বয় কফির অর্ডার নিয়ে গেল আর দিয়ে গেল। কফি তৈরি করে পেয়ালা এগিয়ে। দিল প্রমীতা, নিজেরটাও টেনে নিল। সহজ অন্তরঙ্গতার সুরেই জিজ্ঞাসা করল, তারপর, এখানে আছ কোথায়?
–সেই দক্ষিণে।
–দক্ষিণে কোথায়?
–কেন, যাবে?
আবারও মুখের উপর চোখ দুটো বড় বেশি স্থির মনে হল প্রমীতার। হেসেই জিজ্ঞাসা করল, কেন, গেলে কারো আপত্তির কারণ হবে?
বিজন হাসছে মৃদু মৃদু–তা হবে না অবশ্য। বাড়ি পনেরোর দুই, ভবেন হালদার লেন, চারু মার্কেটের কাছে।
–ঠিক যাব একদিন দেখো, ছুটির দিনে থাকো তো?
বিজন মাথা নাড়ল, থাকে। ওষুধের বোতলটার দিকে চোখ পড়তে প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, ওষুধ মনে হচ্ছে, কার?
–মেজ মেয়ের। ও-পাড়ায় পেলাম না।
ঠিক সেই মুহূর্তে প্রমীতার মুখখানা নিষ্প্রভ দেখালো একটু, গলার স্বরও বদলালো যেন। কিন্তু মুহূর্তের ব্যতিক্রম মাত্র, তারপরে হেসেই বলল, সংসারচিত্রের প্রথমেই মেয়ের অসুখের খবর দিলে! কী হয়েছে?
-পেটে চিনচিনে ব্যথা, প্রায়ই ভুগছে, আজও ওষুধটা না নিলে খণ্ড-প্রলয়ের সম্ভাবনা ছিল।
পরিতুষ্ট মন্তব্যের মত শোনালো প্রমীতার কানে। হেসেই জিজ্ঞাসা করল, ছেলেপুলে কী তোমার?
–দুই মেয়ে, এক ছেলে।
কার কত বয়েস? সত্যিই এই লোকটার সম্পর্কে জানার কৌতূহল প্রমীতার।
–বড় মেয়ে এগারো, মেজোটা সাড়ে আট, ছেলে সারে ছয়।
–বেশ। এবার বউ কেমন শুনি?
–বিয়ের পর একবছর পর্যন্ত বউ ছিল, এখন তিনি কর্তা–আমার পোজিশন ছেলে-মেয়েদের থেকে খুব বেশি ওপরে নয়। নিজেও কিছু উপার্জন করে বলে আমাকেও প্রায় অকর্মণ্য পোষ্য ভাবে।
–চাকরিও করে তাহলে! লেখা-পড়া জানা বলো..কী চাকরি?
-মাস্টারী। তবে তোমার মত বড়দরের নয়, ছোটদরের। দিনের বেলায় স্কুলের। মেয়েদের ওপর, রাত্রিতে আমাদের ওপর।
প্রমীতা লক্ষ্য করছে, মুখখানা আগের থেকে সত্যিই অনেক ঢলঢলে হয়েছে, আর প্রকারান্তরে যতই বউয়ের নিন্দার আভাস ফোঁটাতে চেষ্টা করুক, কথাবার্তায় আসলে বেশ একটা সহজ পরিতৃপ্তির আমেজ রয়েছে।
হেসে ছদ্ম ভ্রূকুটি করল প্রমীতা, বিচ্ছিরি কথাবার্তা হয়েছে তো তোমার! দাঁড়াও, বাড়ি গিয়ে যা-যা বলেছ, বউকে বলে দেব সব!
-বোলো। বিশ্বাস করলে আমাকে ধোলাই করতে নিশ্চয় ছাড়বে না, কিন্তু তোমার। মত এমন পরিচিত একজনও আছে আমার, চাক্ষুষ সে-প্রমাণ পেলে মনে মনে একটু সম্মানও অন্তত নিশ্চয় করবে–আমার কপালে এ বস্তুটি দিনকে দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে।
চারুমার্কেট ছড়িয়ে, ট্রামডিপো ছাড়িয়ে, আরো আধমাইল পথ পায়ে হেঁটে অন্ধকার গলির ভিতর দিয়ে ঠাওর করে এগিয়ে এসে জীর্ণ বদ্ধ দরজার তালা খুলল বিজন ঘোষ। নিঃশব্দ হাসিটা সমস্ত মুখে ছড়িয়ে আছে।
বগলের ওষুধটা নিজেরই, পেটের চিনচিনে ব্যথাটাও নিজেরই। কিন্তু ওষুধটা না কিনলেও হত, ব্যথাটা বোধ হয় সেরেই গেল। প্রমীতা কোন দিনও আর তার ঘরে আসবে না। এলেও চারুমার্কেটের সামনে পনেরোর দুই ভবেন হালদার লেনের অস্তিত্ব কোথাও আছে কিনা বিজন ঘোষ জানে না।
অন্ধকারশূন্য ঘরে তার নিঃশব্দ হাসিটা গাল বেয়ে প্রায় কানের দিকে ছড়াচ্ছে। এখন। কলকাতায় এসে এই দেড় বছর ধরে এই গোছেরই একটা স্বপ্ন দেখেছিল যেন। স্বপ্নের গাছে বাস্তবের ফল সত্যিই ধরে?
