.
বুঝলেন মশাই, আমি যাকে বলে আসল প্রেমে পড়েছিলাম সেই উনিশ বছর বয়সে। মল্লিকা দত্তর বয়েস তখন বছর ষোল। তার আগে একটা প্রেমভাব চলছিল। আমার বছর দুই-তিন ধরেমল্লিকা যখন স্কার্ট-ফ্রক পরে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেত–তখন থেকে। ঠিক সেই সময় আমি আমাদের ভাঙাচোরা বাড়ির সামনের গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার ঠাকমার যখন শ্বাসকষ্ট উপস্থিত, আর বাড়ির লোকের সঙ্গে আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি-তখনো ঘড়িতে ঠিক সাড়ে নটা বাজতে চোখ মুছতে মুছতে গলির মুখে ছুটে না এসে পারিনি। ও বেণী দুলিয়ে চলে যেতে ঘরে ফিরে এসে সকলের সঙ্গে মড়া-কান্না কেঁদেছিলাম।
হঠাৎ একদিন দেখি ও ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। আর তখনি আমার মুণ্ডু ঘুরে গেল। ষোল-ছোঁয়া একটা কাঁচা সুর যেন ওর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওদের বাড়ি আমাদের গলির সামনের যে রাস্তাটা ঘুরে নাচের ঢঙে বেঁকে গেছে–সেই রাস্তার শেষের মাথায়। আমাদের গলির মুখ থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। স্কুল যেদিন বন্ধ থাকত সেদিন কম করে বার পঞ্চাশেক আমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করতাম।
মল্লিকাকে ভালবাসার পর থেকেই আমার জীবনে একটা ম্যাজিক হয়ে গেল। কুড়ি বছর বয়সে সেবারে আমি থার্ড ডিভিশনে স্কুল ফাইন্যাল পাস করে ফেললাম। তার আগে মশাই চার-চারবার ঘোল খেয়েছি, বুঝলেন–সেবারে পাস। অবশ্য মল্লিকা দত্তও সেবার স্কুল ফাইন্যাল দিচ্ছে জানতুম, তাই সেই প্রথম ভগবানের কাছে প্রার্থনা। করেছিলাম যেন পাস করি। সেই পাস করলাম, আমি থার্ড ডিভিশন, মল্লিকা সেকেণ্ড ডিভিশন।
ভিতরে ভিতরে আমার একটা ভূমিকম্পের মত পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, এবার থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ভালো ছেলে হব। বিছানায় চিৎপাত হয়ে কল্পনায় দেখতাম, মল্লিকাকে আমি পড়াচ্ছি, সাহায্য করছি–আর মল্লিকা আমার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে।
কিন্তু বাদ সাধল আমার বাবা। হার্টের ব্যামো ধরিয়ে বসল। চিচি করে আমায় হুকুম করল, আর বিদ্যেয় কাজ নেই, ঢের হয়েছে–কাল থেকে গিয়ে দোকানে বোসো!
ভাবুন একবার আমার অবস্থাখানা! কোথায় আকাশে সাঁতরানো প্রেম আর কোথায় কলেজ স্ট্রীটের ঘুপচির মধ্যে জুতোর দোকান! বিশ্বাস করুন, আত্মহত্যা করার জন্য কবার যে আমি বাড়ির ভাঙা কার্নিসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক নেই।
সেই জুতোর দোকান নিয়েই পড়তে হল। সকালে বেরোই, রাতে ফিরি। চার মাসের মধ্যে কতগুলো অঘটন ঘটল। প্রথম, মল্লিকার বাবা বাড়ি বদল করল। আমার মাথায় পর-পর দুবার আকাশ ভাঙল। সর্বরক্ষা, আমার তিনটে দিদির বিয়ে বাবা আগেই দিয়ে গেছল। আমি তখন মায়ের সবেধন নীলমণি।
এরও মাস আষ্টেক বাদে আমার হৃৎপিণ্ডটা বেদম জোরে লাফিয়ে উঠল একদিন। মল্লিকা আমার দোকানে এক দুপুরে জুতো কিনতে এলো। আমার বুকের মধ্যে তখন এই ট্রেন ঝকানির মত ঝকানি, বুঝলেন! হ্যাঁ, নিজের হাতে জুতো পরালাম তাকে–কত জোড়া যে পরালাম ঠিক নেই। যত অপছন্দ ততো খুশি আমি, বার বার ওই সুন্দর দুটো পায়ে হাত ছোঁয়াতে পারছি। আপনাদের কোনো গল্পের কোনো প্রেমিক এভাবে নায়িকার পায়ে হাত দিয়েছে কোনোদিন?
