- বইয়ের নামঃ চলো জঙ্গলে যাই
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আশা আর বাসা
ছিল পোস্টমাস্টারের মেয়ে। নিজে কিছুকাল করল স্কুল-মাস্টারি। তারপর হয়ে পড়ল কলেজের মাস্টারের বউ।
জীবনের এই কোনো ক্ষেত্রই পছন্দ নয়। পোস্টমাস্টার বা স্কুল-মাস্টার অথবা কলেজের মাস্টার যে তার চক্ষুশূল এমন নয়, বরং পোস্টমাস্টার বাবাটিকে সে ভালই বাসত, তার সদা খুঁতখুঁতে মনোভাব দেখে বেশ মজা পেত। ড্রয়ারে একটা কাগজ রাখলেও তিনবার করে খুলে দেখতেন ঠিক রেখেছেন কিনা। কারো হাতে একটা দশ টাকার নোট দিলে দুতিনবার অন্তত সেটা টেনে নিয়ে আঙ্গুলে ঘষে দেখতেন একটার জায়গায় দুটো বেরিয়ে গেল কিনা।
নিজে যতদিন স্কুল-মাস্টারি করেছে ততদিন খুব যে নিরানন্দে ছিল তাও নয়। বরং সমবয়সী সতীর্থদের সঙ্গে হেসে-খেলে দিন কাটিয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে।
আর কলেজের মাস্টারের বড় হবার জন্যেও কেউ তাকে বাধ্য করে নি। নিজের ইচ্ছেতেই হয়েছে। ঘরে প্রায় সর্বদাই পাঠ আর পঠনরত অল্পবয়সী একটি সিরিয়স মুখ দেখে এক-এক সময় সে বেশ কৌতুকই অনুভব করত। কোন সময় বা টেনে টেনে ছড়া কাটত, রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা। ফলে ইতিহাসের তরুণ মাস্টারের অনেক সময়ই পাঠ-পঠনের মনোযোগ রসাতলে যেত। তার হাসিতে প্রমাণ মিলত হাসির রসদ পেলে তার হাসতে তেমন মানা নেই, আর রাতের নিভৃতে এই টিপ্পনীর দরুণ দস্তুরমত হামলা করে চড়ামাশুলও আদায় করতে চেষ্টা করত। তখন সমর্পণের হাল ছাড়তে খুব মন্দও লাগত না।
তবু এই তিনের একটা ক্ষেত্রও যে পছন্দ নয় তার কারণ ওর নিজের চরিত্রগত উচ্ছলতা। ওই তিনের কোন ক্ষেত্র থেকেই সেটা পরিপূর্ণ রসের জোগান পেত না। উচ্ছল সত্তা বিকশিত বা বিস্তৃত হবার মতো সেগুলির একটাও তেমন প্রশস্ত নয়, উর্বর নয়-মানিয়ে নিতে পারলে দিন এক রকম করে কাটে, এই পর্যন্ত। কিন্তু বর্ণশূন্য দিনযাপনের সহিষ্ণুতা তার কম। বরং বর্ণের অনুশীলনে সেটা কত ভাবে কত রকমে উজ্জ্বল হতে পারে সেই কল্পনার সঙ্গে তার মানসিক যোগ।
এরও কারণ আছে।
নাম রাখি। আগে গাঙ্গুলি ছিল। কলেজের মাস্টারের ঘরে এসে চক্রবর্তী হয়েছে। রাখি চক্রবর্তী। বর্ণবিলাসী কল্পনার সঙ্গে তার মানসিক যোগের কারণ বিশ্লেষণ এই নাম থেকেই শুরু করা যেতে পারে।
ওর বাবারা পাঁচ ভাই। জলপাইগুড়িতে একান্নবর্তী পরিবার। তাদের কেউ স্কুল মাস্টার, কেউ উকিল, কেউ কেরানী। বাবা পোস্টমাস্টার আর ছোট কাকার স্টেশনারি দোকান। রাখির বাবা সেজ। রাখির চারটি নিজস্ব দাদা। বড় জ্যাঠা আর মেজ জ্যাঠার চারটি করে ছেলে। বড় কাকার ছয় ছেলে। ছোট কাকার পাঁচ ছেলে। সব মিলিয়ে বাড়িতে ছেলের সংখ্যা তেইশ। আর একটি মাত্র মেয়ে–সে রাখি। মেজ জ্যাঠার নাকি একটা মেয়ে হয়েছিল। সে দেড় বছরের বেশি টেকেনি। বাড়িতে মেয়ের দুর্ভিক্ষ। সাধারণত লোকে ছেলে হলে খুশি হয়, কিন্তু এ বাড়িতে ছেলের মুখ দেখতে দেখতে এমন অবস্থা যে ছেলে হলে মন-মেজাজ খারাপ হয়। ছোট কাকিমার কাছে রাখি শুনেছে, ওর ছোড়দা যখন হল, মায়ের সে কি কান্না! কে নাকি হাত দেখে মাকে বলেছিল এবারে ছেলে হবে!
