তবু আশা বন্ধু? এখনো আশা?
এখনো কিছু দেখতে বাকি!
এখনো ভাবো, আরো একটু থাকি!
এখনো আশা, নতুন কণ্ঠে শুনবে ভাষা?
শোনো বন্ধু, অরণ্যে দাউদাউ দাবাগ্নি জ্বলে
সেই আগুনে বস্তু পোড়ে, অরণ্যের প্রাণ পোড়ে না।
তোমাদের এই সভ্যতার আলোর তলায় মশাল জ্বলে,
এই আগুনে মানবতা পোড়ে, বস্তু পোড়ে না।
নতুন অরণ্য জাগে।
ঋতুস্নাতা ধরণীর অনুরাগে।
কিন্তু তোমার নগরে নতুন মানুষ কারা?
মানবতা-পোড়া বস্তুর, সন্তান যারা?
অনেক তো দেখেছ বন্ধু,
অনেক জেনেছ,
শক্তির দম্ভ আর লোভীর হীনতা
পণ্ডিতের দর্প আর জ্ঞানীর মূঢ়তা
প্রাচীনের গর্ব আর নবীনের ক্লীবতা
এরা কি শোনাবে বলো নতুন দিনের বারতা?
অনেক দেখেছ বন্ধু, অনেক জেনেছ।
তবু আমিও তোমারই মত কিছু আশা চাই,
তাই ডাকি বন্ধু, চলো,
এবারে অকৃপণ উদাত্ত গম্ভীর জঙ্গলে যাই।
বই ফেলে দিয়ে কলম হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম, কি লেখা যায়, কেমন করে উপযুক্ত ঘা দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে শুভবুদ্ধিই মনে জাগল। সব থেকে ভালো অবজ্ঞা করে যাওয়া, এর অস্তিত্বই অস্বীকার করা। এ ধরনের অবাঞ্ছিত বইয়ের বিরুদ্ধে জোরালো রকমের হাঁকডাক করলেও অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের কৌতূহল বাড়বে। একবার পড়ে দেখার জন্যও বইখানা হয়ত বা তাদের কেনার আগ্রহ হবে। তাদের প্রতি গুরুদায়িত্বের কথা ভেবেই কলম বন্ধ করলাম।
না, সমালোচনা লিখব না।
তমোঘ্ন
এই পাহাড়ী মরুরাজ্যে হৃদয়ের চাষ নেই। পাহাড়গুলো সব অতিকায় হাড়গোড় বার-করা পাথরের স্তূপ। বড় বড় গাছগুলোর প্রায় বারো মাসই কঙ্কাল-মূর্তি। সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত মাথার ওপর সূর্য জ্বলে। শুকনো হাঁ-করা মাটির রং বাদামী। দূরে মরুভূমি।
এখানে সব থেকে দুর্লভ মানুষের হৃদয় নামে বস্তু।
মানুষগুলো খেতে না পাক, নেশা করে। এই বস্তুর জন্য ওরা প্রাণ দিতে পারে, প্রাণ নিতে পারে।
কিন্তু পুরুষদের সব থেকে বড় নেশা ভাটিখানা বা ঘরের তৈরি রক্তে-আগুন ধরানো পচাই নয়। তার থেকেও অনেক বড় নেশা আছে।
প্রতিশোধের নেশা।
চকচকে ছুরির ফলা বুকে আমূল বিদ্ধ হলে ফিনকি দিয়ে তাজা রক্তের ফোয়ারা ছোটে যখন, ওদের সে উল্লাস দেখলে এই সভ্য দুনিয়াটাকে বহু শতাব্দী পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া চলে।
চিমনলালের ছেলে রোশনলাল দীর্ঘ তিন বছরে এই একটি নেশার সাধনায় স্তব্ধ হয়ে আছে।
প্রতিশোধ!
