টাকার থেকে পাঁচ টাকা–অর্থ্যাৎ খদ্দের বুঝে যেমন আদায় করা যায়। ব্যাপার লক্ষ্য করেছি প্রায় একই, শুধু একটু যত্ন-আত্তি আর তোষামোদের যা তফাত।
ভদ্রলোককে দেখে আর অমলের সুতৎপর তন্ময় মনোযোগ দেখে বুঝলাম, পাঁচ টাকার খদ্দের তো বটেই, বেশিও হতে পারে। ভদ্রলোকের বয়েস ষাটের কাছাকাছি। মোটামুটি সুপুরষ। হাতে সোনার ঘড়ি, আঙুলে মুক্তো আর নীলার আংটি, জামায় হারের বোতাম।
ভদ্রলোকের চুল কতটা সাদা ছিল সঠিক বোঝা গেল না। কারণ কলপ-বিন্যাসপর্ব প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। এখন অমল যা করছে সেটা বাড়তি। স্ফীত অঙ্কের কিছু প্রাপ্তির আশা তার। আমাকে দেখেই চোখের ইশারায় একটু অপেক্ষা করতে বলল, এবং অন্য কারিগর আমার দিকে এগিয়ে আসতে ইশারায় তাকেও নিষেধ করল। অর্থাৎ হাত খালি হলে সে নিজেই কাজ ধরবে বুঝলাম, আমাকে শোনানোর মতই কিছু রসদ তার কাছে জমা আছে।
আরো মিনিট দশেকের মধ্যে ওদিকের কেশবিন্যাস শেষ। অমল তাড়াতাড়ি এগিয়ে। গিয়ে পুশ-ডোর ঠেলে দাঁড়িয়ে আরো একটু বাড়তি সম্ভ্রম দেখালো। ভদ্রলোক পকেট থেকে বড়সড় মানিব্যাগ বার করতে করতে পুশ-ডোরের ওধারে চলে গেলেন।