একেবারে অবুঝ নয় রোশনলাল তখন। মা আর পাদ্রী জোসেফের মৃত্যুর কারণ অনুমান করতে পারে। আর একটু বড় হবার পরে স্পষ্টই বুঝেছে।
রোশনলাল ভেবেছিল হীরাকেও বাবা মেরেই ফেলবে। নিজের মেয়ে হোক না হোক, হীরাকে খুব ভালবাসত পাদ্রী জোসেফ, আর তার মা তো ভালবাসতই–অতএব বাবার রাগ ওর ওপরেও পড়বেই ধরে নিয়েছিল।
কিন্তু কিছুকাল যেতে দেখা গেল, বাবার টান তার থেকেও হীরার ওপর বেশি। হীরা ওর নামে বাবার কাছে নালিশ করলে বাবা ওকে তুলোধুনো করে, কিন্তু হীরার নামে নালিশ করলে কিছুই বলে না।
আট বছর কেটে গেছে। রোশনলালের বয়েস কুড়ি, হীরার সোল।
বাবার পক্ষপাতিত্বের দরুন হীরাকে অনেকবার খুন করতে সাধ গেছে। কিন্তু এখন আর তা হয় না। হীরাকে দেখলে রক্তে এখন অন্য রকমের নাচন-মাতন শুরু হয়। মাথায় গ্রাসের আগুন জ্বলে। হীরা সেটা বুঝতে পারে। একলা থাকলে বেশি কাছে ঘেঁষে না।
মাথা খাটিয়ে কৌশলে এক রাতে ওকে পাহাড়ের আড়ালে অন্ধকারে টেনে নিয়ে গেছল। রক্তে সবে নেশা লেগেছিল। সরল দুটো বাহুর নিষ্পেষণে হীরা অপুট আর্তনাদ করে উঠেছিল। আর হিংস্র অধরদংশনে রোশনলাল তাকে শাসাচ্ছিল, টু-শব্দ করলে একেবারে খুন করে পাথরের তলায় পুঁতে রেখে চলে যাব!
কিন্তু পরের মূহুর্তে নিজেরই রক্ত জল। আচমকা আঘাতে চোখের সামনে মৃত্যুর অন্ধকার। সেই অন্ধকার কুঁড়ে তার বাবা দাঁড়িয়ে।
রোশনলালের ধারণা, এই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সূরযপ্রসাদ। সে-ই হীরার পিছনে ছায়ার মতো ঘোরে সর্বদা। দুটিতে খুব ভাব, সে-ই কোথাও থেকে দেখে থাকবে। বাবাকে বলে দিয়ে থাকবে।
তার খাতায় সূরযপ্রসাদের পরমায়ুতে সেদিনই ঢ্যারা পড়ে গেছল।
দলে অনেক ছেলেছোকরা এসেছে এখন। সকলের থেকে অকর্মণ্য ওই চাষীর ছেলে সূরপ্রসাদ। চিমনলাল দলের সর্দার, রোশনলাল তার ডান হাত। সকলের ধারণা, কালে-দিনে বাপের থেকে দ্বিগুণ দুর্ধর্ষ হবে রোশনলাল, কিন্তু এই ছেলেকেও বাপ সেদিন ক্ষমা করেনি। তিনদিন তিনরাত ঘরে তালা দিয়ে ফেলে রেখেছিল। খেতেও দেয়নি। খুপরি জানলা দিয়ে ওই হীরা চুপি চুপি কিছু খাবার ফেলে না দিলে প্রাণে বাঁচত না।
তারপর বাবা তাকে বলেছিল, সময় হলে হীরার সঙ্গে আমিই তোর বিয়ে দেব, কিন্তু তার আগে ওর গায়ে হাত দিলে কেটে দুখানা করে ফেলব।
গায়ে আর হাত দেয়নি। কিন্তু কবে যে বাবার সময় হবে তা ভেবে পায়নি।
আরো দীর্ঘ চারটে বছর কেটেছে। রোশনলালের চব্বিশ আর হীরার কুড়ি।
চিমনলাল বলেছিল, এ বছরটা কাটলে ছেলের বিয়ে দেবে। রোশনলালের মনে হয়েছিল, মায়ের মৃত্যুর বারো বছর পার হওয়ার অপেক্ষায় আছে তার বাবা। অনেক ব্যাপারে বারো বছরের সংস্কার মানে তাদের সমাজের মানুষ।