জুতো পছন্দ করিয়ে শেষে কেউ শুনতে না পায় এমন করে জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারলেন? জবাবে সে হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি তখন নিজের। বাড়ির ঠিকানা বললাম, ও কোন বাড়িতে থাকত বললাম, ওর নাম বললাম, ওর বাবার নাম বললাম। গলির মুখে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেমন মিটিমিটি হাসত, তেমনি হাসতে লাগল মল্লিকা। আমি ধরে নিলাম চিনতে পেরেছে, এবং আগে পারেনি। বলেই লজ্জা পাচ্ছে। যে দামে সে জুতো নিয়ে চলে গেল, দেখে দোকানের কর্মচারীরা। হাঁ। আমার পর পর তিন রাত ঘুম হল না।
এর পরের দেখা ওই কলেজ স্ট্রীটে, আড়াই বছর বাদে। আমার মা তখন স্বর্গে গেছে। আর আমি একটা বড় দাওয়ে নড়বড়ে জুতোর দোকান বেচে দেবার মওকা খুঁজছি। বেচতে পারলে কি করব তখনো ঠিক করে উঠতে পারিনি। পাশের বইয়ের দোকানের ছোকরা মালিকটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার সর্বাঙ্গে ঝাঁকুনি। দেখি বইপত্র বুকে চেপে মল্লিকা দত্ত বইয়ের দোকানগুলো দেখতে দেখতে চলেছে। আমার আলাপী ছোকরাটি তাকে দেখিয়ে যে টিপ্পনী কাটল শুনে আমার ভেতরটা কি-রকম যেন হয়ে গেল। বইয়ের দোকানের ছোকরা হেসে হেসে যা জানালো তার সারমর্ম, ওই মেয়েটির নাম মল্লিকা দত্ত, এম. এ. পড়ে। নানা কাগজে তার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। এখন কবিতার বই ছাপার বাই চেপেছে মাথায়। সেই সব ছাপা কবিতা আর বাঁধানো একখানা কবিতা ভরতি খাতা নিয়ে সমস্ত পাবলিশারের দোরে দোরে ঘোরে। তার দোকানেও নাকি দুদিন এসে কবিতার বই ছাপার জন্য ঝকাঝকি করে গেছে।
ভিতরে আমার তখন কি-যে হচ্ছিল আমিই জানি। মল্লিকাকে তখনো দেখা যাচ্ছিল। আমার দু চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল আর সেই সঙ্গে আধা-গোচর একটা সংকল্পে বুকের ধুকপুকুনি বাড়ছিল। এর ঠিক চার দিনের মধ্যে দাঁওয়ের অনেক কম টাকায় জুতোর দোকান বেচে দিলাম। দেনাপত্র চুকিয়ে হাতে পেয়েছিলাম মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। কলেজ স্ট্রীটে তখন জলের দরে ঘর পাওয়া শক্ত নয়। চল্লিশ টাকায় সেদিনই একটা খুপরিঘর ভাড়া নিলাম। আর তার সাত দিনের মধ্যে আমার কাঠের র্যাক, কাঁচের র্যাক, সামনের কাউন্টার, ঝকঝকে সাইন বোর্ড রেডি। আমি তখন কল্প-ভারতী