এইবার মনে পড়ল, ওর বাপের মুখে কী শুনেছিলাম। বাপ দুঃখ করে বলছিল, মেয়েটা যা-ও একটা ভালো চাকরি পেয়েছিল, টিকতে পারছে না। ছাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কী যে মতিগতি হয়েছে আজকাল, ছেলে-ছোকরা ছেড়ে বাপের বয়সী অফিসাররা পর্যন্ত সোজা রাস্তায় চলে না।
যেমন বাপ তেমনি মেয়ে। বিরক্তিকর না তো কী! এই বয়সের মেয়ে পর্যন্ত একটু উদার হতে পারে না! ফ্রয়েড বা হ্যাভলক এলিস পড়া থাকলে এই সব সামান্য সহজাত বিকৃতিগুলোকে বরং একটু দরদের চোখে দেখতে পারত। দুর্নীতির মধ্যে পা না বাড়িয়েও সহজ একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলার বলিষ্ঠ চিন্তা এদের মাথায়ই আসে না। নীতি-নীতি করেই গেল সব, এই সামান্য কারণে একেবারে চাকরিই ছাড়তে
বিরক্তি চেপে ওকে বললাম, আমাদের কাগজের অফিসে মেয়েদের কোনো স্কোপ নেই। এও বললাম, এতেই যদি চাকরি ছাড়তে হয়, তাহলে তার উচিত কেনো মেয়ে-স্কুলে চাকরি নেওয়া।
ওপরে এসে আবার ওই জঙ্গল-ভক্ত কবির বইটাই খুলে বসলাম। প্রথমেই যে জায়গাটায় চোখ পড়ল, মনে হল চোখে যৈন পটপট করে ইনজেকশন ফোটাচ্ছে কেউ :
…তাই বলি বন্ধু, যদি সঙ্গী পাই
তবে খাঁটি সবুজ জঙ্গলে যাই।
যেখানে হিংসা খাঁটি,
আর সরলতাও।
যেখানে বাঘ ভালুক হায়না–
আপন মুখ মুখোশে ঢাকে না।
যেখানে হিংস্র চকিত হুঙ্কারে।
ভক্ষ্য হরিণের ঘাড়ে লাফায়,
রক্ষা করবে বলে তাকে
বৃথা আশ্বাসে ভোলায় না।
যেখানে শ্বাপদ-হিংসা খাঁটি
আর শশকের সরলতাও।
অরণ্যে আরো ক্ষুধা নেই একথা বলি না বন্ধু,
রিপু যেখানে আদিম আর অবিকৃত
সেখানেও বনিতার খোঁজ পড়ে অবিরত।
তবু আপন-নির্ভয়ে সেথায় বনিতারে রক্ষা করা রীতি,
আর অকপট শৌর্যে তারে জয় করা নীতি।
সেখানে ক্ষুধা খাঁটি
আর বনিতার সরলতাও।
দুইই সকলে চেনে।
যেখানে অচেনা কেউ নয়, যেমন এই সভ্যতার অরণ্যে।
তাই, আমরা যারা চেনা মুখ খুঁজে বেড়াই
তারা এসো বন্ধু,
চলো, নির্ভেজাল জঙ্গলে যাই।
জেলের বই ফেলে, সহজ দম নিতে ফেলতে সময় লাগল একটু। ভেবে আর মাথা গরম করব না, লেখার যা লিখব। পারলে জঙ্গলেই পাঠাব কবিকে। খাওয়া-দাওয়ার পর অল্প একটু ঘুমনোর অভ্যাস, তারপরে অফিস।
বাসে বসেও বইটা শেষবারের মত উল্টেপাল্টে দেখছি। আর এতে ভালো করে মন না দিয়ে মনটাকেও ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করছি। বাসে কয়েকটি ছেলেছোঁকর তরল কলরব কানে আসতে মুখ তুলতে হল। বই-খাতা নিয়ে গুটিসাতেক ছেলে কলেজে চলেছে। একজনের সামনের লেডিস সীটের একটা পাশ খালি, অন্য পাশে বছর পঁয়তিরিশেকের এক মহিলা বসে। মহিলার শৌখিন বেশবাস, চোখে পুরু কালো গগলস। রসিকতা করে ছেলেরা সকলকে শুনিয়েই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, মহিলার পাশের ওই খালি সীটটাতে কেউ বসবে কিনা।
শেষে একটি ছেলে জিজ্ঞাসাই করে বসল, ও দিদি, বসব একটু?