কিন্তু বিয়ে দেওয়ার সময় বাবার আর হল না। ছোটখাট রাহাজানি করতে গেছল কোথায়। পাঁজরে গুলি খেয়ে ফিরল। পরদিন শেষ।
রাতারাতি চরিত্র বদলে গেল রোশনলালের। সে দলপতি। তিনদিনের মধ্যে বাপের মৃত্যুর মর্মান্তিক প্রতিশোধ নিল। তারপর দলটাকে নতুন উদ্দীপনায় তাজা করে তুলতে লাগল সে।
হীরাকে বিয়ে এবছরের পরেই করবে। বাপের ইচ্ছের অসম্মান করবে না।
খবর পেল, সুর্যপ্রসাদের আর দলে থাকার ইচ্ছে নেই, দেশে ভদ্র জীবনযাপনের মতলবে আছে সে।
রোশনলালের আপত্তি ছিল না। বাপের আমলেও কোনো কাজে লাগেনি, এখনো ওর মত অকর্মণ্য আর কেউ নয়। কিন্তু অনুমতি পেয়েও কেন যে গেল না, তখন বোঝেনি।
কদিন ধরে একটা কানাঘুষা শুনছিল। হীরার সঙ্গে সূরযপ্রসাদের ইদানীং ভাব সাব একটু বেশিই দেখছে সকলে। আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর রোশনলাল এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। আর আসলে মেয়েটাই বজ্জাত, তাও জানে। যখন-তখন হীরাই ওকে ডাকে। মেয়েদের মন জুগিয়ে চলার মতো মরদ ওর দলে এক সুর্যপ্রসাদ ছাড়া আর কে আছে!
তবু মেজাজ বিগড়েছিল একদিন। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে ওদের দুজনকে হাসিমসকরা করতে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। তার হাতের একটা চড় খেয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়েছিল সূরযপ্রসাদ। তারপর। উঠে খরগোশের মত পালিয়েছিল।
হীরা ফুঁসে উঠেছিল, ওকে মারলে কেন? জবাবে চুলের মুঠি ধরে তার মাথাটাও পাথরে বারকয়েক ঠুকে দিয়েছিল রোশনলাল।
শিকারে বেরিয়েছিল, দুদিন বাদে ফিরে দেখে ঘরে হীরা নেই। তারপর দেখা গেল সুর্যপ্রসাদও নিখোঁজ।
এত সাহস দুনিয়ায় কারো হতে পারে রোশনলাল কল্পনা করতে পারে না।
তারপর থেকে রোশনলাল ক্ষিপ্ত, উন্মাদ। অনেকবার রক্তরাঙা হয়েছে তার এই দুটো হাত।
সমস্ত অঞ্চল আঁতিপাতি করে খুঁজেছে। সন্দেহবশে কোথা থেকে কোথায় ছুটে গেছে ঠিক নেই। সভ্য দুনিয়া তাকে পেলেই ধরে ফাঁসিকাঠে ঝোলবে জানে, তবু গেছে।
কিন্তু ওরা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কবছরের মধ্যে সন্ধান মেলেনি। এই চার বছরের মাথায় মিলেছে।
রাতের অন্ধকারে চারজন যোগ্য সঙ্গী নিয়ে একদিন রোশনলাল পা ফেলেছে এই দুশ মাইল দূরের এলাকায়। তার চোখে সাদা আগুন, চোয়াল দুটো লোহার মত শক্ত
রাতেই খবরাখবর নেওয়া শেষ।
পরদিন সকালে পুরুষেরা সব চলে যাবে চার মাইল দূরের হাটে। সুরপ্রসাদও যাবেই। রোশনলালের সঙ্গীরা যেমন করে থোক সেখান থেকে তাকে গায়েব করবে। নিতান্ত না পারে যদি, সেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করবে তাকে।