-তারপর অনিমেষবাবু, এটা তাহলে আপনি সত্যি কথাই বলছেন–আপনার আদর্শই আজ আপনাকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে?
ক্লান্ত স্বরে উত্তেজনা ফুটিয়ে অনিমেষ সরকার জবাব দিল, চুলোয় যাক আদর্শ –পেটের জ্বালায় সবসুদ্ধ মরলাম–এর থেকে যদি মিস্ত্রীগিরিও শিখতাম
পল্লব বলল, কিন্তু আপনি দশ টাকা চেয়েছেন, ওতে আপনার কদিন চলবে? তিনদিন ধরে তো উপোস চলেছে বলছেন
–দুদিন চললে দুদিনই বাঁচলাম। খিদের জ্বালা যে কি আপনি বুঝবেন না!
-তাই তো… ইয়ে, আমার কাছে খুব ভাল বিলিতি হুইস্কি আছে, খাবেন একটু?
-ওসব আমি কিছু খাই নে মশাই, দুটো বেলা ডাল-ভাত খাবার মতো আমাকে কিছু দিন দয়া করে!
পল্লব গুপ্ত ওদিকের দরজার দিকে তাকালো একবার। তারপর পকেট থেকে সিগার-কেস বার করল।-আচ্ছা, ভাল চুরুট ধরান একটা!
-চুরুট আমি খাই নে, আমার যা দরকার তাই দিয়ে দিন সার
—-ও, পল্লব গুপ্ত ব্যস্ত, কি করে যে আপনাকে আনন্দ দেব একটু, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না, আমার ভাল ভাল কিছু মেয়ের সঙ্গে ইয়ে মানে অন্তরঙ্গতা আছে।
–চলুন যাই, সময়টা ভাল কাটবে।
ক্রুদ্ধ অনিমেষ সরকার উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে আপনি রসিকতা করছেন কিনা বুঝতে পারছি না–এসব অভ্যেসও আমার নেই–এখন আমার দরকার শুধু কিছু খাবার-দশটা টাকা চেয়েছিলাম, অন্তত পাঁচটা টাকা দিয়ে আজকের মতো বাঁচান আমাকে।
এবারে পল্লব গুপ্ত ধীরে-সুস্থে মানিব্যাগ বার করল পকেট থেকে। অনিমেষ সরকার এদিকে ফিরে আছে, ওদিকের দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নির্বাক বিস্ময়ে মঞ্জরী দেখছে তাকে।
পল্লব গুপ্ত বলল, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব বলেছিলাম, তাই দিচ্ছি। এই নিন পঞ্চাশ টাকা
লোকটা পাগল কিনা অনিমেষ সরকার ভেবে পেল না। লোভে দুচোখ চকচক করে উঠল তার। ছোঁ মেরে টাকা কটা নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
বিবর্ণ পাংশু মুখে মঞ্জরী সামনে এসে দাঁড়াল।–কি ব্যাপার? এঁকে কোত্থেকে ধরে আনলে?
রাস্তা থেকে। উপোসের জ্বালায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে বেরিয়েছিল।… দশ টাকা চেয়েছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলাম।
একটা বড় রকমের ধাক্কা সামলে নিল মঞ্জরী। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তার জন্যে এঁকে বাড়িতে ধরে নিয়ে এলে কেন, টাকা তো পকেটেই ছিল?
