…আর রোশনলাল একা যাবে হীরার কাছে। একশ দেড়শ গজ দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া বসতি। হীরার ঘরের শগজ ছাড়িয়ে কয়েকটা বুড়োবুড়ির ঘর–তাও সে-ঘরে বুড়োরা থাকবে না তখন। তারা হাটে যাবে।
পটভূমি প্রস্তুত।
সমস্ত রাত ঘুম হল না রোশনলালের। পচায়ের স্রোত জঠরে ঢেলে মাথার আগুন ঠাণ্ডা করা গেল না।
কী করবে সে? প্রথমেই হত্যা করবে?
না। তার বিশ বছর বয়স থেকে ভিতরের যে পশুটা বুভুক্ষু, প্রথমে তাকে ছেড়ে দেবে। হীরার তখন আশা হবে। তার নারীদেহের লোভে ডুবিয়ে মানুষটাকে বশীভূত করা গেল ভাববে। আতঙ্কে ত্রাসে বোবা হয়ে যাবে পরক্ষণে। চোখ বোজারও অবকাশ পাবে না, ধারালো ছোরাটা তার নরম বুকের উষ্ণ তাজা রক্তে স্নান করে উঠবে।
.
পরদিন।
প্রতীক্ষিত সময় এলো।
সঙ্গী চারজন নির্দেশমত হাটের দিকে চলে গেল।
রোশনলালও তার পথে পা বাড়ালো।
দূরে দাঁড়িয়ে হীরা আর সূরযপ্রসাদের ঘরটা ভালো করে দেখল একবার। তারপর আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে এলো।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পলকা দরজা, অনায়াসে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ঢুকতে পারে। কিন্তু তার দরকার হবে না বোধহয়।
দরজায় বার-কয়েক মৃদু আঘাত করতে ওদিক থেকে সাড়া মিলল।
কয়েক পা পিছিয়ে এসে রোশনলাল প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল।
দরজা খুলে হীরা বেরিয়ে এলো।
কিন্তু নিমেষের মধ্যে চোখেমুখে সমগ্র সত্তায় এ কিসের আচমকা ঝাঁপটা খেল রোশনলাল? সবকিছু ধাঁধিয়ে দেবার মতো, অন্ধ করে দেবার মত আলোর ঝাঁপটা!
পাদ্রী জোসেফের ঘরের দেয়ালের ছবির মতো এক অনির্বচনীয় রমণী-মূর্তি, কোলে তার ফুটফুটে ছেলে একটা। মা বলছে, বিশ্বমায়ের কোলে মানবপুত্র বিশ্বশিশু। .যা দেখে রোশনলালের ভাবতে ভালো লাগত, সেও একদিন ওই ছবির বাচ্চাটার মতো ছোট ছিল, আর তার মা হয়ত তখন অমনি তাকে বুকে করে দাঁড়িয়ে থাকত।
না, ছবি নয়। সামনে হীরা দাঁড়িয়ে। বুকে তার দু-বছরের ফুটফুটে ছেলে একটা।
তাকে দেখে হীরা চমকে উঠেছিল কিনা, ত্রাসে বিবর্ণ হয়েছিল কিনা–ওই আলোর ঝাঁপটা খেয়ে রোশনলাল কিছুই লক্ষ্য করেনি। স্থির দাঁড়িয়ে হীরা এখন তাকেই দেখছে। তার বিভ্রম অনুভব করছে।
জোসেফের ঘরের ছবির রমণী কখনো কথা বলেনি। এই রমণী বলল।–বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে এসো। সূরযপ্রসাদ হাটে গেছে।
স্থান-কাল ভুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল রোশনলাল, দেখছিল। মিষ্টি মৃদু কথা কটা কানে যাওয়া মাত্র বিষম চমকে উঠল। নিজের মাথার উপর উদ্যত খড়গ দেখলেও কেউ এমন চমকায় না বোধহয়।
চকিতে আর একবার শুধু সামনের জীবন্ত চিত্রটা দেখে নিল। পরক্ষণে উধ্বশ্বাসে ছুটল হাটের পথ ধরে।
একটু দেরি হয়ে গেলে চরম সর্বনাশ আর ঠেকানো যাবে না বুঝি।
পরনে ঢাকাই শাড়ি
স্বপ্নের গাছে বাস্তবের ফল সত্যিই ধরে?
