ট্রেন ছাড়ার আগেই লোকটা নির্বিঘ্নে উঠল আবার। হাতে পানের ঠোঙা। তারপরেই আমি অবাক। এক-গাল হেসে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।–পান খাবেন সার?
সৌজন্যের খাতিরে হেসে মাথা নাড়লাম, খাই নে।
তাড়াতাড়ি সিল্কের জামার পকেটে হাত ঢোকালো।-সিগারেট?
আবারও মাথা নাড়লাম। তাও চলে না।
পরক্ষণে সার থেকে একেবারে মশাইয়ে অবতরণ।–পান না সিগারেট না, আপনি কেমনতর সাহিত্যিক মশাই! সঙ্গে সঙ্গে এক-গাল হাসি। আপনার পরিচয় আপনার সঙ্গের ওই ছেলে দুটির কাছ থেকে জেনে গেছি… একজন মহাশয় ব্যক্তির সঙ্গে চলেছি, বড় সৌভাগ্য আমার!
বলেই বেশ একটু উত্তেজনা-মেশানো আনন্দ নিয়ে খুপরির মধ্যে ঢুকে গেল। বউয়ের হাতে পানের ঠোঙা চালান করার ফাঁকে চাপা গলায় কি বলল ট্রেনের ঘড়ঘড় শব্দে শোনা গেল না। বউটি সন্তর্পণে এদিকে একবার মুখ ফেরালো।
লোকটা তক্ষুণি আমার বেঞ্চ-এর সামনে ফিরে এলো আবার। বসন্তের দাগভরা। মুখ খুশিতে ভরাট তেমনি।
-আপনাদের মত গুণীজনের সঙ্গে দুটো কথা বলার সৌভাগ্য হল, বড় আনন্দ পেলাম। বসি একটু, আপনি বিরক্ত হবেন না তো?
-না না, বসুন। আপনি যাবেন কোথায়?
-বেনারস। পাশে বেশ জাঁকিয়ে বসল। জন্ম বয়সের কম্ম, কোথাও তো বেরুনো হয় না… সেই কবে বসন্ত হয়ে পটল তুলব-তুলব করছি, বউটা তখন বাবা বিশ্বনাথের চরণে মাথা খুঁড়েছিল, এত বছর বাদে বাবা টেনেছেন–পড়লাম দুর্গা বলে বেরিয়ে। …তা আপনি তো লক্ষ্ণৌ চলেছেন শুনলাম?
-হ্যাঁ।
উৎসুক দু চোখে আমাকে পর্যবেক্ষণ করল একটু।-হ্যাঁ মশাই, আমি শুনেছিলাম, আজকালকার সাহিত্যিকরা কলম ধরলেই পয়সা, অঢেল রোজগার করে এক-একজনে… আপনার তো তার ওপর একগাদা বই-পত্র, আমার বউ পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এনে এনে পড়ে, ভালো লাগলে আমাকে গল্প শোনায়–আপনি ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে আমাদের মত স্লিপারে চলেছেন যে?
বললাম, আমার এতেই সুবিধে হয়, তাছাড়া আপনাদের মত দু-পাঁচ জনের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হয়।
-তাই বলুন, আলাপ পরিচয় না হলে লিখবেন কি করে! কিন্তু… থাক, নিন্দে করব না। ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো।–এই তোরা ফল খা না–শুনছ! ওদের ফল বার করে দাও, আর এখানেও পাঠাও!
আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই বাপের হুকুম পেয়ে ছেলেরা বেঞ্চির তলা থেকে যে বিশাল ঝুড়িটা টেনে বার করল তার কাপড়ের ঢাকনা সরাতে আমার চক্ষুস্থির। অতবড় ঝুড়িটা ফলে ঠাসা। বড় বড় আপেল, নাশপাতি, বেদানা, আঙুর, কলা, খেজুর, আরো কত কি। বাসি বা শুকনো নয়, লোভনীয় রকমের তাজা। একসঙ্গে বিরাট ঝুড়ি ভরতি এমন ভালো ভালো ফল নিয়ে বেরুতে আর কাউকে দেখি নি।
ছেলে-মেয়েরা যে-যার খুশিমত ফল তুলে খেতে লাগল। এর মধ্যে বউটিকে কিছু বাছা ফল তুলে নিয়ে বেশ করে ধুয়ে দুটো ডিশে সাজাবার উদ্যোগ করতে দেখে আমি তাকে শুনিয়েই বললাম, ওঁকে বারণ করুন, অসময়ে আমি কিছু খাব না।
ফলের আবার সময় অসময় কি! আপনি খাবেন, ওই ফলের ভাগ্যি! দাও গো, তুমি দাও!
