অফিসার আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী, চিনতে পারো?
জবাবে যতটা সম্ভব ঝুঁকে শেকল-বাঁধা-হাত কপালে ঠেকিয়ে আমাকে প্রণাম করল! আমাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বললেন, বাবুর সঙ্গে কথা বল, আমি একটু কাজ সেরে আসি–কিছু ভয় নেই।
ঘর ফাঁকা। বাইরে অবশ্য প্রহরী মোতায়েন বলে ধারণা আমার। তাছাড়া এ রকম অবস্থায় ওই একটা সামনের দরজা দিয়ে কারো পালাবার প্রশ্ন ওঠে না। তবু কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
বাবু ভালো আছেন?
আমি সচকিত।-হ্যাঁ।…কিন্তু এ কী হলো!
জবাবে ও ওপরের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল একবার। তারপর বিড়বিড় করে বলল, সবই অদেষ্ট। একটু বাদেই ওর গর্তের চোখ দুটোতে আগ্রহের ছোঁয়া লাগল। –আচ্ছা বাবু, মানুষ মরলে আবার জন্মায়?
পুলিশ অফিসার এ প্রশ্নের যাই তাৎপর্য বুঝুন, আমি বুঝতে পারলাম না। জানি না …কেন বল তো?
জবাব দিল না। চুপ করে খানিক ভাবল কি। তারপর অনুনয়ের সুরে বলল, বাবু, আপনার কাছেও আমি অপরাধ করেছি, তবু দয়া করে আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন। আর একটুখানি দয়া চাইব বাবু…?
আমি জিজ্ঞাসু।
মঙলা বলল, গৌরীর রোগা ছেলেটাকে ওরা অনাথ আশ্রমে রেখেছে। শুনলাম…আমার কিছু টাকা আছে, হক্কের টাকা, সেটা যাতে ওই ছেলেটার ভালোর জন্যে খরচ হয় আপনি সে ব্যবস্থা করে দেবেন–দেবেন?
বললাম, আচ্ছা সে হবেখন, আগে তো কেটেস হোক।
এরপর দুচার কথায় ব্যাপারটা শোনা গেল।…চুরির দায় থেকে খালাস পেয়ে গৌরী যেন কেনা দাসী হয়ে গেল মঙলার। নিজেকে ওর কাছে বিলিয়ে দিয়ে ওর নেশা ধরিয়ে দিল। মঙলা দূরের এক কলে কাজ নিয়েছিল, প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমি ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিলাম না বলেই ও রোজগার করে চুরির দেনা শোধ করবে। হপ্তার ছুটির দিনে গৌরীর বস্তিতে আসত, একদিন থেকে আবার চলে যেত।
কিন্তু গৌরী আসলে ওকে ভালবাসত না, ভয় করত। ভিতরে ভিতরে যে অন্য লোক জুটিয়েছে সেটা বোঝা গেল বছর না ঘুরতে। দুই-একবার ধরা পড়ে ওর হাতে বেদম মার খেল গৌরী। মার খেয়ে কিছুদিন ঠাণ্ডা হয়ে থাকে, তারপর আবার বেচাল শুরু হয়। একবার খাওয়ার দোষে ওর রোগা ছেলেটা মরমর, ভাবনা-চিন্তায় মঙলা রাতে ফ্যাক্টরী থেকে পালিয়ে বস্তিতে এসে দেখে সেই বিপদের দিনেও রাতের আঁধারে বেড়ার গায়ে দাঁড়িয়ে বাবুগোছের একটা লোকের সঙ্গে গৌরী ফিসফিস করছে। ওর সাড়া পেয়েই লোকটা পালিয়ে গেল।
সেই রাতে হাড়ভাঙা মার খেয়েও মঙলা দেখেছে, গৌরীর দুচোখ বাঘিনীর মতো জ্বলছে। এর কমাসের মধ্যে মঙলা যে করেই হোক স্থির বুঝেছিল, গৌরী ওকে ছেড়ে পালাবে। বুঝেছিল, কারো সঙ্গে পালাবার ষড়যন্ত্র পাকা করে এনেছে। এই পর্যন্ত বলে। মঙলা থামল।
আমি বলে উঠলাম, ও-রকম একটা মেয়ের জন্য নিজের এতবড় বিপদ ডেকে আনলে?
