এই কথা শুনে আর অন্য বোর্ডারদের বিচলিত হাবভাব দেখে চাকরি-গর্বা আধা নতুন বোর্ডারটি মনে মনে ঘাবড়েছে। পরে সতীর্থদের মুখে মঙলা-সমাচার শুনে মুখ আমসি। সকলের এক কথা, করলেন কী মশায়, এখন সামলাবেন কী করে! ওর দলের কানে তো পৌঁছুল বলে!
ওর দল বলতে এই এলাকায় ওদের শ্রেণীর ছন্নছাড়াদের গোষ্ঠী। ওদের মধ্যে অনেকে বাড়ি আর হোটেলে বোর্ডিংয়ে চাকরি করে, অনেকে আবার কিছুই করে না, উপার্জনের আশায় নানা রকমের বাঁকা রাস্তায় ঘোরাফেরা করে। এ-রকম একটা দলের। ও মাতব্বর হয়ে বসল কী করে সঠিক খবর রাখি না। রোজ দুপুরে সামনের পার্কের একটা চাতালে ওদের জুয়ার আড্ডা বসে। আমার ধারণা, এই থেকেই মঙলা ওদের পাণ্ডা। গোড়ায় ওকে দুই-একবার সাবধান করেছি, তোমাকে পুলিশে ধরল বলে!
ও তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিয়েছে, পুলিশ নিজের ক্ষেতি করবে কেন, তার ট্যাকেও দুপয়সা আসছে।
তবে ওই মঙলাই আমাকে আশ্বস্ত করেছিল, এখন আর সে জুয়া-টুয়া খেলে। না, আড্ডায় গিয়ে বসে এইমাত্র, নইলে ছোঁড়াগুলো নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি খাওয়া খাওয়ি করে। একদিন সে ওদের থেকেও অনেক বড় বদমাস ছিল, এখন ভালো হতে চায় বলেই চাকরি করছে আর জুয়াখেলাও বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে।
ওর এই সুমতির কিছু কিছু কারণ আমার জানা আছে। সেটা পরের প্রসঙ্গ। যাক, ওর সমাচার শোনার পরেও সেই আত্মাভিমানী নব্য বোর্ডারটি ভয় গোপন করে। ঝাঁঝিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল, এ-রকম একটা রাফিয়ানকে বোর্ডিংয়ে রাখা হয়েছে। কেন–পত্রপাঠ তাড়িয়ে দেওয়া উচিত আর পুলিসেও একটা খবর দিয়ে রাখা উচিত।
একজন বলে উঠেছিল, উচিত কাজ নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে নিজের মাথাখানা। বাঁচাবার কথা ভাবুন মশাই! বলা নেই কওয়া নেই, আপনি গায়ে হাত তুলতেই বা গেলেন কেন? এখনো সেই রামরাজত্বে আছেন ভাবেন?
সন্ধ্যেনাগাদ সতীর্থরাই তাকে আমার কাছে আসার পরামর্শ দিয়ে পাঠিয়েছে বোঝা। গেল। তাদের ধারণা, এরপর আমিই বলে-কয়ে মঙলার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি, অন্যথায় বিপদ অনিবার্য। ভয়ে ত্রাসে ভদ্রলোক মুষড়ে পড়েছে। অগত্যা মঙ্গলাকে ঘরে ডেকে বললাম, বাবু একটা অন্যায় কাজই করে ফেলেছেন, তুমি কিছু মনে রেখো না।
ড্যাবড্যাব করে খানিক মুখের দিকে চেয়ে থেকে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি ওনার মঙ্গল চান?
না চাইলে তোমাকে ডাকলাম কেন?
চাহিবেন বৈকি বাবু, আপনিও ভদ্র লোক, আর একজন ভদ্রলোক একটা ছোটলোকের গায়ে হাত তুলেছে এ আর এমন কী কথা!
ফাঁকে পেলে ও আমাকে অনেক রকমের নীতিকথা শোনায়! কিন্তু এ কথার ধার অন্যরকম। মুখে বিরক্তির ভাব এনে বললাম, তাহলে কী করতে হবে এখন?