দুটি মৃত্যু চাই তার। এমন মৃত্যু যা কখনো কেউ কল্পনা করতে পারে না। একটা মৃত্যু অন্তত সেই রকম হবে। একটা একটা করে চোখ উপড়ে নেবে, একটু একটু করে গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেবে–আরও অনেক পরে আসবে মৃত্যু।
আর একটা মৃত্যু কেমন হবে, রোশনলাল এখনো স্থির করে উঠতে পারে নি। সেও চমকপ্রদ যে হবে সন্দেহ নেই।
প্রতিশোধের এই লগ্নকাল উপস্থিত। রোশনলাল হদিস পেয়েছে ওদের। দলের একজন দূরে চলে গেছল, সে ফিরে এসে হদিস দিয়েছে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে এক ছন্নছাড়া গাঁয়ে বাসা বেঁধেছে ওরা।
খবরটা শোনামাত্র শিরায় শিরায় কী কাণ্ড ঘটে গেছে তা শুধু রোশনলালই জানে। আর অনুমান করতে পারে তার অতি বিশ্বস্ত প্রধান চারজন সঙ্গী।
দুশ মাইল আর কতদূর?
রোশনলাল বাপের মন্ত্রে দীক্ষিত। প্রতিশোধ কী করে নিতে হয় সেটা সে বারো বছর বয়সে স্বচক্ষে দেখেছে।
অবশ্য সেও সেদিন বাপকে ঘৃণা করত আর ভয় করত। পছন্দ বরং তখন মাকেই করত। বেশ সুশ্রী ছিল তার মা।
সেই রাতটা মনে আছে রোশনলালের।
তারা থাকত তখন পশ্চিমঘাটের এক পাদার আশ্রয়ে। সেখানকার কর্মচারী ছিল তার দুর্দান্ত বাবা। পাদ্রী জোসেফের ঘরে থাকত তার আট বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। হীরা-হীরা জোশেফ। সকলে বলে কুড়নো মেয়ে, অনেকে আড়ালে বলে জোশেফেরই মেয়ে। ওই মেয়েটাকে মা ভারী ভালবাসত।
কদিন ধরে মায়ের মুখখানা খুব শুকনো দেখছিল রোশনাল। নিশ্চয় বাবার ভয়ে। বাবাকে যমের মত ভয় করত মা।
…সেই একটা রাত। ঘরে মা দাঁড়িয়েছিল। সেখানে রোশনলাল ছিল আর হীরা ছিল। দেয়ালে টাঙানো মস্ত একটা ছবি ছিল। ছবিতে খোলাচুল লালচে রঙের একটা মেমসাহেব, তার বুকে মাখমের ডেলার মত একটা ছেলে। মা সেই দিকে চেয়ে ছিল। রোশনলাল জিজ্ঞাসা করেছিল, ওরা কারা?
বিড়বিড় করে মা কী যে জবাব দিয়েছিল কিছুই বোঝেনি। বলেছিল, বিশ্বমায়ের কোলে মানবপুত্র বিশ্বশিশু।
না বুঝলেও রোশনলালের একটা দৃশ্য ভাবতে বেশ ভালো লেগেছিল। সেও একদিন ওই ছবির বাচ্চাটার মতো ছোট ছিল, আর তার মা হয়ত তখন অমনি তাকে বুকে করে দাঁড়িয়ে থাকত।
বাবা হঠাৎ ঘরে ঢুকে মা কে ডাকতে এসেছিল। মা চমকে উঠেছিল। বলেছিল, যাবে না।
সেই রাতে বাবার হ্যাঁচকা টানে ঘুম ভেঙে গেছল। পাশে চোখ যেতেই রোশনলাল ভয়ে নীল হয়ে গেছল। মায়ের দেহ রক্তে ভাসছে।
বাবার সেই মুখের দিকে চেয়ে অস্ফুট আর্তনাদও করতে পারে নি রোশনলাল। বাবা তাকে তুলে নিয়ে যে-ঘরে ঢুকেছে সেটা পাদ্রী জোসেফের ঘর। সেও মৃত। রক্তে ভাসছে। অদূরের শয্যায় হীরা ঘুমিয়ে। বাবা তাকে তুলে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে।
তিন-চারটে রাতের অন্ধকারে অন্ধকারে কোথায় কতদূরে চলে এসেছিল জানে না।
যেখানে এসেছিল, সেখানে চেনা-মুখ দেখেছে জন-কতক। বাবার বন্ধু। মাঝে মাঝে পাদ্রী জোসেফের ওখানে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করত তারা।