– আলোচনায় আর উদ্দীপনায় ট্রাম-বাস সরগরম। অল্পবয়সী একজন বাঁয়ে ঘেঁষা নব্যপন্থী ঝাঝালো তর্কের সুরে রাণী সমাগমে দেশের খরচ বোঝাচ্ছিল তার সহযাত্রীকে। –গোটা দেশের এই উপোসের মুখে রাণী নিয়ে আসার আড়ম্বরে এক কোটি টাকা খরচ ভারতবর্ষের–ভাবতে পারো?—–
-এক কোটি কি মশাই! দু চোখ কপালে তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে ফোঁস করে উঠলেন সামনের সীটের এক যাত্রী।–একুশ কোটি বলুন! এক কোটি তো মশাই গভর্নমেন্টের আড়মোড়া ভাঙতেই বেরিয়ে যায়!… রাণী আসা একুশ কোটির ধাক্কা, বুঝলেন?
ট্রামের সকলের চোখ বক্তার মুখের ওপর। আর, আচমকা বিড়ম্বনায় এক কোটিওয়ালা হাবুডুবু। ক্ষীণ প্রতিবাদ, খবরের কাগজে এক কোটি দেখেছিলাম যেন…
ছাপার ভুলে তাহলে এক-এর বাঁয়ে দুইটা পড়ে গেছে। একুশ কোটিওয়ালার। নিঃসংশয় মন্তব্য।
-আপনারও কিন্তু একটু ভুল হল মশাই। পাশের আসন থেকে গুরুগম্ভীর প্রতিবাদ ছাড়লেন মাঝবয়েসী আর একজন ভদ্রলোক। রাণী আসার ব্যাপারে গোটা ভারতবর্ষ থেকে আসলে খরচা হচ্ছে ছাব্বিশ কোটি; একুশ কোটি নয়–নেট এক্সপেনডিচার টুয়েন্টিসিক্স ক্রোরস–প্রমাণ চান, চলুন যে-কোনো কাগজের অফিসে।
এক কোটি, একুশ কোটি আর ছাব্বিশ কোটির বিতণ্ডার মধ্যে কণ্ডাক্টার এগারো নয়া পয়সার টিকিট কাটার প্রত্যাশায় হাত বাড়িয়ে সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে।
বুড়োরা অর্ধশতাব্দীগত স্মৃতি রোমন্থন করে একবারের রাজা আসার গল্প ফেঁদে বসেছেন। প্রৌঢ়ারা ট্রাঙ্ক থেকে তিন যুগ আগের বেনারসী বার করে সঙ্গোপনে রোদে দিয়ে ঝেড়ে মুছে রাখছেন। এই হিড়িকে ছেলেপুলের জন্যে নতুন এক প্রস্থ প্যান্ট জামা জুতো করিয়ে নেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন মধ্যবিত্ত ঘরণীরা। পুরনো গয়না ভেঙে নতুন করে গড়িয়েছেন অনেকে। গিন্নিরা রাণী দেখতে যাবেন শুনে অনেক প্রৌঢ় চোখ কপালে তুলেছেন, আর অনেক তরুণ ঠাট্টা-ঠিসারা করেছেন। অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে ও-কাজটি একেবারে সেরে বাড়ি ফেরার বাসনা তাদের, এর মধ্যে ছেলেপুলে গিন্নিরা বেরিয়ে পড়লে খানিকটা দুর্ভাবনার কথাই।
সেই দিন। রাণী দিন। দিনটার এর থেকে ভালো নাম আর সঠিক নাম কিছু হতে পারে না। সকাল থেকে গোটা শহর উত্তর কলকাতার পথে ভেঙে পড়েছে। শুধু কলকাতা শহর কেন, মফঃস্বল শহরেরও আধা-আধি। কি করে কোন কোন পথ দিয়ে। তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে সঠিক করে কেউ বলতে পারবে না। আমি অন্তত পারব না।