বিজন ঘোষও হরিপদ কেরানীদেরই একজন। এই শূন্যঘরে যে মানসীর আনাগোনা, তারও প্রনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর…।
বিজন ঘোষ কোনদিন তার অস্তিত্ব টের না পেলেও প্রমীতা গুপ্ত পাচ্ছে।
পরিতাপ
আমার ধারণা, বিচারে লোকটার ফাসী হবে, নয়ত দ্বীপান্তর হবে।
দুটোর একটা যাতে হয় পুলিস সে চেষ্টায় সুতৎপর। এই তৎপরতার দরুনই মঙ্গলের সঙ্গে দেড় বছর বাদে আমার আবার যোগাযোগ।
পুলিসের তদন্তসাপেক্ষে ওকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত অফিসারটির সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আলাপ। কাগজের অফিসের চাকরির দরুন হোক বা ভদ্রলোক নাট্যরসিক এবং আমি লেখক বলে হোক, আলাপটা মোটামুটি অন্তরঙ্গমুখী। এঁর কাছে গেলে অনেক সময় লেখার মত অনেক বিচিত্র রসদ মেলে। তাঁর দখলের আবাসটিও আমার বাড়ি থেকে দূরে নয়।
সেদিন সকালে ভদ্রলোক আমার বাড়িতে হাজির। অবকাশ পেলে সাধারণত আমিই তার ওখানে গিয়ে থাকি। এসেই সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ মশাই, মঙ্গল দাস নামে একটা লোককে আপনি চিনতেন?
চট করে ওই নাম বা নামের কোন মুখ স্মরণে এলো না। ভেবে বললাম, মনে। পড়ছে না তো!
সে তো আপনার নাম খুব ফলাও করে বলল, আপনি নাকি তার অনেক উপকার করেছেন…তার বদলে সে আপনার কিছু উপকার করেছে–আপনার দামী ঘড়ি, দামী পেন, জামার সোনার বোতাম আর পকেটের কিছু টাকা নিয়ে সরে পড়েছিল।
মঙলা! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল প্রতি মাসের গোড়ায় পদ্মমণিকে টাকা পাঠাত যখন, প্রেরকের নাম মঙ্গল দাসই লেখা হত বটে। মণি-অর্ডার আমিই লিখে দিতাম। কিন্তু ওই নামে বোর্ডিংয়ের কেউ তাকে চিনত না। সকলেই হাঁক দিত মঙলা বলে। নতুন বোর্ডার এসে নাম জিজ্ঞাসা করলে ও নিজেও এই নামই বলত। আর দুদিন না যেতেই নতুন বোর্ডার টের পেত, মঙলা সেখানকার একটি বিশেষ চরিত্র–আর পাঁচটা চাকর-বাকরের মত হেলাফেলা বা অবজ্ঞার পাত্র নয়।
আমাদের বোর্ডিংয়ে বেকার বা আধা-বেকারের বাস ছিল না। সবাই মোটামুটি ভালো উপার্জনশীল। একবার এক আত্মাভিমানী প্রায়-নতুন বোর্ডারের মুখের ওপর ও কী একটা জবাব দিয়ে বসেছিল, ফলে ঠাস করে গালের ওপর এক চড়। জবাবে স্তব্ধ চোখে মঙলা তার দিকে চেয়ে ছিল শুধু। এই ঔদ্ধত্যের জন্যেও নবীন ভদ্রলোক। দ্বিতীয় দফা তেড়ে এসেছিল। তার আগেই অন্য বোর্ডাররা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলেছিল। তেমনি নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে থেকে মঙলা শুধু বলেছিল, এখন থেকে নিজের জন্য আপনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন।