নিমেষে মুখের রঙবদল হল যেন একট, তারপর হাসি-মাখা দুচোখ তার চোখের ওপর তুলল প্রমীতা। লোকটার কথাবার্তার ধরনও যেন আগের থেকে তাজা হয়েছে মনে হল। বলল, দাগ ফেলার মত লোক আর এলোই না, তার কী করা যাবে? মুখ আবারও রাঙালো একটু, তাড়াতাড়ি বলল, চলো কোনো ভালো জায়গায় বসে একটু চা বা কফি খাওয়া যাক, তোমার তা নেই তো কিছু?
খুশিমুখে বিজন পকেটে হাত ঢোকালে, দাঁড়াও, পকেটে রসদ কী আছে। দেখি
দেখতে হবে না, এসো।
স্মিতমুখ দুজনেরই। পাশাপাশি কোনো রেস্তরাঁর উদ্দেশে এগোলো তারা।
.
আপিসের হিসেব রাখার কাজ করে বিজন ঘোষ। জীবনের হিসেবও ভোলেনি। আর দেখা না হলেও প্রমীতা গুপ্তর খবর রাখে না এমন নয়। কোন এক বে-সরকারী কলেজে প্রোফেসারি করে এই খবর রাখে, সমন্তে এখনো দাগ পড়েনি এবং পড়ার সম্ভাবনাও বিশেষ নেই–এ-খবরও রাখে। আর চৌরঙ্গিপাড়া থেকে বিলিতি বই কিনে আর পড়ে অবসর সময় কাটায়, হাতের প্যাকেট দেখে অনুমানে সে-খবরটা আজ পেল।
…বিজনের উনচল্লিশ চলছে, প্রমতার বয়েস তাহলে এখন ছত্তিরিশ হবে। দেখায়ও তার থেকে কম নয়, ফর্সা মুখ আগের থেকে আরো ফ্যাকাশে হয়েছে।
.
আঠারো বছর বয়সে পনের বছরের মেয়ে প্রমীতার প্রেমে পড়েছিল বিজন ঘোষ। ভীরু প্রেম। বাইরের প্রকাশ আরো উক্ত। কিন্তু ভিতরে প্রেমানলের স্রোত।
তার মামাতো বোন শেফালীর সহপাঠিনী ছিল। মামারবাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করত বিজন ঘোষ। সেই সূত্রেই বাড়িতে যাতায়াত আর পরিচয়। শেফালী খানিকটা করুণার চোখে দেখত ভালোমানুষ পিসতুতো দলটিকে। প্রমীতার চোখও তার থেকে ওপরে ওঠেনি। গরীব ঘরের মেয়ে শেফালীর সতেরোয় বিয়ে হয়ে গেছে। গল্পের বই যোগান দিয়ে, সিনেমার টিকেট কেটে দিয়ে, আরো অনেক-রকম সরল কৌশলে প্রমীতার সঙ্গে যোগাযোগটা অন্তরঙ্গ করে তুলেছিল বিজন ঘোষ। অন্তরঙ্গতা শুধু তার। দিক থেকেই, প্রমীতার দিক থেকে সেটা প্রীতি-দাক্ষিণ্যের বেশি নয়।
ফেল করার মত ছাত্র ছিল না বিজন ঘোষ। কিন্তু রয়েসয়ে এক বছর পর এক বছর ফেল করে করে এম-এ ক্লাসে উঠে প্রমীতার সহপাঠী হবার সৌভাগা অর্জন করেছিল সে। আর খুশিমুখে কৌশলে এই ফেল করার উদ্দেশ্যটা প্রমীতাকে জানিয়েছিল।
বিস্ময় ছাপিয়ে প্রমীতার ভ্রকুটি বেশি ঘন হয়ে উঠেছিল। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! কেন?
এই কেনর জবাব প্রমীতা যদি নিজের থেকে বুঝে না নেয়, বিজন ঘোষ কী বলতে পারে!
সিক্সথ ইয়ারে উঠে প্রমীতার বিরক্তিটা প্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সর্বদা যদি একটা লোক ছায়ার মত লেগে থাকে, কাহাতক ভালো লাগে! বন্ধুরা মুখ টিপে হাসে, সীতা দেবীর ভক্ত হনুমান বলে ওকে নিয়ে আড়ালে ঠাট্টা-তামাশাও করে– প্রমীতা তাকে বলেছেও সে-কথা। কিন্তু বলার উদ্দেশ্য সফল হত বোঝারও চেষ্টা যদি থাকত।
ওই সময়েই কোথা থেকে ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল তার, বিজন। খবরটা জানতে পারার পর এই দীর্ঘ ব্যাপারটার ছেদ।
আমতা-আমতা করে শুকনো মুখে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল সে। তখনি নয়। অবশ্য, এম-এ পাশ করার পর, আর ভালো চাকরি জুটিয়ে যোগ্যতা অর্জনের পর। সে শুধু ভবিষ্যতের আশ্বাসটুকু চায়।
মুখের দিকে চেয়ে কটু কথা বলা দূরে থাক, আশ্বাসটুকু ধূলিসাৎ করতেও কষ্ট হয়েছিল প্রমীতার। আবার এরকম সম্ভাবনার কথা ভাবতেও রাগ হচ্ছিল। খানিক চুপ করে থেকে জবাব দিয়েছিল, মাকে গিয়ে বলো, এ-সব আমি কিছু জানি না।
প্রমীতা সেদিনই মাকে একটু আভাস দিয়ে রেখেছিল, ভদ্রভাবে বেশ স্পষ্ট করেই। যেন প্রস্তাবটা নাকচ করা হয়।
প্রমীতার মা ওই সাদামাটা নিষ্প্রভ ছেলের দুঃসাহসিক অভিলাষের কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। প্রস্তাবটা আর তার কাছে ভালো করে উত্থাপনও করতে পারেনি বিজন ঘোষ। তার আগেই বেশ স্পষ্ট অনুশাসনের সুরে আর এ-বড়ি আসতে বা প্রমীতার ছায়া মাড়াতেও নিষেধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
কৃতী স্বামী আর চার-চারটে কৃতী ছেলের পর ওই একটিমাত্র মেয়ে তাঁর। রাগ হবারই কথা।
এর পরদিন থেকে প্রমীতা আর তাকে দেখেনি। য়ুনিভার্সিটিতেও আসে নি বিজন ঘোষ, অর্থাৎ এম-এ পড়া সেখানেই খতম হয়েছে। পরে কার কাছে শুনেছে, এ দেশ ছেড়েই চলে গেছে সে, বিহারে না কোথায় চাকরি নিয়েছে।
লোকটা দুঃখ পেয়ে গেল বলে প্রমীতার অবশ্য কষ্টই হয়েছিল, কিন্তু কী আর করতে পারে সে!
প্রমীতার জীবনেও অনেক জল ঘোলা হয়েছে এর পর। জামাই বাছতে বাছতে হঠাৎ একদিন চোখ বুজেছেন তার মা। তারপর প্রমীতা নিজেও অনেক সম্ভাব্য পাত্র বাতিল করেছে, আবার কেউ কেউ তাকেও বাতিল করেছে। এমনি এক বাতিলের ব্যাপার নিয়ে রীতিমত অপমানকর ব্যাপার ঘটে যায় একটা। বাবাকে আর তার বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করে প্রমীতা কলেজে চাকরি নিয়েছে। বয়েস এখন। ছত্তিরিশ…চাকরিই করে যাচ্ছে। ক্লান্তিকর অবকাশ কাটানোর জন্যে মাঝে মাঝে এ পাড়ায় এসে বিলিতি বই কেনে।
জীবনের এই সীমান্তে এসে বিজন ঘোষের সঙ্গে দেখা।
.
একটা ক্যাবিনে মুখোমুখি বসেছে দুজনে। বয় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, চা না কফি?
-কফি হোক। অনেকদিন ও বস্তু জিভে ঠেকাইনি।
এই সরলতা কানে বেশ ভালো লাগল প্রমীতার। হেসে বলল, আর কি?
-আর কিছু না।