আবার একটু চুপ করে থেকে মঙলা বিড়বিড় করে জবাব দিল, কোন মেয়ের জন্য নয় বাবু, গৌরীকে খুন না করলে ওর হাতে একটা শিশু খুন হত। নিজের ছেলেটাই সব থেকে বড় কাটা, ওকে একেবারে সরিয়ে দিয়ে পালাবার মতলব ভেজেছিল ওরা।…আগেরবারে খাবারের সঙ্গে বিষও গৌরীর ওই লোকই দিয়েছিল।..বুকে ছোরা বসাবার পর চোখের জলে ভেসে গৌরী সব স্বীকার করে গেছে।
.
ঘরে পুলিশ অফিসারের সামনে বোকার মতো আমি বসে। উনি বললেন, এ ঘরের আপনাদের সব কথা ওদিক থেকে শোনার ব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছিলাম। ..ভেরি স্যাড ইনডিড়!
অন্যমনস্কের মতো বাড়ি ফিরছি। পর পর কতগুলো দৃশ্য আমার চোখের সামনে। ভাসছে।…একটা ভিখিরি তার ছেলেকে মারছে দেখে হাতের মোট নামিয়ে ক্ষিপ্ত আক্রোশে মঙলা তাকে মেরে বসল।…আদিম রিপুর তাড়নায় পদ্মর ঘরে গিয়ে সেই কান্না দেখে, আর তার থেকেও বেশি–সেখানে দুটো অসহায় নির্বাক শিশুমূর্তি দেখে ওই উচ্চুঙ্খল মঙলার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল।…আর তারপর, ওই মঙলা আর একটা অসহায় শিশুর আসন্ন মৃত্যুভয়ে গৌরী দাসীকে খুনই করে বসল।… কেন, পথের ছেলে মঙ্গলা কি ওদের মধ্যে নিজেকেই দেখত?
চমকে উঠলাম। কানে যেন বিড়বিড় স্বরের একটা উৎসুক প্রশ্ন আঘাত করল।–আচ্ছা বাবু, মানুষ মরলে আবার জন্মায়?
…মঙলা আজীবন তার জম্মটাকে ঘৃণা করেছে। আবার একটা জন্মের অভিশাপ ও বহন করতে চায় না।
যৌবন
দুনিয়াখানা যৌবনের বশ।
এক বুড়ো প্রায়ই আক্ষেপ করত, আর বলো কেন ভায়া, দুনিয়া তার যৌবন যার।
ছেলেবেলায় এই যৌবনটির জন্য ভিতরে ভিতরে একটা লোভনীয় প্রতীক্ষা ছিল। বোধহয় সকলেরই থাকে। কিন্তু সময়ের বেড়া বাঁধা এই রম্য বাগিচায় পা ফেলার পর তার অনেক চটক চোখে পড়ে না। যাই হোক, ওই দুর্লভ গণ্ডীর মধ্যে বিচরণকালে তার মহিমা সম্পর্কে আমি নিজে অন্তত ধ্ব সচেতন ছিলাম না।
ক্রমে প্রৌঢ় ব্যবধানে সরে আসার পর আজ আবার সকৌতুকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, যৌবন চটকদার বস্তু বটে। শুধু তাই নয়, দি ওয়ার্লর্ড ইজ ফর দি ইয়ং–সেই বুড়োর ভাষায়, দুনিয়া তার যৌবন যার।
এক নামজাদা দার্শনিক বলে গেছেন, যৌবন অনেক সময় কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, কিন্তু কদাপি ধী-শূন্য নয়। সর্বকৃত্রিমতার ওপর তার তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি–সে ধোঁকা বা ফাঁকি ধরতে জানে। কিন্তু আজকের বাস্তব দুনিয়ার দার্শনিক এই বাসি প্রসঙ্গ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাবেন কিনা সন্দেহ। তিনি বরং উত্তর-যৌবন সম্পর্কে কিছু দর্শন বচন। শোনাতে পারেন। কারণ এ-যুগের এটাই বড় সমস্যা।