Site icon BnBoi.Com

কথামালা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

Ashutosh Mukherjee

আপস

এটা গল্প ঠিক নয়, মনস্তত্ত্বগ হিউম্যান বিহেভিয়ারিজম বা মানবিক আচরণের একটা অতিবাস্তব নজির বলা যেতে পারে। পল্লব গুপ্ত বয়সে আমার থেকে ঢের ছোট হলেও বন্ধুস্থানীয়। দাদা বলে ডাকে কিন্তু জিভ ছুটলে মনে-মুখে লাগাম নেই। এক-এক সময় ওর কথা শুনলে আমারই কানের ডগার রং বদলায়। কিন্তু ও-ছেলের এতটুকু সংকোচের বালাই নেই।

এক-একজন থাকে যার স্বভাব-চরিত্রের অবাঞ্ছিত দিকগুলোও বেশ অনায়াসে বরদাস্ত করা যায়, অন্যায় করে বেড়ালেও খুব অসহ্যরকমের অন্যায় মনে হয় না। সেগুলো দোষের ব্যাপারগুলো জানা থাকলেও তার সঙ্গ-সান্নিধ্য ভাল লাগে। পল্লব গুপ্ত সেই জাতের একজন।

পৈতৃক অবস্থা ভাল, নিজে মস্ত ফার্মের মোটা মাইনের পাবলিক রিলেশনস অফিসার। অনেকের মতে, এই চাকরিটাই ওকে আরো তরল-মতি করে তুলেছে। পকেটে সর্বদা দামী সিগার মজুত, হাতেও একটা জ্বলছেই। বড় বড় পার্টিকে বশে আনার দায় তার, সেই কারণে ওর কোম্পানির অঢেল খরচা করতেও দ্বিধা নেই –আর তাদের চিত্তবিনোদনের এই সব খরচাই হয়ে থাকে পল্লব গুপ্তর মারফত। পি. আর. ও.পাবলিক রিলেশনস অফিসার, অতএব সে-ই হোস্ট। ফলে, বড় বড় ড্রিঙ্ক পার্টিতে সকলের কাছে নিজেকে ইনটারেস্টিং করে তোলাটা চাকরির অঙ্গ। আর তার ফলে দস্তুরমত পানাসক্ত যে হয়ে পড়ছে এও নিজেই স্বীকার করে। নিজেই এক-এক সময় বলে, এ-শালার চাকরি থেকে কোনো একদিন রিটায়ার করার পর অবস্থাখানা যা হবে আমার, স্বভাব-চরিত্র একেবারে খেয়ে দিলে। কিন্তু এ নিয়ে ও সত্যি এতটুকু দুশ্চিন্তায় পড়েছে এ কোনদিন মনে হত না। পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে তাতেও দুই-এক পুরুষ চোখ বুজে জাহান্নমে যেতে পারে।

পল্লব গুপ্তর স্বভাব-চরিত্রের আরো একটা দুর্বল দিক আছে। সেটা সুরূপা রমণী সংক্রান্ত। দিলখোলা হাসি-খুশি মিষ্টি চেহারার ছেলেটার মেয়েমহলেও বেশ কদর। এই ব্যাপারে বারকয়েক বিপাকে পড়তে পড়তে কোনরকমে পিছলে বেরিয়ে এসেছে। তবু মেয়েদের নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করে আনন্দে কাটানার নেশাটা ছাড়তে পারেনি। একবার এক উঠতি ফিল্ম-আর্টিস্টের পিছনে এমন মেতে গেল যে চাকরি-বাকরি শিকেয় ওঠার দাখিল। আমরাও ধরেই নিলাম ওই ফিল্ম-আর্টিস্টই ওর গলায় ঝুলল। শেষে একদিন ও এসে নিজে থেকেই বলল, বাপের পুণ্যিতে খুব কাটান দিয়ে এলাম দাদা–বারোটা বেজে গেছল আর কি!

কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করেছি, এত কি ভয়ের ব্যাপার ছিল?

-আর বলেন কেন দাদা, এমন বুদ্ধ বনে গেলাম না যে নিজেকেই রামছাগল বলে গালাগাল না দিয়ে পারলাম না। আচ্ছা দাদা, আপনার কাছেও তো এনেছিলাম একদিন, নিজেই দেখেছেন–এমন নরম-সরম মিষ্টি হাবভাব দেখলে কোন শালা না। ধরে নেবে অক্ষত কুমারাটি একেবারে–আরও ভেবেছিলাম বারো ভূতে দেবে অমন একটা মেয়েকে লুটে-পুটে শেষ করে, তার আগে নিজেই পাকাপাকি দখল নিয়ে বসি। অনেকটা এগিয়েও ছিলাম বেশ, শেষে বলে কিনা, তোমাকে ছাড়া আর আমার চলছে না–এবারে ডিভোর্স স্যুট ফাইল করা যাক একটা, খরচপত্র যা লাগে তুমিই দেবে কিন্তু বাপু। শেষে জেরায় এগিয়ে আমি তো চিত্তির–শুধু বিবাহিতা নয়, দুদুটো মেয়ে আছে মহিলার!

-তারপর?

-তারপর আর কি, আমি বললাম, তার ডিভোর্স সহজ হলেও আমার ডিভোর্স সহজ হবে না, আমার গৃহিণীটি আঁশ-বঁটি নিয়ে তাড়া করবে দুজনকেই। আমিও বিবাহিত শুনে সে প্রথমে তাজ্জব, তারপর ঠক-প্রবঞ্চক রাস্কেল-টাস্কেল বলে বিদায় দিল আমাকে। আমি মনে মনে গঙ্গার চান সেরে সোজা আপনার এখানে, কারণ আপনি অবান্তরে এগোতে বারণই করেছিলেন আমাকে।

কেন বারণ করেছিলাম সঠিক বলতে পারব না, ফিল্ম-আর্টিস্টকে নিয়ে ওর সংসারযাত্রা খুব সুনির্বিঘ্ন হবে মনে হয়নি সম্ভবত। কিন্তু ছেলেটার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি। ধাক্কা খেয়ে তক্ষুনি নিজেকেও বিবাহিত বলে চালিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই গোছের আরো ছোট-খাটো দুই-একটা ধাক্কা খাবার পরেও ও-যে রমণীসঙ্গবিরহিত জীবন যাপন করছে, এমন নয়। এখনো অনেক সময় অনেক রকম মেয়ের সঙ্গে ওকে মেলামেশা করতে দেখা যায়। আর অম্লানবদনে নিজের এমন সব কীর্তির কথা বলে যে সাধারণস্থলে কান গরম হবার কথা। কিন্তু পল্লব গুপ্তর বলার ঢংটাই এমন-যে না শুনে পারা যায় না–শোনার পর ধমক-ধামকের প্রশ্ন।

এ-হেন পল্লব গুপ্ত একদিন এসে মুখ বেজার করে বলল, এবারে সত্যিই একটা যন্তন্নার মধ্যে পড়ে গেলাম দাদা, কি যে করি

জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার–কোনো মেয়ে?

–তাছাড়া আর কি!

–আবার ফেঁসেছ?

–ফেঁসে যাবার জন্য এবারে তো আমি হাঁ করে আছি, কিন্তু সে-ভাগ্য হবে কি হবে না সেই চিন্তাতেই তো এত যন্ত্রণা! আচ্ছা দাদা, এর নামই কি প্রেম?

জবাব না দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, মেয়েটা কে, আবার কোনো ফিল্ম আর্টিস্ট?

-না না, সে-রকম কিছু নয়–সোজাসুজি এক ভাল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে-বলেই ফেলি আপনাকে, আমার মাসির ভাশুরের মেয়ে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে দেখেছিলাম মেয়েটাকে, ভাল করে ফিরেও তাকাইনি–তখন বিশ বছর বয়েস আমার, আঠেরো বিশের শাড়ি-পরা সেই সব ডবকা ইয়ের মেয়ে ভিন্ন কারো দিকে তাকাতামই না। কিন্তু সেই চৌদ্দ বছরের মেয়ে যে বাইশ বছর বয়সে এ-রকম হয় তখন কি ছাই একবারও মনে হয়েছে। বিশ্বাস করবেন না দাদা, পাশ ঘেঁষে চলে গেলেও মনে হয় গায়ে এক ঝলক গরম বাতাসের ঘেঁকা লাগল। আর চোখে চোখ রেখে হেসে হেসে কথা বলে যখন, উঃ! এক গেলাস জল খাওয়ান দাদা

হাসি চেপে জল এনে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কতদিন এই দশা চলেছে। তোমার?

টানা দুমাস হয়ে গেল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দাদা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে চোখের মধ্যে কেবল ওই মঞ্জরী সেনই ঘুরপাক খাচ্ছে দিবারাত্র।

–তোমাকে সে-রকম পাত্তা দিচ্ছে না?

-একেবারে দিচ্ছে না বললেও ঠিক হবে না। হাজার হোক বাপের বিষয়ের সুপুর হয়ে বসেছি, ভাল চাকরি করি, নিজের একটা ঝকঝকে গাড়িও আছে-সকলের চোখে আমার দাম যে কিছু আছে সেটা ও মেয়েও বোঝে। কিন্তু ওই চেহারাপত্তর নিয়ে সে এই বাইশ বছর পর্যন্ত নিজেকে আগলে বসে আছে বর্গে তো বিশ্বাস হয়। না–দখলদারির জন্যে কে হাঁ করে আছে জানতে পারলে তবে তো ডুয়েল-টুয়েল লড়তে পারি–সেটাই যে কিছু আঁচ করতে পারছি না। মাসির মুখে শুনেছি, এম. এ. পাস না করে বিয়ে করবে না ঘোষণা করেছিল নাকি-কিন্তু আসলে সেটা কাউকে কিছু সময় দেবার ছল কিনা কে জানে-এবারে এম. এ. পাস করেছে শুনে আমার বুকের প্যালপিটেশানে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে।… ভাল কথা, মঞ্জরীর সঙ্গে কাল কিছু সাহিত্য-আলোচনা হয়েছিল। সেই কবে ইংরেজিতে এম. এ. পাস করেছিলাম, এতদিনে। সব গুলে খেয়ে বসে আছি! আর বাংলা সাহিত্যের দৌড় বঙ্কিম আর শরৎ পর্যন্ত, তাও বঙ্কিমের নায়িকার সঙ্গে শরৎবাবুর নায়িকা গুলিয়ে গেছে-কিন্তু মঞ্জরী দেখলাম আধুনিক সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, আপনার নামও দু-চারবার করল, কি ছাই লিখেছেন খানকতক বই বার করুন তো, প্রেসটিজটা বাঁচাই–

ওর পাল্লায় পড়লে আমারই প্রেসটিজের দফারফা হবার ম্ভাবনা। কিন্তু আলমারির বইয়ের কলেবর দেখে পল্লব আঁতকে উঠল।-এ আমার পড়ার সময় হবে কখন! তার থেকে বরং দু-চারখানা বইয়ের পাঁচ-সাত লাইনের মধ্যে জিস্ট বলে দিন তাই দিয়েই সামলে নেব।

অব্যাহতি পাবার আশায় বললাম, তার থেকে তুমি বরং কিছু জানান না দিয়ে মঞ্জরী সেনকে এখানে একদিন ধরে নিয়ে এসো, সে তার ইচ্ছেমত বই বেছে নেবেখন, আর সাহিত্যিকদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে এও ধরেই নেবে।

ও বলল, মতলবটা ভালই দিয়েছেন। দেখা যাক।

যাবার আগে মঞ্জরী সেন সম্পর্কে আরো একটু খবর দিল পল্লব গুপ্ত। সমবয়সী মাসতুতো ভাই বলেছে, মঞ্জরী সে-রকম কোন ছেলেকে ধরে বসে আছে বলে মনে হয় না। তবে একটা ছেলে–তার নাম অনিমেষ সরকার, সে এখনো প্রায়ই ওদের। বাড়িতে আসে। আগে মঞ্জরীদের পাড়াতেই থাকত সেই লোক, ভাড়া না পেয়ে বাড়িওলা কেস করে তাদের উঠিয়েছে। লোকটা রাজনীতি করত, জেল-টেলও খেটেছে। মঞ্জরী নাকি আদর্শ নিয়ে খুব মাথা ঘামায়, তাই তার কাছে এই লোকটির কদর। তাকে নিয়ে মঞ্জরীর ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে কিনা সেটা অবশ্য মাসতুতো ভাই সঠিক বলতে পারল না। ওদের বাড়ি গিয়ে সেই অনিমেষ সরকারকে মঞ্জরীর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছে পল্লব-একদিন নয়, দুদিন দেখেছে। আর তারপর থেকে গুণ্ডা লাগিয়ে খতম করা যায় কিনা সে-কথাও ভাবছে।

সব মিলিয়ে বোঝা গেল মঞ্জরী সেন নামে একটা মেয়ের জন্য পল্লব গুপ্তর এখন আহার-নিদ্রা ঘুচতে বসেছে।

সত্যিই মঞ্জরীকে একদিন বাড়ি নিয়ে এলো সে। আর আমারও ভালই লাগল। রূপসী না হোক বেশ সুন্দরীই বটে। আর সমস্ত মুখে ভারী একটা লাবণ্য মাখা। আমি পল্লবের প্রশংসা করলাম খুব, আর খানকতক বইয়ে তার নাম লিখে দিলাম। পরদিনই পল্লব লাফাতে লাফাতে এসে হাজির।

–দাদা, কাল আমার প্রেসটিজ যে কি বেড়ে গেছে ভাবতেই পারবেন না–বেরিয়ে এসে আমাকে চোখ রাঙালো, এ-রকম একজন লোকের সঙ্গে এত খাতির আমাকে কক্ষনো বলেননি পর্যন্ত! দাদা, আপনি যে এ-রকম একজন লোক সে তো আমিও এই প্রথম শুনছি!

আমার হাসিই পাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, অনিমেষ সরকারের খবর কি?

হেসে হেসে পল্লব বলল, অনিমেষ সরকারের?–তার বরও মাসতুতো ভাইয়ের মুখে যা শুনলাম আশাপ্রদ। আমার বরাত-গুণে লোকটা নিতান্ত গরীব–আর এরই মধ্যে নাকি কতগুলো ছোট ছোট ভাই-বোন রেখে তার বাবা মারা গেছে–বাবার বদলে অনিমেষ সরকার গেলে আরো একটু খুশি হওয়া যেত। তবে আর একটা ভাল খবর শুনলাম, মঞ্জরীর মা নাকি সাংঘাতিক গরীব ঘরের মেয়ে ছিল, রূপের জোরে সুখের ঘরে এসেছে। তাই মেয়ের কোন গরীব ছেলের সঙ্গে চেনা-জানা আছে শুনলেও নাকি ত্রাস তার। এই কারণেই অনিমেষ সরকারকে মা দুচক্ষে দেখতে পারে না। আর মাসতুতো ভাই বলে মঞ্জরীও গরীবানা চালে থেকে অভ্যস্ত নয়–যতই আদর্শ আর্শ করুক।

এরপর পল্লব গুপ্ত আবার একদিন এসে আনন্দের আতিশয্যে আমাকে ধরে দুটো ঝাঁকানি দিল। তারপর বিয়ের নেমন্তন্ন-পত্র হাতে দিল। বলল, এ যে এত সহজ ব্যাপার হবে ভাবতেও পারিনি দাদা–ওদের লক্ষ্যও যে আমি এ কি ছাই আগে বুঝেছি! তাহলে নির্লিপ্ত থেকে নিজের আর একটু কদর বাড়ানো যেত!

কিন্তু ওদের বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই আমার কেমন মনে হল সমাচার ব কুশল নয়। গণ্ডগোলের সূত্রপাত মঞ্জরার দিক থেকে। দিলদরিয়া পল্লব ওর কেমন হাসাস দশা একটু। গম্ভীর মুখে মঞ্জরী একদিন আমাকে স্পষ্টই বলল, প্রথম দিন আপনি বাড়িয়ে বলেছিলেন দাদা, ওর অনেক খারাপ অভ্যাস আছে।

আমি আমতা আমতা করে বলেছি, কেন, এ রকম খোলামেলা চরিত্র

বাধা দিয়ে ঈষৎ ঝাঝালো সুরে মঞ্জরী বলল, চরিত্রেরও গলদ আছে।

বেচারা পল্লব জানালা দিয়ে মনোযোগ সহকারে রাস্তা দেখছে।

আরো মাস ছয় বাদে মনে হল গণ্ডগোলটা বেশ পাকিয়ে উঠেছে। পল্লবের সর্বই বিষণ্ণ অথবা বিরক্ত মুখ। একদিন ঘরে টেনে বসিয়ে জেরা শুরু করলাম, কি ব্যাপার সব খোলাখুলি বলো তো?

ও বলল, আমার বিরুদ্ধে অনেক মারাত্মক অভিযোগ, এ রকম জানলে ও নকি আমার ছায়াও মাড়াত না।

–কি অভিযোগ?

–প্রথম, আমার কোন রকম আদর্শের বালাই নেই।

–তারপর?

–দ্বিতীয়, সিগার।

–সিগার কি?

-আমি সিগার খাই, আমার সমস্ত গায়ে নাকি চুরুটের গন্ধ। চুমু খেতে গেলে ধাক্কা মেরে ঠেলে সরায়। ডেটল দিয়ে মুখ কুলকুচি করে আর গায়ে। সেন্ট মেখে তবে কাছে আসতে হয়–ততক্ষণে আমার চুমু খাওয়ার তেষ্টা চলে। যায়।

ওর খোলাখুলি বলার নমুনা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। পল্লব বলে চলল, তৃতীয় অভিযোগ, ড্রিঙ্ক করা। যত ভাল জিনিসই খাই ও ঠিক টের পায় আর তারপর কুরুক্ষেত্র। চতুর্থ অভিযোগও ওর কাছে তেমনি মারাত্মক–আমি মেয়েদের পিছনে ছোটাছুটি করি। আমার আগের চালচলন কিছু কিছু জেনে ফেলেছে, তাছাড়া বাড়িতে অনেক মেয়ের টেলিফোন আসে

বললাম, একটু সামলে-সুমলে চললেই তো পারো।

ও রেগে গিয়ে বলল, সব ছেড়ে-ছুঁড়ে পরমহংস হয়ে বসে থাকব? আমি তো মঞ্জরীকে শাসিয়েছি, এ-রকম করলে চাকরি-বাকরি ছেড়ে বিষয়-আশয় বিলি করে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব–তাতেও ঘাবড়ায় না!

আরো মাস তিনেক বাদে একদিন দুজনেই এসে হাজির আমার বাড়িতে। সেদিন আবার ভিন্ন মূর্তি দুজনেরই। পল্লব গুপ্ত আগের মতোই হাসিখুশি আর মঞ্জরীও যেন আগের সেই লাবণ্যময়ী মিষ্টি মেয়েটি। ওদের কথাবার্তা থেকেও বোঝা গেল মাঝের একটা বছরের সমস্ত অশান্তি আর মনোমালিন্য অপগত। এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হে, কিছু একটা ম্যাজিক-ট্যাজিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে?

খুশিতে ডগমগ পল্লব বলল, ম্যাজিক বলে ম্যাজিক–একেবারে নিদারুণ ম্যাজিক দাদা!

–কি করে হল?

–সেই অনিমেষ সরকারের কল্যাণে।

শুনে আমি অবাক।

তারপর মঞ্জরীকে ও-ঘরে আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে বসিয়ে দিয়ে ও মনের আনন্দে যে ফিরিস্তি দিল, তাতে আমি আরো অবাক। মঞ্জরী ওর সঙ্গে আপোস করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যার পরে পর্যন্ত গোটা ছয় সিগার চলতে পারে, ড্রিঙ্ক একেবারে ছাড়তে হবে না, বড় পার্টি হলে মাত্রা রেখে খেতে হবে, আর মেয়েদের সঙ্গে হৈ-হুঁল্লোড় করে বেড়ানোতেও আপত্তি নেই, তবে মঞ্জরীর অনুপস্থিতিতে সেটা করা চলবে না –যেখানে যাবে সে-ও সেখানে উপস্থিত থাকবে।

বলা বাহুল্য, পল্লব গুপ্ত সানন্দে রাজী। ম্যাজিকের ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই রকম :

…সেদিনও মেজাজপত্র, বিগড়েই ছিল পল্লব গুপ্তর। তিন দিনের মধ্যে মঞ্জরী কাছে আসেনি, ওকেও কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। সামনা-সামনি রাগও করতে পারে না পল্লব, কারণ সে রাগলে মঞ্জরী ডবল রাগে–আর তখন আরো বেশি আক্কেল দিতে চেষ্টা করে।

বিকেলে ওই রকম মেজাজ খারাপ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ফুটপাথের পাশে একেবারে একটা হ্যাঁগার্ড মার্কা লোককে দেখে গাড়ি থামাল। জামা-কাপড় আর ওই মূর্তি দেখলে কেউ তাকে ভদ্রলোক ভাববে না। তার ওপর একগাল দাড়ি, মাথার রুক্ষু চুল ঘাড় আর কান বেয়ে নেমেছে। গালের হাড় উঁচিয়ে আছে, দু চোখ গর্তয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিমেষ সরকারকে চিনতে পারল পল্লব গুপ্ত। বিয়ের আগে দু-দুটো দিন মঞ্জরীর ঘরে বসা দেখেছে-এ মুখ ভোলার কথা নয় তার।

কিন্তু অনিমেষ সরকার পল্লব গুপ্তকে দেখেও নি, চেনেও না। গাড়ি থেকে নেমে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে?

কোটরের দুই চোখ তুলে লোকটা তাকালো, বুভুক্ষু চাউনি।–আপনি…?

–আমাকে চিনবেন না, আমি আপনাকে চিনি। আদর্শ মানুষ ছিলেন, এক সময় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

লোকটার সেই ক্ষুধার্ত চোখ দুটো জ্বলে উঠল একবার। বিড়বিড় করে বলল, আদর্শ আর দেশের কাজ কোথায় আমাকে এনেছে দেখতেই পাচ্ছেন।… চেনেন যদি একটু উপকার করতে পারেন?

-বলুন?

–গোটা দশেক টাকা দিতে পারেন–ভাই-বোনদের নিয়ে তিন দিন ধরে উপোস চলছে!

পল্লব গুপ্ত চকিতে ভেবে নিল কি। তারপর বলল, আসুন আমার সঙ্গে, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব

লোকটা হতভম্বের মতো তার গাড়িতে উঠল। তাকে নিয়ে পল্লব গুপ্ত সটান বাড়ি। অকারণে হর্ন বাজিয়ে যা আশা করেছিল তাই হল। মঞ্জরী দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ থেকে অনিমেষ সরকার তাকে দেখতে পাচ্ছে না।

পল্লব গাড়ি থেকে নামল, গলা একটু চড়িয়েই ডাকল, আসুন অনিমেষবাবু! অনিমেষ সরকার যথার্থই হকচকিয়ে গিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে তার সঙ্গে ঘরে এসে বসল।

পল্লব গুপ্ত চট করে বাইরে এলো একবার। যা ভেবেছে তাই। অবাক বিস্ময়ে মঞ্জরী সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে আসছে। পল্লব তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, তোমার সেই আদর্শ পুরুষ অনিমেষ সরকার কিছু আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, তুমি এক্ষুণি ঘরে ঢুকো না।

মঞ্জরী হতভম্ব। যাকে দেখেছে ওপর থেকে সে অনিমেষ সরকার কি তার কঙ্কাল ভেবে পেল না। আর এই রকম বেশবাস…।

পল্লব বসার ঘরে ফিরে এলো আবার। দরজার ওধারে শ্রীমতীর অবস্থান স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছে। প্রতিটি কথাও ঠিকই কানে যাবে।

-তারপর অনিমেষবাবু, এটা তাহলে আপনি সত্যি কথাই বলছেন–আপনার আদর্শই আজ আপনাকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে?

ক্লান্ত স্বরে উত্তেজনা ফুটিয়ে অনিমেষ সরকার জবাব দিল, চুলোয় যাক আদর্শ –পেটের জ্বালায় সবসুদ্ধ মরলাম–এর থেকে যদি মিস্ত্রীগিরিও শিখতাম

পল্লব বলল, কিন্তু আপনি দশ টাকা চেয়েছেন, ওতে আপনার কদিন চলবে? তিনদিন ধরে তো উপোস চলেছে বলছেন

–দুদিন চললে দুদিনই বাঁচলাম। খিদের জ্বালা যে কি আপনি বুঝবেন না!

-তাই তো… ইয়ে, আমার কাছে খুব ভাল বিলিতি হুইস্কি আছে, খাবেন একটু?

-ওসব আমি কিছু খাই নে মশাই, দুটো বেলা ডাল-ভাত খাবার মতো আমাকে কিছু দিন দয়া করে!

পল্লব গুপ্ত ওদিকের দরজার দিকে তাকালো একবার। তারপর পকেট থেকে সিগার-কেস বার করল।-আচ্ছা, ভাল চুরুট ধরান একটা!

-চুরুট আমি খাই নে, আমার যা দরকার তাই দিয়ে দিন সার

—-ও, পল্লব গুপ্ত ব্যস্ত, কি করে যে আপনাকে আনন্দ দেব একটু, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না, আমার ভাল ভাল কিছু মেয়ের সঙ্গে ইয়ে মানে অন্তরঙ্গতা আছে।

–চলুন যাই, সময়টা ভাল কাটবে।

ক্রুদ্ধ অনিমেষ সরকার উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে আপনি রসিকতা করছেন কিনা বুঝতে পারছি না–এসব অভ্যেসও আমার নেই–এখন আমার দরকার শুধু কিছু খাবার-দশটা টাকা চেয়েছিলাম, অন্তত পাঁচটা টাকা দিয়ে আজকের মতো বাঁচান আমাকে।

এবারে পল্লব গুপ্ত ধীরে-সুস্থে মানিব্যাগ বার করল পকেট থেকে। অনিমেষ সরকার এদিকে ফিরে আছে, ওদিকের দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নির্বাক বিস্ময়ে মঞ্জরী দেখছে তাকে।

পল্লব গুপ্ত বলল, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব বলেছিলাম, তাই দিচ্ছি। এই নিন পঞ্চাশ টাকা

লোকটা পাগল কিনা অনিমেষ সরকার ভেবে পেল না। লোভে দুচোখ চকচক করে উঠল তার। ছোঁ মেরে টাকা কটা নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

বিবর্ণ পাংশু মুখে মঞ্জরী সামনে এসে দাঁড়াল।–কি ব্যাপার? এঁকে কোত্থেকে ধরে আনলে?

রাস্তা থেকে। উপোসের জ্বালায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে বেরিয়েছিল।… দশ টাকা চেয়েছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলাম।

একটা বড় রকমের ধাক্কা সামলে নিল মঞ্জরী। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তার জন্যে এঁকে বাড়িতে ধরে নিয়ে এলে কেন, টাকা তো পকেটেই ছিল?

পল্লব গুপ্ত জবাব দিল, এনেছি তোমার জন্যে। ড্রিঙ্ক করে না, সিগার খায় না, মেয়েদের পিছনে ছোটে না–এ-রকম আদর্শ ব্যক্তির হাল কি হয় সেটা তোমাকে দেখাবার জন্যে।… আমাকেও তুমি এই অবস্থার দিকেই ঠেলে দিচ্ছ।

মঞ্জরা হাঁ করে চেয়ে রইল খানিক, তারপর ছুটে চলে গেল।

একমুখ হেসে পল্লব গুপ্ত সিগার-কেস বার করে দামী সিগার ধরাল একটা। বলল, তারপর এই আপোস।

 ফল

ট্রেনে ওঠা মাত্র লোকটার দিকে চোখ গেল তার দুটো কারণ। প্রথম, তার ছ জঙ্কা স্লিপার বার্থ-এর খুপরিটা আমার জানলার ধারের রিজার্ভ বেঞ্চের নাক বরাবর। দ্বিতীয় কারণ, ব্যস্তসমস্ত পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার অসহিষ্ণু চিৎকার চেঁচামেচি। জিনিসপত্র গোছগাছ করা আর শয্যা বিছানোর দ্রুত চেষ্টার ফাঁকে বউটা অজ্ঞাত অপরাধে বার দুই ধমক খেল, আর ছেলে-মেয়ে কটা বার তিনেক তাড়া খেল। আমার ধারণা, এর সবটুকুই ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার দরুন।

মিনিট দশেকের মধ্যে শোয়া এবং বসার পরিপাটি ব্যবস্থা করে আধময়লা রুমাল বার করে ঘাম মুছতে মুছতে লোকটা নিজেই আগে বসে পড়ল। তারপর কর্কশ গলা যথাসম্ভব মোলায়েম করে আহ্বান জানালো, কই গো, বোসো না।… এই ছেলে-মেয়েগুলো, তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, এখন বসতে পারিস না?

