– কত করে?
সম্ভব হলে বা আগের দিন হলে আমি হয়ত বিনে পয়সায় জোর করে আপেল গছিয়ে দিতুম। আহা, সেই মল্লিকার কোনো ছেলে হয়ত অসুখে ভুগছে। কিন্তু আমারও তো সেই অবস্থা। অসময়ের আপেল, আট টাকা করে কেনা আমার, দশ টাকায় বেচি। তবু কেনা দামই বললাম।-আট টাকা কিলো।
সঙ্গে সঙ্গে মল্লিকার মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি।-কম হবে না?
বুঝুন আমার অবস্থা। আমি জবাব দিতে পারলাম না। শুধু মাথা নেড়ে অক্ষম জানালাম। রাগে গজগজ করতে করতে মল্লিকা চার টাকা দিয়ে পাঁচশ আপেল কিনল। তার আগে তিনবার করে ওজন দেখল। আপেল নিয়ে দাম দেবার সময়ে তার আঙুলে আমার আঙুল ঠেকল। তখনো কেমন বিহূল অবস্থা আমার। ফলের ঠোঙা নিয়ে তারা এগলো। নিজের অগোচরে তাদের পিছনে আমিও তিন-চার পা এগিয়েছি। তারপরেই কাঠ আমি। মল্লিকার ঝাঝালো গলা, পাশের লোককে বলছে, পাঁচশ আপেল চার টাকা, এই সব গলা-কাটা লোকগুলোকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চাবকে গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার।
আমি নির্বাক। একটু চুপ করে থেকে রামতারণ ঘোষ বলল, আট বছর আগে সেই বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মল্লিকা-জ্বর ছাড়ল আমার।… আর তার পর থেকে নিজের স্ত্রটিকেই অন্যরকম লাগতে শুরু করল। বসন্তের দাগে-ভরা চোখে-মুখে সলজ্জ হাসি। –নিজের এই পরিবারটিকেই বেশ লাগে মশাই এখন… বুঝলেন!
বলতে বলতে জানলার ধারে ও-দিক ফেরা বউয়ের দিকে তাকালো সে।
আমার মনে হল এমন সপ্রেম দৃষ্টি আর বুঝি দেখিনি।
রানীদিন
ক্যালেণ্ডারে আজকের তারিখটার দিকে তাকাতেই প্রায় উনিশ বছর আগের ঠিক এই তারিখটাই আমার চোখের সামনে এগিয়ে এলো। সাত সাগর বাতাসে টপকে ইংলণ্ডের রাণীর পদার্পণ ঘটেছে ভারতে, উনিশ বছর আগের এই তারিখে তিনি কলকাতায়।
সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের যে মানসিক ছবিটি তুলে ধরতে চলেছি, পাঠক জেনে রাখুন বিশেষ কারণে তাদের সঠিক নাম কটি এখানে বদলাতে হয়েছে।
সেদিন আকাশ নির্মেঘ ছিল। কলকাতার বাতাসে রোমাঞ্চ ঠাসা ছিল। আবালবৃদ্ধবনিতার বুকের তলায় রূপকথার শিহরণ লেগেছিল। যাই যাই করেও বিদায়ী শীত হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্দীপনায় তার শেষ পুঁজি উজাড় করে দিচ্ছিল। হয়ত পুঁজি ছিলই না, আগামী শীতের থেকে কিছুটা ধার করে খরচা করছিল।