না। মহিলা ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন, তোমরা আর একটু ভদ্র হলে বলতে হত না, আমিই বসতে বলতাম।
আর যায় কোথায়, ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ল যেন। ছেলেরা তর্জন-গর্জন করে উঠল, এতবড় কথা! আমরা অভদ্র! মেয়েছেলে বলে যা মুখে আসে বলে পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন? ফর্সা জামাকাপড় পরে আর স্টাইল করে চোখে গগলস চড়ালেই মেয়েরা ভদ্র হয়ে যায়, কেমন?
বাসের দুই-একজন থামাতে চেষ্টা করল তাদের, কিন্তু তার ফল বিপরীত হল। অল্পবয়সী ছেলে সব, সত্যিই চটেছে। মারমূর্তি হয়ে তারা বলতে লাগল, কেন, কেন এই কথা বলবে আমাদের, এই সব মেয়েছেলের এত সাহস কেন? মহিলাকেই চড়াও করল আবার, আপনার মত ফ্যাশানেবল মেয়েদের খুব চিনি আমরা, বুঝলেন? আপনার মত কালো চশমা পরা মেয়েদের জানতে বাকি আছে আমাদের ভাবেন?
ক্রোধে ক্ষোভে মহিলারও আর এক মুর্তি। বলে উঠলেন, না বাবারা, এরই মধ্যে তোমরা সবই জেনে ফেলেছ, কিছুই আর জানতে বাকি নেই তোমাদের। তবে নীল চশমা কেন পরি? এই দেখো, দেখো–
বলেই একটানে চশমাটা খুলে ফেললেন তিনি। তার মুখের দিকে চেয়ে বাসের সকলেই ধাক্কা খেল একটু–ছেলেরাও চুপ কয়েক মুহূর্ত। তার এক চোখ পাথরের, এবং পাতা পড়ে না–দেখলেই অস্বস্তি হয়।
তিনি চশমাটা ফিরে পরতেই ছেলেরা আবার ক্ষেপল, আমরা এরই মধ্যে সবই জেনে ফেলেছি, কিছুই জানতে বাকি নেই–এ-কথার মানে কি? একবার অভদ্র বলেছেন, আবার আমাদের ক্যারেক্টার ধরে টানাটানি! আমরা কৈফিয়ৎ চাই, ওই চোখ দেখিয়েই আপনি আমাদের ভোলাবেন ভেবেছেন?
দাঁতে করে ঠোঁট কামড়ে বসে আছেন মহিলা। চেঁচামেচি আরো বাড়ার আগেই ছেলেদের গন্তব্যস্থান এসে গেল। আমারও। ছেলেরা শাসিয়ে গেল, তারা ছাড়বে না, এই পথে আবার দেখা হলে ভালো হাতেই মহিলাকে জবাবদিহি করতে হবে, কলেজের ছাত্রকে অপমান করে অত সহজে পার পাওয়া যায় না, ইত্যাদি।
মনে মনে আমিও ওই মহিলার ওপরেই বিরূপ হয়েছিলাম। অল্পবয়সের হাসি-খুশি ছেলে-ছোকরার দল, দেশের ভবিষ্যৎ বলতে গেলে ওরাই–কী দরকার ছিল মহিলার এভাবে ওদের বিগড়ে দেওয়া না হয়! করছিলই একটু রসিকতা, এলিস তো বলেছেন, এ-সব হল এক ধরনের সেফটি ভালভ–না সবেতেই অধৈর্য, গায়ে যেন ফোস্কা পড়েছিল।
অফিসে বসে লেখার আগে আর একবার সেই জঙ্গলের কাব্য খুলেছি। পড়বি তো-পড় এমন জায়গাই চোখে পড়ল যে হাতের কলম আছড়ে মারতে ইচ্ছে করে :