বিজন ঘোষ চৌরঙ্গী এলাকায় এসেছিল একটা ওষুধের খোঁজে। কদিন আসবে আসবে করে সময় করে উঠতে পারেনি। তার কর্মক্ষেত্র সুদূর দক্ষিণে। থাকেও সেদিকেই। কিন্তু ওষুধটা আর না কিনেলই নয়। সমস্ত দক্ষিণ কলকাতা চষে পায় নি! আপিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে এসেছে মধ্যস্থলে।
ওষুধটা পাওয়া গেল। ফেরার বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।
তখনি যোগাযোগ।
একটা কাগজের প্যাকেট বুকে করে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা পার হবার তোড়জোড় করছিল প্রমীতা গুপ্ত। পরিচিত ফ্যালফেলে চাউনির চেনা-মুখ দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিড়ম্বনার চকিত কারুকার্য একটু। পলকের দ্বিধা। তারপর মিষ্টি আর ভারী অবাক মুখ করেই প্রমীতা কাছে এগিয়ে এলো।–তুমি! কী আশ্চর্য!
বিজন ঘোষের মুখে লাজুক হাসি। কাছে এসে দাঁড়ানোর পর অবাধ্য চোখ দুটো প্রমীতার মুখের ওপর থেকে নড়তে চাইছে না। পলকের দেখার মধ্যে চৌদ্দ বছরের অদেখার একটা দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দেবার বাসনা।
–দেখছ কী এমন করে, চিনতে পারছ তো?
বিজন ঘোষের হাসি-হাসি মুখ, কিন্তু চোখের তারা দুটো বড় বেশি স্থির তার মুখের পর। মাথা নাড়ল, অর্থাৎ চিনতে অনায়াসেই পেরেছে। বলল, তুমি রাস্তা পার হতে চেষ্টা করছিলে দেখছিলাম।
-বলো কি, দেখেও ডাকোনি?..নাকি ডাকতে চাওনি?
–মনে মনে ডাকছিলাম, ভরসা করে গলার আশ্রয় নিতে পারিনি।
প্রমীতা হঠাৎ হেসে উঠল। ফর্সা মুখখানা খুশি-খুশি দেখালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একনজর দেখল তাকে। পরনের ধুতিটা পরিষ্কার, গায়ের মূগা-রঙা পাঞ্জাবিটা আধময়লা–কিন্তু একটু মোটা হয়েছে, আর মুখখানাও আগের থেকে ঢলঢলে হয়েছে। বলল, তুমি একেবারে আগের মতই আছ দেখছি, কত বছর পরে দেখা বলো তো!
–চৌদ্দ বছর। রামচন্দ্রের বনবাসের কাল।
-এত হিসেবও রেখেছ! উৎফুল্ল মুখে প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তুমি কলকাতায় কবে থেকে? আমি তো শুনেছিলাম পাকাপাকি পশ্চিমবাসী হয়ে গেছ?
বছরখানেক হল কলকাতাবাসী হয়েছি, বিহারী আপিসের কলকাতায়। শাখা-বিস্তার হয়েছে। দড়ি।
প্রমীতা সকৌতুকে তাকালো তার দিকে।–এক বছরের মধ্যে মনে পড়ল না, আমাদের বাড়ির রাস্তাটা ভুলে গেছ বুঝি?
বিজন হাসতে লাগল। হাসিটা মিষ্টি লাগছে প্রমীতার, কিন্তু মুখের ওপর ওই চাউনিটা অস্বস্তিকর। জবাব দিল, ভুলিনি…রাবরই সাহসের অভাব তো! তাছাড়া ভেবেছিলাম তুমিও ঘর বদলেছ।…কিন্তু কী ব্যাপার, সীমন্তে দাগ দেখছি না যে?