হুকুম পেয়ে হুড়মুড় করে প্রথমে ছেলে-মেয়ে চারটে যে-যার পছন্দমতো জায়গা দখল করল। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে। তাদের বয়েস বারো থেকে ছয়ের মধ্যে। তাদেরও চোখে মুখে ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার ছাপ। বউটির মুখ দেখা গেল না ভালো করে, ভুরুর নিচে পর্যন্ত ঘোমটা টানা। একটু রোগা ধরনের। যতটুকু দেখা গেল গায়ের রঙ ফরসাই মনে হল। বসার আদেশ পেয়ে সেও এগিয়ে গিয়ে ওধারের জানলার। কাছে গুটিসুটি হয়ে বসল। লোকটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে সমনোযোগে দ্বিতীয় দফা জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

লোকটির বয়েস বছর ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ হবে। সঠিক অনুমান করা শক্ত, কারণ সমস্ত মুখে বসন্তের দাগ। দাগগুলো বেশ গভীর আর সংখ্যায় অগুণতি। পরনে কালো চওড়া পাড়ের ধুতি, গায়ে প্রায় হাঁটুছোঁয়া কোঁচকানো সিল্কের পাঞ্জাবি, মাথার চুল বেশ পাট করে আঁচড়ানো।

আমার বেঞ্চে দুটি তরুণ সাহিত্যিক বসেছিল। তারা আমাকে তুলে দিতে এসেছে। আমার প্রতি তাদের সবিনয় হাব-ভাব দেখে হোক বা যে-কারণেই হোক লোকটি আমাকেও বার দুই পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর ও-দিক ফেরা রমণীটির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল, পান খাবে নাকি গো?

জবাবে তার মাথা দুপাশে নড়ল একটু। অর্থাৎ খাবে না।

-এনে তো রাখি। এই তোরা চুপচাপ বসে থাকবি, খবরদার জায়গা ছেড়ে উঠবি না।

শেষের অনুশাসন ছেলে-মেয়েগুলোর উদ্দেশে। পান আনতে গেল। একটু বাদে আমি ঘড়ি দেখলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তরুণ সাহিত্যিক দুজন বিদায় নিয়ে নেমে যেতেই ঘণ্টা পড়ল। লোকটা তখনো উঠল না দেখে বউটির চকিত মুখখানা একবার এদিকে ঘুরল, তারপর একটা ছেলেকে সরিয়ে সে জানলার দিকে ঝুঁকল।

ট্রেন ছাড়ার আগেই লোকটা নির্বিঘ্নে উঠল আবার। হাতে পানের ঠোঙা। তারপরেই আমি অবাক। এক-গাল হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।–পান খাবেন সার?

সৌজন্যের খাতিরে হেসে মাথা নাড়লাম, খাই নে।

তাড়াতাড়ি সিল্কের জামার পকেটে হাত ঢোকালো।-সিগারেট?

আবারও মাথা নাড়লাম। তাও চলে না।

পরক্ষণে সার থেকে একেবারে মশাইয়ে অবতরণ।–পান না সিগারেট না, আপনি কেমনতর সাহিত্যিক মশাই! সঙ্গে সঙ্গে এক-গাল হাসি। আপনার পরিচয় আপনার সঙ্গের ওই ছেলে দুটির কাছ থেকে জেনে গেছি… একজন মহাশয় ব্যক্তির সঙ্গে চলেছি, বড় সৌভাগ্য আমার!

বলেই বেশ একটু উত্তেজনা-মেশানো আনন্দ নিয়ে খুপরির মধ্যে ঢুকে গেল। বউয়ের হাতে পানের ঠোঙা চালান করার ফাঁকে চাপা গলায় কি বলল ট্রেনের ঘড়ঘড় শব্দে শোনা গেল না। বউটি সন্তর্পণে এদিকে একবার মুখ ফেরালো।

লোকটা তক্ষুণি আমার বেঞ্চ-এর সামনে ফিরে এলো আবার। বসন্তের দাগভরা। মুখ খুশিতে ভরাট তেমনি।

-আপনাদের মত গুণীজনের সঙ্গে দুটো কথা বলার সৌভাগ্য হল, বড় আনন্দ পেলাম। বসি একটু, আপনি বিরক্ত হবেন না তো?

-না না, বসুন। আপনি যাবেন কোথায়?

-বেনারস। পাশে বেশ জাঁকিয়ে বসল। জন্ম বয়সের কম্ম, কোথাও তো বেরুনো হয় না… সেই কবে বসন্ত হয়ে পটল তুলব-তুলব করছি, বউটা তখন বাবা বিশ্বনাথের চরণে মাথা খুঁড়েছিল, এত বছর বাদে বাবা টেনেছেন–পড়লাম দুর্গা বলে বেরিয়ে। …তা আপনি তো লক্ষ্ণৌ চলেছেন শুনলাম?

-হ্যাঁ।

উৎসুক দু চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করল একটু।-হ্যাঁ মশাই, আমি শুনেছিলাম, আজকালকার সাহিত্যিকরা কলম ধরলেই পয়সা, অঢেল রোজগার করে এক-একজনে… আপনার তো তার ওপর একগাদা বই-পত্র, আমার বউ পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এনে এনে পড়ে, ভালো লাগলে আমাকে গল্প শোনায়–আপনি ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে আমাদের মত স্লিপারে চলেছেন যে?

বললাম, আমার এতেই সুবিধে হয়, তাছাড়া আপনাদের মত দু-পাঁচ জনের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়।

-তাই বলুন, আলাপ পরিচয় না হলে লিখবেন কি করে! কিন্তু… থাক, নিন্দে করব না। ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো।–এই তোরা ফল খা না–শুনছ! ওদের ফল বার করে দাও, আর এখানেও পাঠাও!

আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই বাপের হুকুম পেয়ে ছেলেরা বেঞ্চির তলা থেকে যে বিশাল ঝুড়িটা টেনে বার করল তার কাপড়ের ঢাকনা সরাতে আমার চক্ষুস্থির। অতবড় ঝুড়িটা ফলে ঠাসা। বড় বড় আপেল, নাশপাতি, বেদানা, আঙুর, কলা, খেজুর, আরো কত কি। বাসি বা শুকনো নয়, লোভনীয় রকমের তাজা। একসঙ্গে বিরাট ঝুড়ি ভরতি এমন ভালো ভালো ফল নিয়ে বেরুতে আর কাউকে দেখি নি।

ছেলে-মেয়েরা যে-যার খুশিমত ফল তুলে খেতে লাগল। এর মধ্যে বউটিকে কিছু বাছা ফল তুলে নিয়ে বেশ করে ধুয়ে দুটো ডিশে সাজাবার উদ্যোগ করতে দেখে আমি তাকে শুনিয়েই বললাম, ওঁকে বারণ করুন, অসময়ে আমি কিছু খাব না।

ফলের আবার সময় অসময় কি! আপনি খাবেন, ওই ফলের ভাগ্যি! দাও গো, তুমি দাও!

উঠে গিয়ে নিজেই ফলের ডিশ দুটো নিয়ে এলো। আমি সত্রাসে আবারও বাধা দিলাম, এত ফল কেউ খেতে পারে!

-খুব পারে, গল্প করতে করতে খান, দেখবেন ফুরিয়ে গেছে, হেঁজিপেজি ফল। তো নয়! বলতে বলতে নিজে আড়াইশ গ্রামের একটা আপেল তুলে নিয়ে কামড় বসালো।

অগত্যা ফলাহারে মন দিয়ে আমি বললাম, আপনার নামটি জানা হল না এখনো।

–আমার নাম রামতারণ, রামতারণ ঘোষ। সাগ্রহে আমার দিকে ঝুঁকল একটু।–এককালে আমি দেড় মাসের জন্য পাবলিশার হয়েছিলাম, বুঝলেন, দেড় মাসে হাজার টাকা লোকসান! তার আগে কলেজ স্ট্রীটে জুতোর দোকান ছিল, সেই জুতোর দোকান। তুলে দিয়ে রাতারাতি পাবলিশার–টেকে কখনো!

আমি হতভম্ব। জুতোর দোকান থেকে পাবলিশার!

আপেল চিবুতে চিবুতে সলজ্জ জবাব দিল, আর বলেন কেন, কপালে ভোগান্তি থাকলে খাবে কে!… যাক সে কথা। আপনাদের মতো দু-একজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার খুব আলাপ করার ইচ্ছে ছিল অন্য কারণে।

আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালাম। রামতারণ ঘোষ চট করে একবার ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো। তার বউ বাইরের দিকে ফিরে বসে আছে। আরো ঘন হয়ে বসে একটু গলা খাটো করে সে বলল, আচ্ছা মশাই, আপনারা যে এত ঝুড়ি-ঝুড়ি প্রেমের গল্প লেখেন, এমন সব মেয়ের কথা লেখেন যা পড়ে রাতে ভালো ঘুম হতে চায় না–তার মধ্যে কোথাও সত্যি কিছু আছে, নাকি সব ফানুস?

ভিতরে একটু নড়বড়ে অবস্থা আমার। জিজ্ঞেস করলাম, কেন বলুন তো? আপনি নিজে বুঝি কখনো প্রেমে পড়েছিলেন?

সচকিত।–ঐ যাঃ, আপনি ঠিক ধষেছেন! কিন্তু আমার প্রেম তত আকাশে উঠে ফানুসের মত ফটাস করে ফেটে গেল, শুধু ফেটে গেল না, আগুন ধরে গেল। –কিন্তু আপনাদের প্রেমের গল্পে সে-রকম বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড তো একটাও ঘটতে দেখি না!

প্রশ্ন চাপা দিয়ে তার ফানুস-ফাটা প্রেমের কাহিনী শোনার লোভ আমার। জবাব দিলাম, ও গল্পে অনেক ভেজাল অনেক জোড়াতাপ্লি থাকে.. আপত্তি না থাকলে আপনার ব্যাপারটা শুনতে ইচ্ছে করছে।

বসন্ত-গুটির ছোপ-ধরা মুখে এবারে সত্যিকারের লজ্জার কারুকার্য দেখলাম। বলল, আমার প্রাণান্ত দশাই হয়েছিল, কিন্তু শুনলে আপনি ভয়ানক হাসবেন। ৬৫ ৪

আমি মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলাম, হাসব না। শেষে দেখা গেল আমার শোনার আগ্রহ থেকে তার বলার আগ্রহ কম নয়। রাত প্রায় সাড়ে-নটা পর্যন্ত দু-তিন দফায় সে আমাকে যে বাঘ কাহিনীটা শোনালো তার বহু শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব বাদ দিলেও সেটা বর্ণশূন্য মনে হবে না বোধহয়। কিন্তু কাহিনীটি এমন যে সেটুকুওঁ হুবহু তার নিজের ভাষায় ব্যক্ত করলে বর্ণবৈচিত্র্য আরো বাড়বে বলেই বিশ্বাস।

.

বুঝলেন মশাই, আমি যাকে বলে আসল প্রেমে পড়েছিলাম সেই উনিশ বছর বয়সে। মল্লিকা দত্তর বয়েস তখন বছর ষোল। তার আগে একটা প্রেমভাব চলছিল। আমার বছর দুই-তিন ধরেমল্লিকা যখন স্কার্ট-ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেত–তখন থেকে। ঠিক সেই সময় আমি আমাদের ভাঙাচোরা বাড়ির সামনের গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার ঠাকমার যখন শ্বাসকষ্ট উপস্থিত, আর বাড়ির লোকের সঙ্গে আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি-তখনো ঘড়িতে ঠিক সাড়ে নটা বাজতে চোখ মুছতে মুছতে গলির মুখে ছুটে না এসে পারিনি। ও বেণী দুলিয়ে চলে যেতে ঘরে ফিরে এসে সকলের সঙ্গে মড়া-কান্না কেঁদেছিলাম।

হঠাৎ একদিন দেখি ও ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। আর তখনি আমার মুণ্ডু ঘুরে গেল। ষোল-ছোঁয়া একটা কাঁচা সুর যেন ওর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওদের বাড়ি আমাদের গলির সামনের যে রাস্তাটা ঘুরে নাচের ঢঙে বেঁকে গেছে–সেই রাস্তার শেষের মাথায়। আমাদের গলির মুখ থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। স্কুল যেদিন বন্ধ থাকত সেদিন কম করে বার পঞ্চাশেক আমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতাম।

মল্লিকাকে ভালবাসার পর থেকেই আমার জীবনে একটা ম্যাজিক হয়ে গেল। কুড়ি বছর বয়সে সেবারে আমি থার্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইন্যাল পাস করে ফেললাম। তার আগে মশাই চার-চারবার ঘোল খেয়েছি, বুঝলেন–সেবারে পাস। অবশ্য মল্লিকা দত্তও সেবার স্কুল ফাইন্যাল দিচ্ছে জানতুম, তাই সেই প্রথম ভগবানের কাছে প্রার্থনা। করেছিলাম যেন পাস করি। সেই পাস করলাম, আমি থার্ড ডিভিশন, মল্লিকা সেকেণ্ড ডিভিশন।

ভিতরে ভিতরে আমার একটা ভূমিকম্পের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, এবার থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ভালো ছেলে হব। বিছানায় চিৎপাত হয়ে কল্পনায় দেখতাম, মল্লিকাকে আমি পড়াচ্ছি, সাহায্য করছি–আর মল্লিকা আমার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।

কিন্তু বাদ সাধল আমার বাবা। হার্টের ব্যামো ধরিয়ে বসল। চিচি করে আমায় হুকুম করল, আর বিদ্যেয় কাজ নেই, ঢের হয়েছে–কাল থেকে গিয়ে দোকানে বোসো!

ভাবুন একবার আমার অবস্থাখানা! কোথায় আকাশে সাঁতরানো প্রেম আর কোথায় কলেজ স্ট্রীটের ঘুপচির মধ্যে জুতোর দোকান! বিশ্বাস করুন, আত্মহত্যা করার জন্য কবার যে আমি বাড়ির ভাঙা কার্নিসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক নেই।

সেই জুতোর দোকান নিয়েই পড়তে হল। সকালে বেরোই, রাতে ফিরি। চার মাসের মধ্যে কতগুলো অঘটন ঘটল। প্রথম, মল্লিকার বাবা বাড়ি বদল করল। আমার মাথায় পর-পর দুবার আকাশ ভাঙল। সর্বরক্ষা, আমার তিনটে দিদির বিয়ে বাবা আগেই দিয়ে গেছল। আমি তখন মায়ের সবেধন নীলমণি।

এরও মাস আষ্টেক বাদে আমার হৃৎপিণ্ডটা বেদম জোরে লাফিয়ে উঠল একদিন। মল্লিকা আমার দোকানে এক দুপুরে জুতো কিনতে এলো। আমার বুকের মধ্যে তখন এই ট্রেন ঝকানির মত ঝকানি, বুঝলেন! হ্যাঁ, নিজের হাতে জুতো পরালাম তাকে–কত জোড়া যে পরালাম ঠিক নেই। যত অপছন্দ ততো খুশি আমি, বার বার ওই সুন্দর দুটো পায়ে হাত ছোঁয়াতে পারছি। আপনাদের কোনো গল্পের কোনো প্রেমিক এভাবে নায়িকার পায়ে হাত দিয়েছে কোনোদিন?