উঠে গিয়ে নিজেই ফলের ডিশ দুটো নিয়ে এলো। আমি সত্রাসে আবারও বাধা দিলাম, এত ফল কেউ খেতে পারে!
-খুব পারে, গল্প করতে করতে খান, দেখবেন ফুরিয়ে গেছে, হেঁজিপেজি ফল। তো নয়! বলতে বলতে নিজে আড়াইশ গ্রামের একটা আপেল তুলে নিয়ে কামড় বসালো।
অগত্যা ফলাহারে মন দিয়ে আমি বললাম, আপনার নামটি জানা হল না এখনো।
–আমার নাম রামতারণ, রামতারণ ঘোষ। সাগ্রহে আমার দিকে ঝুঁকল একটু।–এককালে আমি দেড় মাসের জন্য পাবলিশার হয়েছিলাম, বুঝলেন, দেড় মাসে হাজার টাকা লোকসান! তার আগে কলেজ স্ট্রীটে জুতোর দোকান ছিল, সেই জুতোর দোকান। তুলে দিয়ে রাতারাতি পাবলিশার–টেকে কখনো!
আমি হতভম্ব। জুতোর দোকান থেকে পাবলিশার!
আপেল চিবুতে চিবুতে সলজ্জ জবাব দিল, আর বলেন কেন, কপালে ভোগান্তি থাকলে খাবে কে!… যাক সে কথা। আপনাদের মতো দু-একজন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার খুব আলাপ করার ইচ্ছে ছিল অন্য কারণে।
আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালাম। রামতারণ ঘোষ চট করে একবার ঘুরে খুপরির দিকে তাকালো। তার বউ বাইরের দিকে ফিরে বসে আছে। আরো ঘন হয়ে বসে একটু গলা খাটো করে সে বলল, আচ্ছা মশাই, আপনারা যে এত ঝুড়ি-ঝুড়ি প্রেমের গল্প লেখেন, এমন সব মেয়ের কথা লেখেন যা পড়ে রাতে ভালো ঘুম হতে চায় না–তার মধ্যে কোথাও সত্যি কিছু আছে, নাকি সব ফানুস?
ভিতরে একটু নড়বড়ে অবস্থা আমার। জিজ্ঞেস করলাম, কেন বলুন তো? আপনি নিজে বুঝি কখনো প্রেমে পড়েছিলেন?
সচকিত।–ঐ যাঃ, আপনি ঠিক ধষেছেন! কিন্তু আমার প্রেম তত আকাশে উঠে ফানুসের মত ফটাস করে ফেটে গেল, শুধু ফেটে গেল না, আগুন ধরে গেল। –কিন্তু আপনাদের প্রেমের গল্পে সে-রকম বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড তো একটাও ঘটতে দেখি না!
প্রশ্ন চাপা দিয়ে তার ফানুস-ফাটা প্রেমের কাহিনী শোনার লোভ আমার। জবাব দিলাম, ও গল্পে অনেক ভেজাল অনেক জোড়াতাপ্লি থাকে.. আপত্তি না থাকলে আপনার ব্যাপারটা শুনতে ইচ্ছে করছে।
বসন্ত-গুটির ছোপ-ধরা মুখে এবারে সত্যিকারের লজ্জার কারুকার্য দেখলাম। বলল, আমার প্রাণান্ত দশাই হয়েছিল, কিন্তু শুনলে আপনি ভয়ানক হাসবেন। ৬৫ ৪
আমি মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলাম, হাসব না। শেষে দেখা গেল আমার শোনার আগ্রহ থেকে তার বলার আগ্রহ কম নয়। রাত প্রায় সাড়ে-নটা পর্যন্ত দু-তিন দফায় সে আমাকে যে বাঘ কাহিনীটা শোনালো তার বহু শাখা-প্রশাখা পত্র-পল্লব বাদ দিলেও সেটা বর্ণশূন্য মনে হবে না বোধহয়। কিন্তু কাহিনীটি এমন যে সেটুকুওঁ হুবহু তার নিজের ভাষায় ব্যক্ত করলে বর্ণবৈচিত্র্য আরো বাড়বে বলেই বিশ্বাস।