পল্লব গুপ্ত জবাব দিল, এনেছি তোমার জন্যে। ড্রিঙ্ক করে না, সিগার খায় না, মেয়েদের পিছনে ছোটে না–এ-রকম আদর্শ ব্যক্তির হাল কি হয় সেটা তোমাকে দেখাবার জন্যে।… আমাকেও তুমি এই অবস্থার দিকেই ঠেলে দিচ্ছ।
মঞ্জরা হাঁ করে চেয়ে রইল খানিক, তারপর ছুটে চলে গেল।
একমুখ হেসে পল্লব গুপ্ত সিগার-কেস বার করে দামী সিগার ধরাল একটা। বলল, তারপর এই আপোস।
ফল
ট্রেনে ওঠা মাত্র লোকটার দিকে চোখ গেল তার দুটো কারণ। প্রথম, তার ছ জঙ্কা স্লিপার বার্থ-এর খুপরিটা আমার জানলার ধারের রিজার্ভ বেঞ্চের নাক বরাবর। দ্বিতীয় কারণ, ব্যস্তসমস্ত পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার অসহিষ্ণু চিৎকার চেঁচামেচি। জিনিসপত্র গোছগাছ করা আর শয্যা বিছানোর দ্রুত চেষ্টার ফাঁকে বউটা অজ্ঞাত অপরাধে বার দুই ধমক খেল, আর ছেলে-মেয়ে কটা বার তিনেক তাড়া খেল। আমার ধারণা, এর সবটুকুই ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার দরুন।
মিনিট দশেকের মধ্যে শোয়া এবং বসার পরিপাটি ব্যবস্থা করে আধময়লা রুমাল বার করে ঘাম মুছতে মুছতে লোকটা নিজেই আগে বসে পড়ল। তারপর কর্কশ গলা যথাসম্ভব মোলায়েম করে আহ্বান জানালো, কই গো, বোসো না।… এই ছেলে-মেয়েগুলো, তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, এখন বসতে পারিস না?
হুকুম পেয়ে হুড়মুড় করে প্রথমে ছেলে-মেয়ে চারটে যে-যার পছন্দমতো জায়গা দখল করল। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে। তাদের বয়েস বারো থেকে ছয়ের মধ্যে। তাদেরও চোখে মুখে ট্রেনে ওঠার উত্তেজনার ছাপ। বউটির মুখ দেখা গেল না ভালো করে, ভুরুর নিচে পর্যন্ত ঘোমটা টানা। একটু রোগা ধরনের। যতটুকু দেখা গেল গায়ের রঙ ফরসাই মনে হল। বসার আদেশ পেয়ে সেও এগিয়ে গিয়ে ওধারের জানলার। কাছে গুটিসুটি হয়ে বসল। লোকটি আবার উঠে দাঁড়িয়ে সমনোযোগে দ্বিতীয় দফা জিনিসপত্র পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
লোকটির বয়েস বছর ছেচল্লিশ সাতচল্লিশ হবে। সঠিক অনুমান করা শক্ত, কারণ সমস্ত মুখে বসন্তের দাগ। দাগগুলো বেশ গভীর আর সংখ্যায় অগুণতি। পরনে কালো চওড়া পাড়ের ধুতি, গায়ে প্রায় হাঁটুছোঁয়া কোঁচকানো সিল্কের পাঞ্জাবি, মাথার চুল বেশ পাট করে আঁচড়ানো।
আমার বেঞ্চে দুটি তরুণ সাহিত্যিক বসেছিল। তারা আমাকে তুলে দিতে এসেছে। আমার প্রতি তাদের সবিনয় হাব-ভাব দেখে হোক বা যে-কারণেই হোক লোকটি আমাকেও বার দুই পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর ও-দিক ফেরা রমণীটির উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ল, পান খাবে নাকি গো?
জবাবে তার মাথা দুপাশে নড়ল একটু। অর্থাৎ খাবে না।
-এনে তো রাখি। এই তোরা চুপচাপ বসে থাকবি, খবরদার জায়গা ছেড়ে উঠবি না।
শেষের অনুশাসন ছেলে-মেয়েগুলোর উদ্দেশে। পান আনতে গেল। একটু বাদে আমি ঘড়ি দেখলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। তরুণ সাহিত্যিক দুজন বিদায় নিয়ে নেমে যেতেই ঘণ্টা পড়ল। লোকটা তখনো উঠল না দেখে বউটির চকিত মুখখানা একবার এদিকে ঘুরল, তারপর একটা ছেলেকে সরিয়ে সে জানলার দিকে ঝুঁকল।