এহেন পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ আগন্তুক কন্যা। স্বভাবতই তার আদর, তার কদর, তার প্রশ্রয় অন্যরকম। ও এসেছে তাই আনন্দ ধরে না, শেষ পর্যন্ত টেকে কি টেকে না ভিতরে ভিতরে সেই শঙ্কা। সেই কারণেই নাম–রাখি। তা ছেলেবেলা থেকে সকলে মাথায় করেই রেখেছে তাকে। বৃহৎ পারিবারে অনটনের ছায়া পড়েই ছিল। কিন্তু সেটা একমাত্র ওকেই স্পর্শ করে নি কোনদিন। যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। বাবা না দিলে কাকা-জ্যাঠারা দিয়েছে। বছর পনের বয়েস পর্যন্ত অন্তত চাইলে পাবে না এমন কিছু আছে বলেই সে ভাবতে পারত না। তার চোখে তখন পর্যন্ত সমস্ত দুনিয়াটাই বর্ণে গন্ধে আনন্দে ভরা।
স্কুল ফাইন্যাল থেকে বি.এ. পাস করার চারটে বছরের মধ্যে পর পর কটা বিপর্যয়ে সেই রংদার দুনিয়ার সব বর্ণ সব গন্ধ আর সব আনন্দ যেন কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল চোখের সমুখ থেকে। আর যে বাস্তব মুখব্যাদান করে তার সামনে এগিয়ে এলো সেটা যেমন নীরস, তেমনি অকরুণ। পনের বছর পর্যন্ত যে মেয়েটা সব পেয়েছে, এ বাস্তবের সঙ্গে তার আপোস করে চলাটা সহজ নয়।
ওই চার বছরের গোড়ায় বড় কাকা চোখ বুজলেন। তারপর বড় জ্যাঠা। শেষে বি. এ. পাস করার ছমাস আগে তার বাবা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের তাপ্লি মারা নৌকোটা হঠাৎ যেন খান-খান হয়ে গেল।
বি. এ. পাশ করার আগেই রাখি গাঙ্গুলি যেন অকূল পাথারে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। নিজের এবং খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো তেইশটি দাদার মধ্যে মতের মিল থেকে অমিলই বেশি। অনেকেই বিয়ে-থা করেছে, অনেকেই বাইরে চাকরি-বাকরি করছে–কিন্তু পৈতৃক বাড়ির বিধি-ব্যবস্থা সম্পর্কে যে যার ভিন্ন-মতে মাথা ঘামাতেও কসুর করছে না। একান্নবর্তী পরিবারের জমিজমা কিছু ছিল।! চার বছরের মধ্যে সেসব শূন্যে মিলিয়ে গেল। পৈতৃক বাড়িতে যারা থাকে তাদের প্রতি যারা থাকে না তাদের যেন একধরণের অনুকম্পামিশ্রিত উদারতা। ইচ্ছে করলে ওই বাড়িও বেচে দেওয়ার দাবি তোলা যেতে পারে, ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে গেলে তো কারো ভাগেই কয়েকখানা করে ইট-কাঠের বেশি কিছু পড়বে না। অতএব বেচে দেবার দাবি না তোলাটা প্রকাশ্য উদারতা ছাড়া আর কি!