আমি ভাবছিলাম দেশটা অতিথি-পরায়ণ বটে। এই দেশেরই পুরাণের পুণ্য পাখিরা সপরিবারে ক্ষুধার্ত অতিথির সেবায় আগুনে দেহ দান করেছিল। পুরাণ-মাহাত্ম্য কল্কির বহু ধ্বংসযজ্ঞেও লুপ্ত হয়ে যায়নি একেবারে। সেই অতিথি-পরায়ণতার ঐতিহ্যের শীর্ণতর আর সূক্ষ্মতর ধারা যুগের পর যুগ পেরিয়ে তলায় তলায় তরতরিয়ে বইছে। রাণী এসে গেছেন সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে। রূপকথার রাণী নয়, স্বপ্নের রাণী নয়–রক্ত মাংসের তরতাজা রাণী। এই রাণীর জঠরের ক্ষুধা ভাবাটাও বিদ্যাসাগরীয় গদ্য গোছের। এই রাণীর চোখের ক্ষুধা। অতিথিপরায়ণ দেশ তার চোখের সামনে গোটা মনটি বিছিয়ে দিয়েছে। শুধু মানুষ কেন, তাই আকাশও সেদিন অত তকতকে নীল ছিল, বাতাসও রোমাঞ্চভারে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর বিদায়ী শীতও অতিথি সম্বর্ধনার দায়িত্বে চকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
কদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব। বুড়ী কলকাতার কতক অঙ্গ রং পালিশ আলোর বন্যায় নতুন-যৌবনে ঝলমলিয়ে উঠেছে। রক্ষা, সকল অঙ্গে চোখ ফেরাবার মত সময়। নেই রাণীর। মন্ত্রীদের আর মন্ত্রণা দপ্তরের মাথাওয়ালাদের কদিন ধরেই আহার নিদ্রা। ঘুচে গেছে-ভাবনায় ভাবনায় মাথার ঘিলু তাদের টগবগিয়ে ফুটছে। তাদের বউয়েরা ছেলেমেয়েরা অসুখের কথা বলতে এসে বা বাজার-খরচের তাগিদ দিতে এসে ধমক খেয়ে মরেছে। স্বামীদের মনে হয়েছে, কাণ্ডজ্ঞানহীনতারও একটা সীমা থাকা দরকার।
পুলিস দপ্তরের সকল স্তরের সকল পর্যায়ের কর্মচারীর দিশেহারা ব্যস্ততায় নাড়ী-ছাড়া ভাব একেবারে। দমদম এরোড্রোম থেকে গভর্নরের বাড়ি পর্যন্ত আট মাইল পথের শান্তিরক্ষার মহড়া দিতে দিতে গলদঘর্ম তারা। লাঠির ঘায়ে কিছু একটা। লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটিয়ে শান্তি স্থাপন করা বরং সহজ, কিন্তু এক্ষেত্রে লাঠি হাতে থাকবে অথচ কারো পিঠ দুরমুশনো চলবে না–দেখলে রাণী কি ভাববেন! এদিকে শান্তির খুঁটি নড়চড় হলেই তো সোজা নিজের ঘাড়ে কোপ! ভাবনা কম? ভাবনায় ভাবনায় মস্তিষ্ক বিকল হবার উপক্রম। গল্প শুনছিলাম, কোন একজন মাঝারী অফিসারকে তার নাম জিজ্ঞাস করতে অন্যমনস্কতায় তিনি তার ঠাকুরদার নাম বলে দিয়েছিলেন।
খবরের কাগজের দপ্তরে আর এক এলাহী কাণ্ড। তুলো থেকে সূক্ষ্মতম সূতো। বার করার মতো রাণীর বংশপঞ্জী আর দিনপঞ্জী থেকে সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিস্ময়ের খোরাক আহরণ করে খবরের হরপে সাজানোর ধুম পড়ে গেছে। রাণীর রূপ, গুণ, ঐশ্বর্য, আয়, ব্যয়, বিলাস, ব্যসন, আহার, নিদ্রা, অনুচর সহচরী–সব খবর আর সকলের খবর ইস্কুলের তিনবার ফেল-করা ছেলেটাও গড়গড়িয়ে বলে দেবে। পরীক্ষার খাতায় রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ আর দ্বারকানাথের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে ছেলে বাপ-ঠাকুরদা ওলটপালট করে ফেলেছে, তার মুখেও রাণীর ছেলেপুলে স্বামী আর বাপ-ঠাকুরদার নির্ভুল সমাচার শোনা গেছে।
.
–ভেবে দেখো, একশ হাজারে এক লক্ষ আর একশ লক্ষয় এক কোটি