জুতো পছন্দ করিয়ে শেষে কেউ শুনতে না পায় এমন করে জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারলেন? জবাবে সে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি তখন নিজের। বাড়ির ঠিকানা বললাম, ও কোন বাড়িতে থাকত বললাম, ওর নাম বললাম, ওর বাবার নাম বললাম। গলির মুখে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেমন মিটিমিটি হাসত, তেমনি হাসতে লাগল মল্লিকা। আমি ধরে নিলাম চিনতে পেরেছে, এবং আগে পারেনি। বলেই লজ্জা পাচ্ছে। যে দামে সে জুতো নিয়ে চলে গেল, দেখে দোকানের কর্মচারীরা। হাঁ। আমার পর পর তিন রাত ঘুম হল না।

এর পরের দেখা ওই কলেজ স্ট্রীটে, আড়াই বছর বাদে। আমার মা তখন স্বর্গে গেছে। আর আমি একটা বড় দাওয়ে নড়বড়ে জুতোর দোকান বেচে দেবার মওকা খুঁজছি। বেচতে পারলে কি করব তখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। পাশের বইয়ের দোকানের ছোকরা মালিকটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি। দেখি বইপত্র বুকে চেপে মল্লিকা দত্ত বইয়ের দোকানগুলো দেখতে দেখতে চলেছে। আমার আলাপী ছোকরাটি তাকে দেখিয়ে যে টিপ্পনী কাটল শুনে আমার ভেতরটা কি-রকম যেন হয়ে গেল। বইয়ের দোকানের ছোকরা হেসে হেসে যা জানালো তার সারমর্ম, ওই মেয়েটির নাম মল্লিকা দত্ত, এম. এ. পড়ে। নানা কাগজে তার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। এখন কবিতার বই ছাপার বাই চেপেছে মাথায়। সেই সব ছাপা কবিতা আর বাঁধানো একখানা কবিতা ভরতি খাতা নিয়ে সমস্ত পাবলিশারের দোরে দোরে ঘোরে। তার দোকানেও নাকি দুদিন এসে কবিতার বই ছাপার জন্য ঝকাঝকি করে গেছে।

ভিতরে আমার তখন কি-যে হচ্ছিল আমিই জানি। মল্লিকাকে তখনো দেখা যাচ্ছিল। আমার দু চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল আর সেই সঙ্গে আধা-গোচর একটা সংকল্পে বুকের ধুকপুকুনি বাড়ছিল। এর ঠিক চার দিনের মধ্যে দাঁওয়ের অনেক কম টাকায় জুতোর দোকান বেচে দিলাম। দেনাপত্র চুকিয়ে হাতে পেয়েছিলাম মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। কলেজ স্ট্রীটে তখন জলের দরে ঘর পাওয়া শক্ত নয়। চল্লিশ টাকায় সেদিনই একটা খুপরিঘর ভাড়া নিলাম। আর তার সাত দিনের মধ্যে আমার কাঠের র‍্যাক, কাঁচের র‍্যাক, সামনের কাউন্টার, ঝকঝকে সাইন বোর্ড রেডি। আমি তখন কল্প-ভারতী

বুক-সেলার অ্যান্ড পাবলিশারের একমাত্র মালিক। দোকানের সামান্য আসবাবপত্রের জন্য আমার সেদিনে খরচ পড়েছিল চারশ নব্বই টাকা, বাজার থেকে চালু বই কমিশনে দোকান সাজাতে আরো খরচা হয়েছিল ছশ চল্লিশ টাকা। তাছাড়া পাখা লাইট ইলেকট্রিক ইত্যাদির দরুন আরো বেরিয়ে গেছল ধরুন একশ পঁচিশ টাকা। তখন পর্যন্ত মোট খরচ দাঁড়ালো গিয়ে তাহলে বারো শ পঁচানব্বই টাকা। কিন্তু আমার উদ্দীপনা তখন এত প্রবল যে অচিরে আমি বাংলা দেশের সব থেকে বড় পাবলিশার হয়ে বসবই তাতে একটুও সন্দেহ নেই।

কুড়ি টাকা মাইনের সদ্য নিযুক্ত ছোকরা চাকরটার হাতে দোকান ছেড়ে দিয়ে আমি গেলাম য়ুনিভার্সিটির দোরে ধরনা দিতে। প্রথম দিন দেখা হল না, দ্বিতীয় দিনে বেলা বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে পায়ের সূতো যখন ছেড়ে ঘেঁড়ে, তখন দেখা। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারছেন? বলা বাহুল্য, চিনতে পারল না। আড়াই বছর আগের জুতোর দোকানের সাক্ষাৎ ভুলে। মেরে দিয়েছে দেখে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। সেই গলির বাড়ির কথা আর ওদের পুরনো বাড়ির কথা বললাম। তখনো নিস্পৃহ। তার পরেই যে কথা বললাম, তার প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেই আমি মুগ্ধ। বললাম, অনেক কাগজে আপনার কবিতা পড়ি, আর সেই থেকে অনেক সময় ভেবেছি একবার দেখা হলে ভালো হত, নতুন পাবলিশার তো আমি… সেই থোড়-বড়ি-খাড়া ছেড়ে নতুন কিছু করতে চাই। তা আসুন না একদিন আমার দোকানে, এই কাছেই…।

মল্লিকার সমস্ত মুখখানা উত্তেজনায় রাঙিয়ে উঠল। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভেবে পাচ্ছে না। এবারে আমাকে চিনতে পেরেছে মনে হল। বলল, আজ গেলে হয় না, কবিতাগুলো আমার সঙ্গেই ছিল…।

পরম সমাদরে আমি তক্ষুনি তাকে দোকানে নিয়ে এলাম। চপ-কাটলেট আনালাম। তারপর কাব্য-জগতে নেমে কখন যে রাত হয়ে গেল, দুজনার কারোই হুঁশ নেই। এরপর টানা একটা মাস স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল আমার। আমি মল্লিকার বাড়ি যাই, মল্লিকা দোকানে আসে রোজ। তার কবিতার রাশি আমার হেপাজতে তার অনেকগুলো কবিতা আমার মুখস্থ হয়ে গেল। কেউ যদি তখন বলত রবি ঠাকুর ওর থেকে ভালো কবিতা লিখেছে, আমার সহ্য হত কি না সন্দেহ। রোজ আমরা প্ল্যান করি কিভাবে ছাপা হবে, কত অভিনব সজ্জা-বিন্যাস সম্ভব। কবিতার বইয়ের দরাজ অঙ্কের রয়েলটি আমি আগাম দিয়ে ফেললাম লেখিকাকে। দুনিয়ার পরম প্রীতিবদ্ধ যেন শুধু আমরা দুটি প্রাণী। এই রোমাঞ্চ ভোলবার নয়।

একটা তরতাজা গাছকে আচমকা বাজ পড়ে ঝলসে যেতে দেখেছেন? দেখেননি? কল্পনা করুন। বিনা মেঘে বজ্রাঘাতে একেবারে জ্বলে পুড়ে ঝলসে গেলাম আমি। পর-পর দুদিন মল্লিকার দেখা পেলাম না, তৃতীয় দিনে যখন তার বাড়ি যাব ভাবছি, ডাকে একটা বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠি পেলাম। মল্লিকার বিয়ে। আমি জ্বলে জ্বলে পুড়ে পুড়ে কবরের তলার মানুষের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলাম।

তিন দিনের মধ্যে আবার সব বেচেটেচে দিয়ে আমি মোটমাট হাজার খানেক টাকা লোকসান খেলাম। মল্লিকার কবিতার খাতাপত্র রেজিস্ট্রি করে তার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।

.

এই পর্যন্ত বলে রামতারণ ঘোষ উঠে তার খুপরিতে ঢুকে ঝুড়ি থেকে দুটো আপেল তুলে নিয়ে আবার এসে বসল। একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, গলা শুকিয়ে গেছে, খান।

আমি ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়লাম–এত রাতে আর না। আর একবার অনুরোধ। করে সে নিজের আপেলে কামড় বসালো। আমার ধারণা তার গল্প বলা শেষ হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, এখন আপনি কি করছেন?

-ফলের স্টল। ট্রাম-রাস্তার ধারে চার মাথার ওপর দোকান… বেশ ভালই চলছে। হঠাৎ বন্ধ করে চলে এসেছি, কয়েকটা দিন লোকসান খেতে হবে।… বসন্তে যাই-যাই অবস্থা হয়েছিল যখন, আমার স্ত্রী বাবা বিশ্বনাথের কাছে মানত করে বসেছিল তো! সেও আট বছর হয়ে গেল, কত আর দেরি করব–বেরিয়ে পড়লাম।… তারপর গল্পটা শুনুন–

আমি নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসলাম।

–সময়ে বিয়ে করলাম বটে, কিন্তু মল্লিকার স্মৃতি আমার মধ্যে ছড়িয়ে থাকল। কোথায় মল্লিকা আর কোথায় এই বউ! মোট কথা দুটো ছেলেপুলে হবার পরেও বউকে আমি ভালো চোখে দেখতাম না। বউকে এক-এক সময় মল্লিকা ভাবতে চেষ্টা করে আরো খারাপ লাগত।

…বছর আটেক আগের কথা। বসন্ত রোগে একেবারে যমের মুখ থেকে ফিরে এলাম। ছমাস বাদে আবার ফলের স্টলের দরজা খুলেছি। হাতে তখন একটা পয়সা। নেই, আমার চালু দোকান অনেকে জানে বলেই গলাকাটা সুদে ধার দিয়েছে। আগের মতো ফলের স্টক বাড়াতে হলে মূলধন তো চাই।

একদিন বসে আছি, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ প্রচণ্ড একটা নাড়াচাড়া খেয়ে আমি দাঁড়িয়ে উঠলাম। আমার স্টলে মল্লিকা ফল কিনতে এসেছে। সঙ্গে একটি লোক, বোধ হয় দেওর-টেওর হবে। মাঝে চোদ্দ-পনের বছর কেটে গেছে, তবু তাকে দেখা মাত্র চিনলাম। সেই মল্লিকা নয়, তবু সেই মল্লিকাই যেন। কিন্তু মল্লিকা আমার মুখের দিকে তাকায়নি, সাগ্রহে আপেল দেখছে। একেবারে অসময়ের আপেল, একমাত্র আমার স্টলে ছাড়া এ তল্লাটে আর কারো কাছে নেই। নিতান্ত অসুখ-বিসুখের দায়ে না পড়লে ও-সময়ে কেউ আপেল কেনে না। মুখ দেখে মনে হল, মল্লিকাও সেই গোছের দায়েই পড়েছে। আপেল পছন্দ হতে মল্লিকা আমার দিকে তাকালো। চোদ্দ-পনের বছর বাদে চার চোখের মিলন। চিনতে পারা দূরে থাক, আমার বসন্তের দাগে-ছাওয়া মুখ দেখে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণার ভাব।

– কত করে?

সম্ভব হলে বা আগের দিন হলে আমি হয়ত বিনে পয়সায় জোর করে আপেল গছিয়ে দিতুম। আহা, সেই মল্লিকার কোনো ছেলে হয়ত অসুখে ভুগছে। কিন্তু আমারও তো সেই অবস্থা। অসময়ের আপেল, আট টাকা করে কেনা আমার, দশ টাকায় বেচি। তবু কেনা দামই বললাম।-আট টাকা কিলো।

সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি।-কম হবে না?

বুঝুন আমার অবস্থা। আমি জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা নেড়ে অক্ষম জানালাম। রাগে গজগজ করতে করতে মল্লিকা চার টাকা দিয়ে পাঁচশ আপেল কিনল। তার আগে তিনবার করে ওজন দেখল। আপেল নিয়ে দাম দেবার সময়ে তার আঙুলে আমার আঙুল ঠেকল। তখনো কেমন বিহূল অবস্থা আমার। ফলের ঠোঙা নিয়ে তারা এগলো। নিজের অগোচরে তাদের পিছনে আমিও তিন-চার পা এগিয়েছি। তারপরেই কাঠ আমি। মল্লিকার ঝাঝালো গলা, পাশের লোককে বলছে, পাঁচশ আপেল চার টাকা, এই সব গলা-কাটা লোকগুলোকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চাবকে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার।

আমি নির্বাক। একটু চুপ করে থেকে রামতারণ ঘোষ বলল, আট বছর আগে সেই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মল্লিকা-জ্বর ছাড়ল আমার।… আর তার পর থেকে নিজের স্ত্রটিকেই অন্যরকম লাগতে শুরু করল। বসন্তের দাগে-ভরা চোখে-মুখে সলজ্জ হাসি। –নিজের এই পরিবারটিকেই বেশ লাগে মশাই এখন… বুঝলেন!