আমিও গিয়েছিলাম। প্রথমে নিস্পৃহভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, জনতা দেখতে যাচ্ছি, ভিড় দেখতে যাচ্ছি, লোকের হুজুগ দেখতে যাচ্ছি। লেখার কাজে লাগবে। কিন্তু সেটা সত্যের অপলাপ। আসলে আমিও রাণী দেখতেই যাচ্ছি। রাণী তরুণী, রাণী রূপসী, রাণীর কুবেরের ঐশ্বর্য, সব থেকে বড় কথা–এ রাণী রাণীই, রাজার স্ত্রী হিসেবে রাণী নয়–একেবারে সর্বপ্রধানা, স্বয়ংসম্পূর্ণা রাণী। রাজা হলে যেতাম কিনা সন্দেহ, রাণী বলে যাচ্ছি। মনের তলায় রূপকথার রাজ্যে যে-রাণীর অবস্থান সেই রাণী, সেই রকম রাণী।
বাস থেকে নামতে হয়েছে গন্তব্য স্থানের বেশ খানিকটা দূরে। যেখানে দু-দশটা চাপা দিয়েও আর বাস চলার পথ ছিল না–সেইখানে। তারপর পায়ে পায়ে কখন একসময় জনতার সমুদ্রে মিশে গেছি খেয়াল নেই।
না, মানুষ দেখে এমন বিস্ময় জীবনে আর কখনো অনুভব করিনি। রাণী আসতে তখনো অনেক দেরি, এই ভিড়ের মধ্যেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একে ঠেলে ওকে ফেলে কখনো-বা ভিড়ের চাপে শুন্যে উঠে প্রায় আধ মাইল পথ আমি বিচরণ করেছি আর সেই বিস্ময় উপলব্ধি করেছি। সময় লেগেছিল ঘড়ি ধরে তিন ঘণ্টা।
কি দেখেছি? মারামারি, হুড়োহুড়ি, কথা-কাটাকাটি, পুলিসের তর্জন গর্জন? না, এর একটাও না। লক্ষ লক্ষ মেয়ে-পুরুষের এক তারে বাঁধা একটি মাত্র প্রতীক্ষার রূপ দেখেছি, রূপ উপলব্ধি করেছি। একটা মারামারি হাতাহাতিও আমার চোখে পড়েনি। পুলিসকে নিজের পেটের কাছে লাঠি শুইয়ে জনতা ঠেকানো ছাড়া একবারও লাঠি ঊচোতে দেখিনি। ট্রামে বাসে মেয়েদের গায়ে গা লাগলে যেখানে সোরগোল পড়ে যায়–সেখানে ভিড়ের চাপে চিড়ে চ্যাপটা হয়েও অশোভন আচরণের একটিও বামাহুঙ্কার অথবা পুরুষগর্জন কানে আসেনি! কে যে কাকে ঠেলছে সেই দিকেই চোখ নেই কারো। আর, পকেটমাররা কি এই ভিড়েও বাণিজ্যের লোভে আসেনি বলতে চান? এসেছিল নিশ্চয়, কিন্তু পকেটমার বলে তাদের কি হৃদয় নেই, না সেই হৃদয়ে রাণীর আসন নেই? পরদিন তন্ন তন্ন করে আমি খবরের কাগজ খুঁজেছি, কিন্তু রাণীদিনের সেই জন-সমুদ্রে একটি পকেটমারের রিপোর্টও আমার চোখে পড়েনি। রাণী দেখার আগ্রহে তারাও পেশা ভুলেছিল মনে হয়।
যাক, রাস্তার দুপাশে লক্ষ লক্ষ লোকের একতাল মানুষ, আর দু-পাশের বাড়ির একতলা দোতলা তিনতলার রেলিং-এ আর ছাতের আলসেতে চোখ-ধাঁধানো বসন-ভূষণে মোড়া চাপ চাপ মেয়েছেলে। কারো কারো ধারণা, মাথাপিছু দুটাকা করে আদায় করে ওই দুধারের বাড়ির অনেক মালিক অনেক টাকা কামিয়েছে সেদিন।
আমি দেখছিলাম, আর আত্মাটাকে একদিকের ফুটপাতের জনতার ঢেউয়ে ছেড়ে দিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছিলাম।
হঠাৎই বিষম একটা ধাক্কা। না, ভিড়ের ধাক্কা নয়। আত্মগত ধাক্কা।