আড়চোখে একবার ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে ও জবাব দিল, ওঁর ভালো চাইলে কাল সকালের মধ্যে ওঁকে এখেন থেকে চলে যেতে বলুন।
রাগ হচ্ছিল বটে, কিন্তু মঙলাকে যে চেনে সে নির্বোধের মতো রাগ করবে না। পাংশুমূর্তি ভদ্রলোকের দিকে ফিরে আমি বললাম, ঠিক আছে, কাল সকালে আমি আপনি দুজনেই চলে যাব এখান থেকে!
এবারে মঙলা থমকালো একটু। থমথমে মুখে একবার আমার দিকে আর একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে দরজার ওধারে চলে গিয়েও অসহিষ্ণু ক্ষোভে ফিরে এলো আবার। শরণাপন্ন বোর্ডারটির দিকে চেয়ে গরগর করে উঠল, দিনকাল খারাপ, হাত নিশপিশ করলেও হাত দুটোকে বশে রাখতে শেখেন! আমার দিকে ফিরে অভিমানহত ঝঝে বলে গেল, গরিবের আপনজন কেউ নেই, সবাইকেই জানা আছে আমার-কাউকেই যেতে হবে না এখান থেকে।
এই মঙলা!
.
বিস্ময় চেপে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, চুরির চার্জ নাকি?
মাথা নেড়ে পুলিশ অফিসার জবাব দিলেন, একেবারে প্রাণ চুরি-মার্ডার চার্জ!
চমকে উঠলাম। নিজের অগোচরে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কী সর্বনাশ, গৌরী দাসীকে?
ভদ্রলোক নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসলেন।–আপনি জানলেন কী করে?
আমি বিমূঢ়। কী ফ্যাসাদ ঘটালাম কে জানে।
পুলিশ অফিসারটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। তারপর মুখে হাসি ঝরল। বললেন, যা জানেন, বন্ধু হিসেবে খোলাখুলি বলুন–তাতে বরং লোকটার কিছু উপকার হতে পারে… এভিডেন্স যা, তাতে ওর অব্যাহতির আশা কম। অথচ লোকটার। হাবভাব কেমন পিকিউলিয়ার…নট লাইক এ সীজৰ্ড ক্রিমিন্যাল। কিন্তু মার্ডার শুনেই আপনার গৌরী দাসীর নাম মনে এলো কেন?
সত্যি জবাবই দিলাম–বোর্ডিং-এ থাকতে ও শাসাতে ওই একটা মেয়েছেলেকে ঠিক একদিন খুন করে বসবে! বলত, ভগবান যেন তার হাত থেকে ওকে রক্ষা করেন!
পুলিশ অফিসার বললেন, রক্ষা করেনি, ওই-গৌরী দাসীই তার নিজের বস্তিঘরে খুন হয়েছে। ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। জরুরী কাজ পড়েছে, যেতে হবে…বিকেলের দিকে আমার অফিসে আসুন একবার, এ নিয়ে একটু আলাপ-আলোচনা করা যাবে। বোর্ডিংয়ের চাকরির আমলে কে ভালো চিনত জিজ্ঞেস করতে মঙ্গল দাস প্রথমেই আপনার নাম করল, আর আপনার কী কী চুরি করেছিল তাও কবুল করল। আপনি নাকি ইচ্ছে করলেই তাকে ধরাতে পারতেন, কিন্তু ধরান নি। ভয়ানক শ্রদ্ধা আপনার ওপর। আপনার সঙ্গে আমার খাতির আছে শুনেই একবার দেখা করিয়ে দেবার জন্য দুহাত জুড়ে আকৃতি। নিয়ম নেই, বাট আই মে ট্রাই, আসুন তো একবার বিকেলে
চোখের সামনে একদিনের ছবি ভেসে উঠল। বোর্ডিংয়ের বাজার সেদিন আমার হাতে। বাজার করে ফিরছিলাম–মঙলার দুহাতে দুটো বড় বোঝা, পিছনে মুটে! মঙলা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।