বলতে বলতে জানলার ধারে ও-দিক ফেরা বউয়ের দিকে তাকালো সে।

আমার মনে হল এমন সপ্রেম দৃষ্টি আর বুঝি দেখিনি।

রানীদিন

ক্যালেণ্ডারে আজকের তারিখটার দিকে তাকাতেই প্রায় উনিশ বছর আগের ঠিক এই তারিখটাই আমার চোখের সামনে এগিয়ে এলো। সাত সাগর বাতাসে টপকে ইংলণ্ডের রাণীর পদার্পণ ঘটেছে ভারতে, উনিশ বছর আগের এই তারিখে তিনি কলকাতায়।

সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের যে মানসিক ছবিটি তুলে ধরতে চলেছি, পাঠক জেনে রাখুন বিশেষ কারণে তাদের সঠিক নাম কটি এখানে বদলাতে হয়েছে।

সেদিন আকাশ নির্মেঘ ছিল। কলকাতার বাতাসে রোমাঞ্চ ঠাসা ছিল। আবালবৃদ্ধবনিতার বুকের তলায় রূপকথার শিহরণ লেগেছিল। যাই যাই করেও বিদায়ী শীত হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্দীপনায় তার শেষ পুঁজি উজাড় করে দিচ্ছিল। হয়ত পুঁজি ছিলই না, আগামী শীতের থেকে কিছুটা ধার করে খরচা করছিল।

আমি ভাবছিলাম দেশটা অতিথি-পরায়ণ বটে। এই দেশেরই পুরাণের পুণ্য পাখিরা সপরিবারে ক্ষুধার্ত অতিথির সেবায় আগুনে দেহ দান করেছিল। পুরাণ-মাহাত্ম্য কল্কির বহু ধ্বংসযজ্ঞেও লুপ্ত হয়ে যায়নি একেবারে। সেই অতিথি-পরায়ণতার ঐতিহ্যের শীর্ণতর আর সূক্ষ্মতর ধারা যুগের পর যুগ পেরিয়ে তলায় তলায় তরতরিয়ে বইছে। রাণী এসে গেছেন সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে। রূপকথার রাণী নয়, স্বপ্নের রাণী নয়–রক্ত মাংসের তরতাজা রাণী। এই রাণীর জঠরের ক্ষুধা ভাবাটাও বিদ্যাসাগরীয় গদ্য গোছের। এই রাণীর চোখের ক্ষুধা। অতিথিপরায়ণ দেশ তার চোখের সামনে গোটা মনটি বিছিয়ে দিয়েছে। শুধু মানুষ কেন, তাই আকাশও সেদিন অত তকতকে নীল ছিল, বাতাসও রোমাঞ্চভারে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর বিদায়ী শীতও অতিথি সম্বর্ধনার দায়িত্বে চকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

কদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব। বুড়ী কলকাতার কতক অঙ্গ রং পালিশ আলোর বন্যায় নতুন-যৌবনে ঝলমলিয়ে উঠেছে। রক্ষা, সকল অঙ্গে চোখ ফেরাবার মত সময়। নেই রাণীর। মন্ত্রীদের আর মন্ত্রণা দপ্তরের মাথাওয়ালাদের কদিন ধরেই আহার নিদ্রা। ঘুচে গেছে-ভাবনায় ভাবনায় মাথার ঘিলু তাদের টগবগিয়ে ফুটছে। তাদের বউয়েরা ছেলেমেয়েরা অসুখের কথা বলতে এসে বা বাজার-খরচের তাগিদ দিতে এসে ধমক খেয়ে মরেছে। স্বামীদের মনে হয়েছে, কাণ্ডজ্ঞানহীনতারও একটা সীমা থাকা দরকার।

পুলিস দপ্তরের সকল স্তরের সকল পর্যায়ের কর্মচারীর দিশেহারা ব্যস্ততায় নাড়ী-ছাড়া ভাব একেবারে। দমদম এরোড্রোম থেকে গভর্নরের বাড়ি পর্যন্ত আট মাইল পথের শান্তিরক্ষার মহড়া দিতে দিতে গলদঘর্ম তারা। লাঠির ঘায়ে কিছু একটা। লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটিয়ে শান্তি স্থাপন করা বরং সহজ, কিন্তু এক্ষেত্রে লাঠি হাতে থাকবে অথচ কারো পিঠ দুরমুশনো চলবে না–দেখলে রাণী কি ভাববেন! এদিকে শান্তির খুঁটি নড়চড় হলেই তো সোজা নিজের ঘাড়ে কোপ! ভাবনা কম? ভাবনায় ভাবনায় মস্তিষ্ক বিকল হবার উপক্রম। গল্প শুনছিলাম, কোন একজন মাঝারী অফিসারকে তার নাম জিজ্ঞাস করতে অন্যমনস্কতায় তিনি তার ঠাকুরদার নাম বলে দিয়েছিলেন।

খবরের কাগজের দপ্তরে আর এক এলাহী কাণ্ড। তুলো থেকে সূক্ষ্মতম সূতো। বার করার মতো রাণীর বংশপঞ্জী আর দিনপঞ্জী থেকে সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিস্ময়ের খোরাক আহরণ করে খবরের হরপে সাজানোর ধুম পড়ে গেছে। রাণীর রূপ, গুণ, ঐশ্বর্য, আয়, ব্যয়, বিলাস, ব্যসন, আহার, নিদ্রা, অনুচর সহচরী–সব খবর আর সকলের খবর ইস্কুলের তিনবার ফেল-করা ছেলেটাও গড়গড়িয়ে বলে দেবে। পরীক্ষার খাতায় রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ আর দ্বারকানাথের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে ছেলে বাপ-ঠাকুরদা ওলটপালট করে ফেলেছে, তার মুখেও রাণীর ছেলেপুলে স্বামী আর বাপ-ঠাকুরদার নির্ভুল সমাচার শোনা গেছে।

.

–ভেবে দেখো, একশ হাজারে এক লক্ষ আর একশ লক্ষয় এক কোটি

– আলোচনায় আর উদ্দীপনায় ট্রাম-বাস সরগরম। অল্পবয়সী একজন বাঁয়ে ঘেঁষা নব্যপন্থী ঝাঝালো তর্কের সুরে রাণী সমাগমে দেশের খরচ বোঝাচ্ছিল তার সহযাত্রীকে। –গোটা দেশের এই উপোসের মুখে রাণী নিয়ে আসার আড়ম্বরে এক কোটি টাকা খরচ ভারতবর্ষের–ভাবতে পারো?—–

-এক কোটি কি মশাই! দু চোখ কপালে তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে ফোঁস করে উঠলেন সামনের সীটের এক যাত্রী।–একুশ কোটি বলুন! এক কোটি তো মশাই গভর্নমেন্টের আড়মোড়া ভাঙতেই বেরিয়ে যায়!… রাণী আসা একুশ কোটির ধাক্কা, বুঝলেন?

ট্রামের সকলের চোখ বক্তার মুখের ওপর। আর, আচমকা বিড়ম্বনায় এক কোটিওয়ালা হাবুডুবু। ক্ষীণ প্রতিবাদ, খবরের কাগজে এক কোটি দেখেছিলাম যেন…

ছাপার ভুলে তাহলে এক-এর বাঁয়ে দুইটা পড়ে গেছে। একুশ কোটিওয়ালার। নিঃসংশয় মন্তব্য।

-আপনারও কিন্তু একটু ভুল হল মশাই। পাশের আসন থেকে গুরুগম্ভীর প্রতিবাদ ছাড়লেন মাঝবয়েসী আর একজন ভদ্রলোক। রাণী আসার ব্যাপারে গোটা ভারতবর্ষ থেকে আসলে খরচা হচ্ছে ছাব্বিশ কোটি; একুশ কোটি নয়–নেট এক্সপেনডিচার টুয়েন্টিসিক্স ক্রোরস–প্রমাণ চান, চলুন যে-কোনো কাগজের অফিসে।

এক কোটি, একুশ কোটি আর ছাব্বিশ কোটির বিতণ্ডার মধ্যে কণ্ডাক্টার এগারো নয়া পয়সার টিকিট কাটার প্রত্যাশায় হাত বাড়িয়ে সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে।

বুড়োরা অর্ধশতাব্দীগত স্মৃতি রোমন্থন করে একবারের রাজা আসার গল্প ফেঁদে বসেছেন। প্রৌঢ়ারা ট্রাঙ্ক থেকে তিন যুগ আগের বেনারসী বার করে সঙ্গোপনে রোদে দিয়ে ঝেড়ে মুছে রাখছেন। এই হিড়িকে ছেলেপুলের জন্যে নতুন এক প্রস্থ প্যান্ট জামা জুতো করিয়ে নেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন মধ্যবিত্ত ঘরণীরা। পুরনো গয়না ভেঙে নতুন করে গড়িয়েছেন অনেকে। গিন্নিরা রাণী দেখতে যাবেন শুনে অনেক প্রৌঢ় চোখ কপালে তুলেছেন, আর অনেক তরুণ ঠাট্টা-ঠিসারা করেছেন। অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে ও-কাজটি একেবারে সেরে বাড়ি ফেরার বাসনা তাদের, এর মধ্যে ছেলেপুলে গিন্নিরা বেরিয়ে পড়লে খানিকটা দুর্ভাবনার কথাই।

সেই দিন। রাণী দিন। দিনটার এর থেকে ভালো নাম আর সঠিক নাম কিছু হতে পারে না। সকাল থেকে গোটা শহর উত্তর কলকাতার পথে ভেঙে পড়েছে। শুধু কলকাতা শহর কেন, মফঃস্বল শহরেরও আধা-আধি। কি করে কোন কোন পথ দিয়ে। তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে সঠিক করে কেউ বলতে পারবে না। আমি অন্তত পারব না।

আমিও গিয়েছিলাম। প্রথমে নিস্পৃহভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, জনতা দেখতে যাচ্ছি, ভিড় দেখতে যাচ্ছি, লোকের হুজুগ দেখতে যাচ্ছি। লেখার কাজে লাগবে। কিন্তু সেটা সত্যের অপলাপ। আসলে আমিও রাণী দেখতেই যাচ্ছি। রাণী তরুণী, রাণী রূপসী, রাণীর কুবেরের ঐশ্বর্য, সব থেকে বড় কথা–এ রাণী রাণীই, রাজার স্ত্রী হিসেবে রাণী নয়–একেবারে সর্বপ্রধানা, স্বয়ংসম্পূর্ণা রাণী। রাজা হলে যেতাম কিনা সন্দেহ, রাণী বলে যাচ্ছি। মনের তলায় রূপকথার রাজ্যে যে-রাণীর অবস্থান সেই রাণী, সেই রকম রাণী।

বাস থেকে নামতে হয়েছে গন্তব্য স্থানের বেশ খানিকটা দূরে। যেখানে দু-দশটা চাপা দিয়েও আর বাস চলার পথ ছিল না–সেইখানে। তারপর পায়ে পায়ে কখন একসময় জনতার সমুদ্রে মিশে গেছি খেয়াল নেই।

না, মানুষ দেখে এমন বিস্ময় জীবনে আর কখনো অনুভব করিনি। রাণী আসতে তখনো অনেক দেরি, এই ভিড়ের মধ্যেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একে ঠেলে ওকে ফেলে কখনো-বা ভিড়ের চাপে শুন্যে উঠে প্রায় আধ মাইল পথ আমি বিচরণ করেছি আর সেই বিস্ময় উপলব্ধি করেছি। সময় লেগেছিল ঘড়ি ধরে তিন ঘণ্টা।

কি দেখেছি? মারামারি, হুড়োহুড়ি, কথা-কাটাকাটি, পুলিসের তর্জন গর্জন? না, এর একটাও না। লক্ষ লক্ষ মেয়ে-পুরুষের এক তারে বাঁধা একটি মাত্র প্রতীক্ষার রূপ দেখেছি, রূপ উপলব্ধি করেছি। একটা মারামারি হাতাহাতিও আমার চোখে পড়েনি। পুলিসকে নিজের পেটের কাছে লাঠি শুইয়ে জনতা ঠেকানো ছাড়া একবারও লাঠি ঊচোতে দেখিনি। ট্রামে বাসে মেয়েদের গায়ে গা লাগলে যেখানে সোরগোল পড়ে যায়–সেখানে ভিড়ের চাপে চিড়ে চ্যাপটা হয়েও অশোভন আচরণের একটিও বামাহুঙ্কার অথবা পুরুষগর্জন কানে আসেনি! কে যে কাকে ঠেলছে সেই দিকেই চোখ নেই কারো। আর, পকেটমাররা কি এই ভিড়েও বাণিজ্যের লোভে আসেনি বলতে চান? এসেছিল নিশ্চয়, কিন্তু পকেটমার বলে তাদের কি হৃদয় নেই, না সেই হৃদয়ে রাণীর আসন নেই? পরদিন তন্ন তন্ন করে আমি খবরের কাগজ খুঁজেছি, কিন্তু রাণীদিনের সেই জন-সমুদ্রে একটি পকেটমারের রিপোর্টও আমার চোখে পড়েনি। রাণী দেখার আগ্রহে তারাও পেশা ভুলেছিল মনে হয়।

যাক, রাস্তার দুপাশে লক্ষ লক্ষ লোকের একতাল মানুষ, আর দু-পাশের বাড়ির একতলা দোতলা তিনতলার রেলিং-এ আর ছাতের আলসেতে চোখ-ধাঁধানো বসন-ভূষণে মোড়া চাপ চাপ মেয়েছেলে। কারো কারো ধারণা, মাথাপিছু দুটাকা করে আদায় করে ওই দুধারের বাড়ির অনেক মালিক অনেক টাকা কামিয়েছে সেদিন।

আমি দেখছিলাম, আর আত্মাটাকে একদিকের ফুটপাতের জনতার ঢেউয়ে ছেড়ে দিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছিলাম।

হঠাৎই বিষম একটা ধাক্কা। না, ভিড়ের ধাক্কা নয়। আত্মগত ধাক্কা।

আমার সামনের দুহাতের মধ্যে যে-লোকটি সকলের মাথার উপর দিয়ে আধ হাত গলা বাড়িয়ে সামনের ফাঁকা রাস্তাটাই একবার দেখে নেওয়ার জন্যে কসরৎ করছে, তাকে আমি চিনি। আর, কলকাতা ছেড়ে গোটা বাংলাদেশের লোক এখানে ভেঙে পড়লেও ওই একজনের এখানে আসার কথা নয়।

আমার বহুদিনের পরিচিত চাটুজ্জে বাড়ির বড়দা-মণিদা।

পরস্পরের দেখা হয়ে গেলে কে অপ্রস্তুত হবে না ভেবেই আমি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের ভিড়ে ভেসে পড়লাম। আধ ঘণ্টার চেষ্টায় বেশ খানিকটা তফাতে আসা গেল। তার পরেই একটা বন্ধ দোকানের উঁচু ধাপের দিকে চোখ যেতেই আবার ধাক্কা! চোখের দোষ নেই, বেশ একটি সুশ্রী মেয়ে ভিড় বাঁচিয়ে দোকানের বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কিন্তু আমি চমকে উঠেছি, কারণ, ওই মেয়েও চাটুজ্জে বাড়ির একজন। বড়দা অন্যথায় মণিদার ছোট বোন জয়ন্তী। আমার সঙ্গে ওই বাড়ির আত্মীয়তার সূতোটায় পাঁচঘোঁচ অনেক। মাসতুতো বোনের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটাকে কোনোভাবেই কাছের সম্পর্ক বলা চলে না। কিন্তু সর্বদা যাওয়া-আসার ফলে সম্পর্কটা কাছেরই হয়ে গেছে।

এবারে আর নিঃশব্দে আড়াল হওয়া গেল না। চেষ্টা-চরিত্র করে, আর, অনেকের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

দেখার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তী একদফা থতমত খেয়ে উঠল। ভিড় ঠেলে উঁচু ধাপটা থেকে নেমে আসতে আসতে সামলে নিল একটু। কাছে এসে হাসতে চেষ্টা করে কৈফিয়তের সুরে বলল, কাণ্ড দেখুন লোকের, এমন আটকে গেছি যে নড়াচড়ার উপায় নেই।

জয়ন্তী ইস্কুলে মেয়ে পড়ায়, উক্তিটা যে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল নিজেই বুঝেছে। ওদের বাড়ি যেতে হলে এতটা আসতে হয় না, আটকে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, যাচ্ছিলেন কোথায়?

বললাম, কোথাও না, এখানেই এসেছি।

জয়ন্তী আবারও ঢোঁক গিলল। ভিড়ের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে বলল, চলুন, বাড়ির দিকে যাই… কিন্তু বেরুবেন কি করে?

একটা জায়গা দেখে দাঁড়াই চলো, এসেছি যখন দেখেই যাই।

জয়ন্তী থমকে গিয়ে মুখের দিকে তাকালো। অপ্রতিভ হাসির আভাস, একটু অসহিষ্ণুও।বাড়ি গিয়ে আবার হড়বড়িয়ে বলে দেবেন না তো?

-না।…. তাছাড়া ওদিকে মণিদাও সকলের মাথার ওপর দিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে দেখলাম।

শুনে জয়ন্তী ঘুরে দাঁড়ালো একেবারে।–বড়দা? কই?

এখান থেকে দেখবে কি করে! আছে…। চলো, ওদিকে চলো—

বিস্ময় কাটিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আবার সামনের দিকে এগলো সে। একটা অপরাধপ্রবণতার অনুভূতি জোর করেই বিলুপ্ত করার চেষ্টা। বলে উঠল, আসবে না। কেন, এর সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক কি?

আমার নীরবতাটুকুই সায়ের মতো। দু চোখ আপাতত দুজনের মতো একটু জায়গা আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন।

এবারে একটু পূর্ব কথা বলে নেওয়া দরকার। জয়ন্তীর ওপরে তিনটি দাদা ও-ই সকলের ছোট। ওদের বাবা বিপ্লবী হরিশ চ্যাটার্জীর আপন বড় ভাই। ইংরেজ শাসনে যে হরিশ চ্যাটার্জীর প্রায় তিরিশ বছর আগে ফাঁসি হয়ে গেছে। জয়ন্ত ছেড়ে জয়ন্তীর ছোড়দাও জন্মায় নি তখনো। তাহলেও সেই কাকার আত্মাহুতির এক নিবিড় স্পর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে ওই বাড়ির সবকটি ছেলে মেয়ে। কাকীমা আছেন, তার বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। ওই বাড়ির তিনিই শুচিশুভ্র আদর্শ। ভাই বোন সকলেরই ওই কাকীমা-অন্ত-প্রাণ, তারই প্রভাবে মানুষ ওরা। কাকীমা পূজা-আহ্নিক করেন, সেই ঘরে দেবতার পাশেই বিপ্লবী স্বামীর ফোটো। রোজই মালা দেওয়া হয় ফোটোতে। জয়ন্তীরা ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম যত না করে, কাকার ফোটোতে প্রণাম করে। তার থেকে বেশী। কাকীমাও বলতে গেলে দিবারাত্রি ওই ঠাকুরঘরেই থাকেন, ঠাকুরঘরের মেঝেতে শোন।

হরিশ চ্যাটার্জীর ফাঁসির পর ও-বাড়িতে কোনো বিলিতি সামগ্রী ঢোকা দূরের কথা, বিলিতি বাতাসটুকু পর্যন্ত ঢুকতে পায়নি। আজও না। সেবারে কাকীমার অত বড় অসুখটাতেও এক ফোঁটা বিদেশী ওষুধ চলেনি। কাকীমা বলেছেন, মরবই তো একদিন তাতে কি, কিন্তু তোরা মারিস না।

মনের জোরে কাকীমা কবিরাজী চিকিৎসাতেই সেরে উঠেছিলেন।

রাণীর আসার ব্যাপারে আমি ওই এক বাড়িতেই শুধু আলোচনা শুনিনি। সকলকেই নিস্পৃহ, নিরাসক্ত দেখেছি। ঠিক তাও নয়, উল্টে যেন সকলের মনের তলায় এক ধরনের গাম্ভীর্য থিতনো দেখেছি।

.

রাণী এলেন। রাণী চলে গেলেন। জনতার অভ্যর্থনার উল্লাস আকাশে গিয়ে ঠেকল। শৃঙ্খলাবদ্ধ জনতা বাঁধভাঙা বন্যার মতোই তারপর আলোড়িত হয়ে উঠল। তার ভিতর দিয়ে পথ করার চেষ্টাও বিপজ্জনক।

রাণীদর্শনতৃপ্ত একটু-আধটু আলোচনা কানে আসছে। রাণীর রূপের ব্যাখ্যা, পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, তিনটি ছেলেমেয়ের মা–অথচ দেখে মনে হয় বাইশ বছরেরটি–না। জানলে বিবাহিত কিনা বোঝা শক্ত-রাণীর পরনে কি ছিল, কোন দিকে তাকিয়েছিলেন রাণী, কার চোখে চোখ পড়েছে, এই ভিড় আর এই অভ্যর্থনা দেখে রাণীর কতটা খুশি হওয়া সম্ভব, রাণীর স্বামী ওই ফিলিপ ভদ্রলোক বেচারী না ভাগ্যবান, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরো ঘণ্টাখানেক পরে পাশাপাশি জয়ন্তীদের বাড়ির দিকে চলেছি। একটু সহজ হবার জন্যেই বোধহয় জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলেন?

বললাম, তোমার থেকে সুন্দর নয় ভাবতে চেষ্টা করছি।

আ-হা, একটু খুশি হয়ে ও মন্তব্য করল, আমি ওর তুলনায় পেত্নী।

কিন্তু আমাদের হালকা হবার চেষ্টা ব্যর্থ। বাড়ির কাছাকাছি যে দুজন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তারা জয়ন্তীর মেজদা আর ছোড়দা। এক নজর তাকিয়েই বোঝা গেল, তারাও যেখান থেকে আসছে, আমরাও সেখান থেকেই। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। জয়ন্তীর ছোড়দা শুধু চোখের ইশারায় পিছনের দিকটা দেখিয়ে দিল। আমরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে মণিদাও। ওদের বড়দা।

তার শুকনো মুখে অপ্রতিভ হাসির আভাস। কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু সেও রাণী প্রসঙ্গ তুলল না, বা কিছু জিজ্ঞাসা করল না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়েই চার ভাইবোনের মধ্যে একটা নীরব প্যাক্ট হয়ে গেল যেন। তারপর ভাইদের আমার দিকে চোখ পড়তেই জয়ন্তী তেমনি নিঃশব্দ ইশারায় আশ্বস্ত করল, এ-দিক ঠিক আছে।

দোতলায় উঠেই সিঁড়ির পাশে কাকীমার পুজোর ঘর। সন্ধ্যার মুখ তখন। মুখ হাত ধুয়ে কাকীমা এ-সময়টা আধঘণ্টা খানেকের জন্য বৈকালিক জপে বসেন। আজও বসেছেন। ৬৫০

কাকীমা সকলকে একে একে তার ঘরটা অতিক্রম করতে দেখলেন। আমার দিকে চোখ পড়তে প্রসন্ন আহ্বান জানালেন, এসো, খবর ভালো তো?

আমি ঘাড় নাড়লাম। নিজের অগোচরে কাকীমার স্বামীর ফোটোখানার দিকে চোখ গেল। ফোটোর গলায় প্রতিদিনের মতই টাটকা মালা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, জয়ন্তী আর তার দাদারাও অদূরে দাঁড়িয়ে গেছে। সশঙ্ক, অপরাধী দৃষ্টি।

খুব সাদাসিধেভাবেই কাকীমা জিজ্ঞাসা করলেন, রাণী দেখে এলে বুঝি?

এমন বিড়ম্বনায় জীবনে পড়িনি বোধহয়। আমি যে রাণী দেখে এলাম সে কি আমার মুখে লেখা ছিল? কিন্তু এই ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ালে সত্যি জবাব যা সেটা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিজের অগোচরেই বলে ফেললাম, হ্যাঁ। তারপর শুকনো হাসি, আমার তো লেখা-টেখার ব্যাপারে দেখতেই হবে।

তেমনি সহজ সরল কৌতূহলে কাকীমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলে?

হঠাৎ কি যে হল কে জানে। অকারণ জোর আর অকারণ উৎসাহভরে বলে ফেললাম, চমৎকার, এত সুন্দর আগে ভাবিনি।

তাই নাকি! কাকীমার প্রসন্ন বিস্ময়। তারপর ভাশুরঝি আর ভাশুরপোদের নির্বাক মুখের দিকে চোখ পড়ল।–ওরা কিছু বলছে না যে, ওদের ভালো লাগেনি বুঝি?

বোন আর ভাইয়েরা বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। ধরা পড়ে হঠাৎ কাকীমার ওপরেই যেন সব রাগ গিয়ে পড়ল জয়ন্তীর। এক পা এগিয়ে এসে তরল উদ্দীপনায় বলে উঠল, খুব ভালো লেগেছে কাকীমা, কত সুন্দর ভাবতেও পারবে না, দেখলে চোখ। ফেরানো যায় না, একসঙ্গে যেন লক্ষ্মী সরস্বতী।

সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার ছোড়দা তেমনি ছদ্ম আগ্রহে যোগ দিল, খবরের কাগজের ছবিতে যেমন দেখো তার থেকে অনেক সুন্দর-কাগজে কিছুই ওঠে না।

আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কাকীমার মুখের ওপর। কিন্তু সেই মুখে কৃত্রিমতার আভাসও চোখে পড়ল না। সহজ সরল কৌতূহল। দেখে সকলে খুশি হয়েছে তাইতেই খুশি যেন। প্রসন্ন মন্তব্য, হবারই কথা, সুন্দরের গুষ্টি ওরা শুনেছি–আ-হা, বেঁচে থাক–

জয়ন্তীকে বললেন, মুখ হাত ধুয়ে ওদের খেতে দে, নিজেও খেয়ে নেখিদেয় মুখ চোখ বসে গেছে সব।

জপে মন ফেরানোর জন্যে ঘুরে বসলেন।

আমরা নির্বাক। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ইংরেজ রাজদুহিতার উদ্দেশে কাকীমার ওই সাদাসিধে আশীর্বাদটুকু আমাদের কানের ভিতর দিয়ে বুকের কোথায় গিয়ে পৌঁছুল হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারছি না।

নিজের অগোচরে আরো একবার তাকালাম।… অমন মাতৃত্বমণ্ডিত মুখ আর যেন দেখিনি আমি।

আজও থেকে থেকে মনে হয়, ভারতবর্ষ দেখতে এসে রাণী ভারতবর্ষের জনতা দেখে গেলেন শুধু, আর ভারতবর্ষের ভূগোল-পথে বিচরণ করে গেলেন। ভারতবর্ষ দেখতে পেলেন না।

হিসেবের বাইরে

সকাল সাতটাও নয় তখন। বাইরের বাঁধানো দাওয়ায় গরম চাদর মুড়ি দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। একটু আগে এখানে বসেই প্রাথমিক চায়ের পর্ব শেষ হয়েছে। শীতের সকাল কুয়াশায় ঢাকা। রোদের ছিটেফোঁটাও নেই এখন পর্যন্ত। তাছাড়া কলকাতা থেকে এখানকার এই খোলামেলা জায়গায় শীতও বেশি। নিউ ব্যারাকপুরের লোকালয় ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে বন্ধুর এই বাড়ি। না শহর না গ্রাম। বন্ধুর আমন্ত্রণে দুদিনের অবকাশ কাটাতে এখানে আসা। একই আপিসে পাশাপাশি চাকরি করি। তবে চাকরিতে বন্ধুটি আমার থেকে কিছুটা পদস্থ। তার ওপর অফিস ইউনিয়নের হোমরা-চোমরা একজন। সকলেই মান্যগণ্য করে। এমন কি মালিকরাও তাকে একটু-আধটু সমীহ করে। কলকাতা থেকে একটু দূরে থাকার বাসনায় এইখানে জমি কিনে বছরখানেক আগে এই ছিমছাম ছোট বাড়িটি করেছেন ভদ্রলোক। এখান থেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন এখন। দিনের কাজকর্ম চুকিয়ে একবার বাড়ি এসে বসতে পারলেই কি-যে মহাশান্তি সেকথা অজস্রবার শুনিয়েছেন। আর, একবার এসে দেখে যাবার তাগিদও বহুবার দিয়েছেন। গত সন্ধ্যায় আপিস ফেরত দুজনে এক সঙ্গেই চলে এসেছি। আগামী কালটা দুজনেই ছুটি নিয়েছি। তার পরদিন রবিবার। অতএব প্রাণখোলা আড্ডার ঢালা অবকাশ।

শীতের সকালে কলকাতায় সাড়ে সাতটা-আটটার আগে লেপের তলা থেকে বেরুতে পারি না। কিন্তু এখানে ছটা না বাজতে কেউ যেন ঠেলে তুলে দিল। তার বেশ খানিক আগে থেকেই পাখির কিচির-মিচির কানে আসছিল। ভোরের আলোয় তারা যেন মিষ্টি আলাপের আসর বসিয়েছে। এখানে কুয়াশা মাখা সকাল কলকাতার মতো নয়। ধোঁয়ার গন্ধের লেশমাত্র নেই। লেপের মায়া ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম। ঘরের পিছনের দিকের জানলার সামনে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়েছিলাম। অনেকটা জায়গা। জুড়ে ধানী জমি। কুয়াশায় ভালো চোখ চলে না, তবু মনে হল ওই জমিটার পাশ দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার শেষ কোথায় গিয়ে মিশেছে তা আর আদৌ ঠাওর হচ্ছিল না।

বাইরের দাওয়ায় বন্ধুর সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছি। তিনি রাত থাকতে ওঠেন, সন্ধ্যা আহ্নিক করেন। এরই মধ্যে তার সব কিছু সারা। মুখ হাত ধুয়ে তার পাশে এসে বসলাম। তিনি হেসে বললেন, এত ঘুমোও কি করে বাপু! তুমি উঠবে-উঠবে। করে গিন্নি সেই কখন চায়ের জল চড়িয়ে বসে আছে।

বললাম, আজ তো তবু ঢের আগে উঠেছি, সাড়ে ছটাও নয় এখন

দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল। সর্ব ব্যাপারে আমার এই বন্ধুটির হিসেবের বায়ু আছে। হিসেবের ভিতর দিয়ে সবকিছুরই একটা পাকা চিত্র ছকে ফেলার ঝোঁক। চা খেতে খেতে যখন শুনলেন কলকাতায় সাড়ে সাতটার আগে আমার ঘুমই ভাঙে না, ছুটির অবকাশে তক্ষুনি একটা হিসেব মাথায় ঢুকে গেছে তার। এগারোটায় শুয়ে সাড়ে সাতটায় ওঠা মানে কম করে আট-সাড়ে আট ঘন্টার ঘুম–আট ঘণ্টাই ধরা। যাক। তাহলে এক মাসে অর্থাৎ তিরিশ দিনে দুশ চল্লিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটে-বছরে হল গিয়ে দুশ চল্লিশ ইনট বারো–হল গিয়ে দু হাজার আটশ আশী ঘণ্টা। তাহলে ধরো মোট যদি পঁচাত্তর বছর বাঁচো তাহলে

আমি ভাবলাম এই হিসেবটা আর মুখে মুখে এগোচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলে। উঠলেন, ধ্যেৎ ছাই আমি বোকার মতো এভাবে হিসেব করছি কেন–আট ঘণ্টা ঘুমানো মানে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমনো–তাহলে পঁচাত্তর বছরের তিন ভাগের এক ভাগ হল গিয়ে পঁচিশ বছর–সোজা হিসেব! তাহলে দেখো পঁচাত্তর বছরের মধ্যে পঁচিশটা বছর তুমি স্রেফ মরার মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে।

হেসেই বললাম, থামো এখন, তোমার হিসেবের কলে পড়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে–এক্ষুনি না আবার ঘুম পেয়ে যায়।

হাসতে লাগলেন বন্ধুও। বললেন, না, এই হিসেবের ফল ঠিক উল্টো-সর্বব্যাপারে মিতাচারী হবার মহৌষধ। দেখো, আগে আমি সিগারেট খেতাম কম করে দিনে দশটা। পঁচাত্তর বছরের জীবনে হিসেব করে দেখলাম দু লক্ষ সত্তর হাজার সিগারেট খেতে হবে–ব্যস সিগারেটের নেশা খতম। পান খাওয়াও এই হিসেব করেই কমিয়ে ফেলেছি

শুনতে মজা লাগছিল বেশ। চোখ টিপে গলা খাটো করে বললাম, তোমার যৌবনকালের গার্হস্থ্য ধর্মেও এই হিসেব মাথায় ছিল না তো?

বন্ধুর ছেলে মাত্র একটি, মেয়ে নেই। হা-হা শব্দে হেসে উঠে হাঁক দিলেন, ওগো শুনছ!

সচকিত হয়ে বললাম, আমি কিন্তু উঠে পালাব তাহলে

কিন্তু হাঁক শুনে তার গৃহিণী এসেই গেছেন। অগত্যা হাসি সামলে বন্ধু বললেন, চায়ের পেয়ালাগুলো নিয়ে যেতে বলো–

এই সাত সকালে দাওয়ায় বসে কিছু রঙ্গরস চলছে, তার গৃহিণী সেটা আঁচ করে হালকা সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন।

হাসি গোপন করার চেষ্টায় আমি সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কুয়াশা অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। তার ওপর রোদ ঝিকমিক করছে। হঠাৎ অদূরে একটা দৃশ্য দেখে আমার দু চোখ সেদিকে আটকালো। সামনের ওই রাস্তাটা ধরে শ্লথ পায়ে একটি রমণী এগিয়ে আসছে। পা ফেলে ফেলে তার এগিয়ে আসার ধরনটা যেন কেমন! দূর থেকে চেহারাপত্র ভালো ঠাওর করা গেল না। তবে বেশ মজবুত স্বাস্থ্যের মেয়ে এটুকু বোঝা যাচ্ছে। পরনে খয়রী রংয়ের একটা খাটো ডুরে শাড়ি। কিন্তু মেয়েটা এভাবে পা ফেলে ফেলে আসছে কেন!

বন্ধুর উপস্থিতি ভুলে সেদিকেই চেয়ে ছিলাম। আরো কাছে আসতে পরিষ্কার দেখলাম। বেশবাস দেখে বোঝা যায় খেটে-খাওয়া দুঃস্থ গরিব ঘরের বৌ। কিন্তু সুন্দর সুঠাম স্বাস্থ্য। আধফর্সা মুখখানাও বেশ সুশ্রী। মাথায় খাটো ঘোমটা। বয়েস বত্রিশ তেত্রিশ হতে পারে। ঢিমে তালে এলোমেলো পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে। আর যেভাবে আসছে, মনে হল মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারে।

যে কোনো কারণে রমণীটি বেশি-রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভেবে উতলা চোখে আমি বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখি বন্ধু আমাকেই দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা দেখার রোগ না লেখকের রোগ?

বললাম, মেয়েটাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে, কিভাবে পা ফেলছে আর ঢুলতে ঢুলতে আসছে দেখছ না?

-ওটা রস-সিক্ত পদক্ষেপ আর রসের ঢুলুনি। মেয়েটার পিছনে যে আসছে তাকেও দেখো! ৬৬৮

বন্ধুর কথা শুনে যেমন অবাক আমি, ওই মেয়েটার পিছনে গজ বিশেক পিছনে পিছনে যে আসছে তাকে দেখেও তেমনি অবাক। বছর চৌদ্দর একটি ছেলে। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে হেঁভা শার্ট। আদর-যত্ন পেলে ওই কচি মুখটাও সুশ্রী দেখাত হয়তো। আমি অবাক এই কারণে যে ওই ছেলেটাও সামনের রমণীটির মতোই টলতে টলতে। ঢুলতে ঢুলতে পথ ভেঙে এগিয়ে আসছে।

সবিস্ময়ে আবার বন্ধুর দিকেই ফিরলাম আমি।–এই সাত সকালে দুটোতেই মদ গিলে ঘরে ফিরছে নাকি? কে ওরা-মা আর ছেলে?

বন্ধু জবাব দিল, তাই। তুমি আর ড্যাব ড্যাব করে ওদিকে তাকিয়ে থেকো না। ওই বজ্জাতও নতুন মানুষ দেখে তোমার দিকে মন দিয়েছে দেখছি-রসিক জন। ভেবেছে বোধহয়।

রাস্তাটা বেঁকে বাড়িটার পাশ ঘেঁষেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মেয়েটা অপলক চোখে সত্যি আমাকে দেখতে দেখতেই, বাড়িটা পার হল। অস্বস্তি তার পরেও। বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতেও ঘাড় ফিরিয়ে আমাকেই দেখছে। তার পরের বিস্ময় অভাবনীয়। দাঁড়িয়েই গেল এবং ঘুরে এদিকেই চেয়ে রইল। এদিকে বলতে বন্ধুর দিকে নয়, শুধু আমার দিকে। মাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ছেলেটাও মায়ের কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে তাকালো।

ব্যাপার কি না বুঝে আমি বন্ধুর দিকে তাকালাম। মেয়েটার এরকম দুঃসাহস দেখে বন্ধুও কিছুটা অবাক আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুটি করে ওদের দিকে চেয়ে আছেন।

পায়ে পায়ে মেয়েটা এবার আমাদের এই দাওয়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। মদের বেঁকে আবার কি কাণ্ড বাধায় আমার সেই অস্বস্তি। বন্ধুও হকচকিয়ে গিয়ে থাকবেন।

পায়ে পায়ে মেয়েটা এসে একেবারে দাওয়া ঘেঁষে দাঁড়াল। অপলক চাউনি আমারই মুখের ওপর। নেশার ঘোর কেটে গিয়ে তারও যেন কিছু বিস্ময়ের কারণ ঘটেছে। অভাবের ছায়া এটে বসা কমনীয় মুখ, উসকো-খুসকো ঈষৎ কোঁকড়া লালচে চুল। খাটো ডুরে শাড়ি পরা সুঠাম গড়ন, শরীরের সবটুকুর পক্ষে ওই ছোট শাড়ি আদৌ যথেষ্ট নয়। বছর তিরিশ-বত্রিশের বেশি বয়েস মনে হয় না। মাথার ছোট ঘোমটাটাও এর মধ্যে খসে গেছে। আমি কেমন বিমূঢ় হঠাৎ। এই গোছের একখানা মুখ আমি কি কোথাও কখনো দেখেছি? একেবারে অচেনা লাগছে না কেন?

পাশ থেকে বন্ধু প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন, কি চাই এখানে?

ধমক খেয়ে মেয়েটার বিস্ময়ের ঘোর কাটল যেন। এবার বন্ধুর দিকে তাকালো। তার ভয়লেশশূন্য সাদাসাপটা কথা শুনে আমি হতভম্ব।তাড়া দেন কেন বাবু, আমি কি চুরি করতে এয়েছি? পরক্ষণে আমার দিকে ফিরতে ঢুলু ঢুলু চোখে আগ্রহ যেন উপচে উঠল। জিজ্ঞাস করল, কলকাতার মুখুজ্জে বাড়ির সেজবাবু না?

আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। এবারে অবাক বোধ হয় বন্ধুটিও। নিজের অগোচরে। মাথা নেড়েছিলাম কিনা খেয়াল নেই। নিজের বাড়িতে আমি সেজবাবুই বটে।

চোখের পলকে মেয়েটা এবার দাওয়ায় উঠে এলো। তার পরেই উপুড় হয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম। আমি বাধা দেবারও সময় পেলাম না। প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির মালিকের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ঘাড় ফিরিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, ভুলু, শীগগির আয়!

ছেলেটারও হয়তো নেশা ছুটে গেছে। সে হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসতেই বলে উঠল, দেবতার দেখা পেয়ে গেলি আজ, গড় কর শীগগির, গড় কর।

ছেলেটাও কিছু না বঝেই তাড়াতাড়ি প্রণাম সেরে উঠল। আমি তখনও আঁতিপাতি করে খুঁজছি কে হতে পারে এরা।

মেয়েটার চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে, আপনি এখানে সেজবাবু! বেড়াতে এয়েছেন?

-হ্যাঁ, আমার এই বন্ধুর বাড়ি এটা।

বাড়ির সকলে ভালো আছেন? সেজ-মা ভালো আছেন?

সেজ-মা বলতে আমার স্ত্রী। আমি বললাম, সব ভালো, কিন্তু তোমার নাম কি বলো তো?

সে বলে উঠল, ও-মা, এখনো এই পোড়ারমুখিকে চিনতেই পারলেন না সেজবাবু! আমি আপনাদের বাড়ির সেই কমলা দাসীর মেয়ে সরস্বতী!

শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে বিস্মৃতির পর্দাটা সরে গেল। এবার তাকাতেই মনে হল ষোল বছরের আধফর্সা কেঁকড়া কচি-কাঁচা মিষ্টি মুখের সঙ্গে আরো সতেরটা বছর জুড়লে এরকমই হতে পারে বটে। মগজে একরাশ স্মৃতি একসঙ্গে ভিড় করে আসছে। আবার একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা দিল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুটা নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে বললাম, এবারে চিনেছি। কেষ্টর খবর কি?

–ঘরে আছে। অষ্ট পহর ঘরেই থাকতে হয়, ঘর থেকে বেরুনোর উপায় নেই। সাগ্রহে আঙুল তুলে মেঠো রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ওই মাঠ ছাড়ালেই বস্তি এলাকায় আমাদের ঘর–মাঠ ভেঙে গেলে কাছেই–আপনি এখানে দিন কয়েক থাকবেন সেজবাবু?

মুখে বলতে সাহস করল না বটে, কিন্তু এমন করে বলল যে পারলে এক্ষুনি ও আমাকে ওদের ঘর দেখাতে টেনে নিয়ে যায়।

বন্ধুর বিরক্তি-ছাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো গম্ভীর। বললাম, না, পরশু ভোরে চলে যাব। তারপর প্রায় রূঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এভাবে হেঁটে আসছিলি কেন–সকালেই মদ গিলেছিস আর ছেলেটাকেও খাইয়েছিস?

সরস্বতী থতমত খেল একদফা। দেখতে দেখতে সমস্ত মুখটাই বিষাদে ছেয়ে গেল। বলল, আপনি নেদ্যয় হলে ভগবান আমাকে আরো কত মারবেন ঠিক নেই, আপনার কথা আমরা এখনো বলি, আপনি দয়া রাখবেন সেজবাবু! বিষ না খেয়ে আমাদের পেটে ভাত জোটে না যে, কি করব…

বলতে বলতে একটা উদগত কান্না ভিতরে ঠেলে দিয়ে ছেলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে নেমে গেল। তারপর হনহন করে পথ চলল।

শেষের এই কথাগুলো শুনে কেন যেন আমার বুকের তলায় মোচড় দিয়ে উঠল। কি ব্যাপার আমি ভেবে পেলাম না। ওর স্বামী কেষ্ট ঘোষের ঘর ছেড়ে বেরুনোর উপায় নেই কেন? বিষ না খেলে পেটের ভাত জোটে না বলার মানে কি? মদ গিলে আগে বিবেকের গলা টিপে মেরে তারপর নিজের দেহ বেচে স্বামী পুত্রের ভাত জোটাতে হচ্ছে? তাহলে ছেলেটা সঙ্গে যাবে কেন? ছেলেটাও মদ গিলবে কেন?

বন্ধুর বিরস মুখের দিকে চেয়ে বললাম, মেয়েটা ভারী মিষ্টি আর ভালো ছিল এক সময়

বন্ধু বাধা দিয়ে উঠলেন, এক সময় বলতে সেই সতের বছর আগে তো? এর মাঝে আর দেখেছ?

মাথা নাড়লাম। দেখিনি।

তাহলে এখন আর ভালোটালো বিচার করতে বোসো না। তবে এখনো অনেক লোকে ওকে মিষ্টি দেখে। ওই মেয়ে এই দাওয়ায় উঠে কথা বলছিল দেখে কটা লোক অবাক হয়ে এদিকে চাইতে চাইতে চলে গেল তুমি খেয়াল করোনি। ওর সুনাম কেমন বুঝছ?

সরস্বতীর এ-বাড়ির দাওয়ায় উঠে কথা বলাটা বন্ধুর একটুকুও পছন্দ হয়নি বোঝা গেল। আবার বললেন, তোমার ওই ভালো মেয়ে এখন ছেলে নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় কলকাতা যায় চোলাই মদ বিক্রী করতে আর সকালে ফেরে। বুঝলে? কাপড়ের নীচে ওদের কোমরে চোলাই মদ পাচার করার ব্লাডার বাঁধা থাকে। যা বেচতে পারল বেচল, বাকিটা মা আর ছেলে মিলে যে সাবড়ে দেয় সে তো ওদের নিজের চোখে দেখেই বুঝতে পারলে। এই করে ঘরের পঙ্গু স্বামীর আর ছেলের ভাত জোটাস বুঝলাম, তা বলে নিজেরা খাস কেন! তাছাড়া তোমার ওই ভালো মেয়ের পিছনে অনেক লোক লেগে আছে, তার মধ্যে পয়সাওলা লোকেরও অভাব নেই শুনেছি। ওই বস্তি এলাকায় ওর কিছু পিয়ারের লোকও আছে-কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে ওদের লেলিয়ে দেয়, দু-চারজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মারপিটের খবরও আমার কানে এসেছে।

শুনে আমার কান মন দুই-ই বিষিয়ে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সতের বছর আগের একটা ঘটনাও বার বার মনে আসতে লাগল। ফলে ভিতরটা আরো বেশি ভারাক্রান্ত হয়েই থাকল।

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকতে বেলা একটা। ভারী খাওয়ার ফলে বন্ধু তার ঘরে একটু গড়াগড়ি করে নিতে গেলেন। আমাকেও তাই করতে বললেন।

গড়াগড়ি করতে গিয়ে হিসেব ভুলে বন্ধু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন নিশ্চয়। কারণ। তার আবার এ-ঘরে পদার্পণ ঘটল বেলা তখন চারটে। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই তিনি। হা একেবারে।

আমি আমার শয্যাতেই বসে আছি। আমার সামনে মেঝেতে বসে আছে সরস্বতী। এখন তার সঙ্গে ছেলেও নেই।

গৃহস্বামীর হতচকিত অবস্থা দেখে সরস্বতী বিব্রত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

আমি ওকে উদ্দেশ্য করে হাল্কা সুরেই বললাম, বাড়ির মালিক ঘুমুচ্ছিলেন বলেই তুই এক ঘণ্টা ধরে এখানে বসে যেতে পারলি। যা পালা এখন, সাড়ে পাঁচটা নাগাত তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিস–কেষ্টকে দেখে আসতে যাবখন।

সরস্বতীর ঠাণ্ডা মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল। কিন্তু সাহস করে সেটুকু প্রকাশ করতে পারল না। আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

বন্ধু আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমাকেই দেখছেন। মাথার বিকৃতি কি আর কিছু তাই ভাবছেন। আমাকে হাসতে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল বোধ হয়। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আমার সকালের এত কথা তোমার কানে গেল না? তুমি ওর বাড়ি যাবে?

-শুনলেই তো। মাথা ঠাণ্ডা করে বোসো। ঘুরে এসে তোমার হিসেবের বাইরে তোমাকে যদি কিছু না শোনাতে পারি তো আজ রাতেই আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে নিশ্চিন্ত হয়ো।

বলার ধরনের ব্যতিক্রমটুকু কানে লেগেছে।-এখনি বলে শুনি, এক ঘণ্টা ধরে মেয়েটা তোমাকে কি এমন বলে গেল যে তুমি গলে জল হয়ে গেলে?

বললাম, এখন না, আগে ঘুরে আসি।

ঘুরে এলাম। এ-সব জায়গায় শীতকালের সাড়ে সাতটা মানে রাতই। ঘরে পা দিয়েই মনে হল বন্ধু আর বন্ধু-পত্নী দুজনেই আমার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরেই বসে ছিলেন তারা। বন্ধু-পত্নী উঠে দাঁড়িয়ে। বললেন, আগে এক পেয়ালা চা খাওয়াই আপনাকে।

বাধা দিলাম, কিছু দরকার নেই, বসুন, এর মধ্যে দু পেয়ালা হয়ে গেছে।

বন্ধু বলে উঠলেন, কোথায় হল, তোমার ওই সরস্বতীর ওখানেই?

-হ্যাঁ। শয্যায় বসে তার দিকে ফিরলাম।–যা বলব সে যদি তোমার হিসেবের বাইরে হয়, আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে, আর সে অনুরোধ রাখাটা। তোমার একটুও সাধ্যের বাইরে নয়–বউদি আপনি সাক্ষী।

বন্ধু বললেন, ভণিতা ভালই হয়েছে এখন ব্যাপারখানা কি শুনি!

এরপর যে চিত্রটা ওদের গোচরে এনেছিলাম, পাঠকের সামনেও সেটুকুই তুলে ধরছি।

সরস্বতীর মায়ের নাম কমলা দাসী।, আমাদের বাড়ির ঝি ছিল। বারো বছরের মেয়ে সরস্বতীকে নিয়ে সকালে আর বিকেলে আমাদের বাড়ি কাজ করতে আসত। কমলার বয়েস তখন বেশি হলে সাতাশ-আটাশ। স্বামী নেই, শুনেছি বছর দেড় দুই আগে বিধবা হয়েছে। আমাদের বাড়ির বউরা কাজে-কর্মে খুব একটা খুঁত ধরতে পারত না তার, তবু ওর ওপর তেমন খুশি ছিল না। বলত ওর স্বভাব চরিত্র সুবিধের নয়, কবে কার সঙ্গে কোন রাস্তায় নাকি ওকে দেখা গেছে একাধিক দিন। পরে বউরা তাকে জিজ্ঞাসা করতেও নাকি বলেছে আমার অমুক সম্পর্কের আত্মীয়। তাছাড়া চাল-চলনও ভালো নয়। বাড়ির ঠাকুরটার সঙ্গে নাকি ঠারেঠোরে কথা বলে, ফাঁক পেলে হাসাহাসি করে, যার দরুন ঠাকুরটা ওকে দু বেলাই বেশি-বেশি চা-রুটি দেয় ইত্যাদি।

মেয়েদের এ-সব কথায় আমি বড় একটা কান দিইনি। ভেবেছি, ওদের শ্রেণীর মেয়েদের তুলনায় কমলা দাসীর চেহারাপত্রের চটক বেশি, আর মোটামুটি সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবতী বলেই মেয়েদের ওই গোছের সন্দেহ। তাছাড়া কান না দেবার আরো কারণ, ওর মেয়েটা সত্যিই স্নেহের পাত্রী হয়ে উঠেছিল আমার। সুন্দরী না হোক ভারী মিষ্টি দেখতে, না ফর্সা না কালো, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, বড় টানা-টানা দুটো চোখ। মুখ বুজে মায়ের কাজে সাহায্য করত, তারপর ফাঁক পেলেই দোতলায় চলে আসত। সকালে আমি নিজের মেয়ে আর ভাইঝিদের পড়াতাম, সন্ধ্যায় তাদের গল্প শোনাতাম। এই দু বেলার আসরে ওর উপস্থিত থাকা চাই-ই। ওর এত আগ্রহ দেখে ওকেও ছাত্রী করে নিলাম। বাড়িতে থাকতে বিনা বেতনের প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। আবার ভর্তি করে দিলাম। খুশিতে কৃতজ্ঞতায় মেয়েটা যেন আমার কেনা হয়ে গেল।

চার বছর বাদে সরস্বতীর মা কমলা মেয়ে ফেলে সত্যি কার সঙ্গে উধাও হয়ে। গেল। বাড়ির মেয়েরা তখন সরস্বতীকেও বিদায় দিল। ও তখন ষোল বছরের মেয়ে, বাড়ন্ত গড়ন। মেয়েদের বিশ্বাস ওরও স্বভাবচরিত্র মায়ের মতোই হবে। কারণ পাড়ার ভদ্র ঘরের একটা বখাটে ছেলের সঙ্গে ওর ভাবসাব দেখা যাচ্ছে। আর ওদের বস্তির কতগুলো ছোকরাও নাকি বাড়ির আশপাশে সর্বদা ঘুরঘুর করে। ভদ্রঘরের ওই ছেলেটা আস্কারা পায় বলে ওদের নাকি সরস্বতীর ওপর ভয়ানক রাগ। সেই ভদ্রঘরের ছোকরাকে আমি চিনি। নাম কৃষ্ণ ঘোষ, সকলে কেষ্ট বলে ডাকে। লেখাপড়ায় স্কুলের বেড়া পার হতে পারেনি। তখন শ্যামনগর না কোথায় একটা কাগজের কলে ঢুকেছে। হাতে কিছু পয়সা আসতেই বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে।

বিদায় দেবার তিন-চার দিনের মধ্যেই আলুথালু অবস্থায় এক সন্ধ্যায় সরস্বতী এসে আমার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল। কান্না আর থামেই না। শেষে যা বলল। তার মর্ম, বস্তির তিনটে জোয়ান ছেলে জোর করে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছে, যে পাতানো মাসির কাছে থাকে এখন তাকে টাকা দিয়ে বশ করেছে, আর সরস্বতীকে শাসিয়েছে এতটুকু অবাধ্য হলে তাকে একেবারে খুন করে ফেলা হবে। সে তিন-চারটে দিন মাত্র এ বাড়িতে আমার আশ্রয়ে থাকতে চায়, তারপর আর কোনো ভাবনা নেই। ভাবনা না থাকার কারণ শুনেও তাজ্জব আমি। কেষ্ট ঘোষ তার কাজের জায়গায় ঘর খুঁজছে, তিন-চার দিনের মধ্যেই পাওয়ার আশা। তারপরেই তাকে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।

মেয়েটার কান্না দেখে আর কথা শুনে মায়া হল। কিন্তু কেষ্ট ঘোষকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রাতে তাকে ডেকে পাঠালাম। আমি অবাক, ছেলেটাও কাঁদছে, সেই সঙ্গে কাকুতি-মিনতি, তিন-চারটে দিন ওকে আশ্রয় দিন দয়া করে, আমি এর মধ্যে ব্যবস্থা করছি। ভালো কায়েতের ছেলে, সরস্বতীকে বিয়ে করে নিজেদের ঘরে তোলা চলবে না–বাড়ি থেকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াবে জানা কথা। তাই কটা দিন সময় দরকার।

আমি কঠিন গলায় ওকে বললাম, এরপর ওকে ফেলে আবার একদিন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবি তো?

কেষ্ট কালীর দিব্যি কাটল, মরা বাপের নামে শপথ করল।

সরস্বতীকেও বললাম, আর তুই তোর মায়ের মতো হবি না তো?

ও আমার পায়ে মাথা রেখে বলল, ওকে কখনো ছেড়ে গেলে আমার যেন কৃষ্ঠ হয়–আমার ছেলে হলে আমি যেন তার মরা মুখ দেখি!

চার-পাঁচটা দিন সরস্বতীকে আগলে রাখার মধ্যে বিপদ ছিল। কটা গুণ্ডা ছেলে সর্বদা বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু আমি থানা-পুলিশের ভয় দেখাতে গণ্ডগোল পাকাতে সাহস করেনি।

পাঁচ দিনের মধ্যেই কেষ্ট বিয়ে করে সরস্বতীকে তার কাজের জায়গায় নিয়ে গেছে। আমি ওকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম।

দু বছরের মধ্যে সরস্বতীর কোলে ছেলে এসেছে। গরিব হলেও আনন্দের হাট বসে গেছে তখন। কেষ্টর মতিগতি অনেক ভালো হয়েছে, সে তখন প্রাণপণে বেশি উপার্জনের রাস্তা খুঁজছে।

ছেলেটার সাত বছর বয়সের সময় বজ্রাঘাত হয়ে গেল। কলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে কেষ্টর একটা পা একেবারে ভেঁচে গেল, একটা হাতও ভয়ানক জখম হল। পা-টা কেটে বাদ দিতে হল, হাতেরও খানিকটা। কলের মালিক সব-কিছু কেষ্টর দোষে হয়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইল। অনেক চেষ্টার পর ক্ষতিপূরণ যেটুকু পেল তাই দিয়ে এখানকার এই মাথা গোঁজার ঠাইটুক করা গেছে।

…তারপর সংসার অচল। মাসের পর মাস একবেলা আধ পেটা খেয়ে থেকেছে। সরস্বতী ভদ্রলোকের বাড়ি ঝিগিরি করতে চাইলে কাজ মেলে। কিন্তু সব বাড়িতেই দেখা গেছে ওকে নিয়ে কিছু না কিছু গণ্ডগোল বাধছে। ওর দিকে কারো না কারো চোখ পড়েছে। সে-রকম লোক বাড়িতে না থাকলেও পাড়ায় আছে। পঙ্গু কেষ্টরও সন্দেহ হত সরস্বতী বুঝি ওকে ছেড়ে চলে যাবে। সরস্বতী সেই আগের কথাই বলেছে, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, তোমাকে ছেড়ে গেলে ছেলের মরা মুখ দেখতে হবে আমাকে।

অভাবে না খেয়ে মর-মর দশার সময় চোলাই মদ বিক্রির রাস্তা ধরেছে। মদ সেলাই যারা করে তাদের অনেক টাকা। সরস্বতী, তার ছেলে আর এমনি অনেকের মারফত সে-সব কলকাতায় বা অন্যত্র চালান হয়, বিক্রি হয়। ওরা তার অংশ পায়। পুলিসের হুজ্জোত হলে মালিক সামাল দেয়, তখন সংসার চালায়।

সরস্বতীর আর তার ছেলের কলকাতার খদ্দের কয়েকটি মাঝারি নামী বার। চোলাই মণ তাদের কাছে বিক্রি করে। তারা ভালো মদের সঙ্গে সেগুলো মিশেল দেয়। প্রথম ই-এক দফা খাঁটি মদ পেটে পড়ার পর খদ্দের আর ভেজাল ধরতে পারে না।

কিন্তু চোলাই মদ মেশানোর বিপদ আছে। যদি বিষাক্ত হয়? যদি খেয়ে লোক মরে যায়? সেই কারণেই মা আর ছেলেকে জিনিস যাচাই হিসেবে প্রত্যেক দফার মাল ওদের সামনে খেয়ে দেখাতে হয়। খাওয়ার পর রাত বারোটা একটা পর্যন্ত ভিতরের কোথাও পড়ে থাকতে হয়। মাল বিষাক্ত নয়, এ-ভাবে যাচাই হবার পর টাকা মেলে। সেই নিযুতি রাতে মা-ছেলে কোন রকমে হেঁটে শিয়ালদা আসে। সেখান থেকে ভোরের প্রথম ট্রেন ধরে ঘরে ফেরে। এত সবের পরেও অনেক ভদ্রঘরের নেকড়েরা ওর পিছনে লাগতে ছাড়ে না। ওর কোমরে সর্বদা একটা ধারালো ছোরা গোঁজা থাকে। আত্মরক্ষার জন্যেই বস্তি এলাকার একদল ছেলে জুটিয়েছে, যারা ওর থেকে সস্তায় চোলাই মদ পায়, খাবার-টাবারও পায়। তারা ওকে দিদি বলে ডাকে। কেউ পিছনে লাগলে বা বেশি জ্বালাতন করলে সরস্বতী ওদের লেলিয়ে দেয়।

আমাকে দেখে কেষ্ট ফুলে ফুলে কেঁদেছে। আর সরস্বতী পায়ের ওপর থেকে মাথা তোলেই না। কেবল বলে, ভগবান আপনাকে পাঠিয়েছেন সেজবাবু, আমার ছেলেটার যা-হোক একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা করে দেন, সেই টাকায় আমরা একবেলা খেয়ে থাকব–তা না হলে ছেলেটা আমাদের লিভার পচেই মরে যাবে। এখনই মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হয়।

আমি বন্ধুকে বললাম, এবার যদি সব কিছু তোমার হিসেবের বাইরে মনে হয় তো সরস্বতীর ছেলেটার জন্য তুমি কিছু করবে। ইউনিয়নের মস্ত মাতব্বর তুমি, ইচ্ছে করলেই কর্তাদের বলে তুমি ওকে একটা বেয়ারার কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারো। ছেলেকে নিয়ে আমি ওকে কাল সকালে তোমার এখানে আসতে বলেছি।… আর, ঘরে বসেও সরস্বতী কি করে কিছু রোজগার করতে পারে সে-কথাও ভাবব বলে তাকে কথা দিয়ে এসেছি।

বন্ধু নির্বাক। স্তব্ধ। তার স্ত্রীর চোখে জল।

Exit mobile version