বেচারা পল্লব জানালা দিয়ে মনোযোগ সহকারে রাস্তা দেখছে।
আরো মাস ছয় বাদে মনে হল গণ্ডগোলটা বেশ পাকিয়ে উঠেছে। পল্লবের সর্বই বিষণ্ণ অথবা বিরক্ত মুখ। একদিন ঘরে টেনে বসিয়ে জেরা শুরু করলাম, কি ব্যাপার সব খোলাখুলি বলো তো?
ও বলল, আমার বিরুদ্ধে অনেক মারাত্মক অভিযোগ, এ রকম জানলে ও নকি আমার ছায়াও মাড়াত না।
–কি অভিযোগ?
–প্রথম, আমার কোন রকম আদর্শের বালাই নেই।
–তারপর?
–দ্বিতীয়, সিগার।
–সিগার কি?
-আমি সিগার খাই, আমার সমস্ত গায়ে নাকি চুরুটের গন্ধ। চুমু খেতে গেলে ধাক্কা মেরে ঠেলে সরায়। ডেটল দিয়ে মুখ কুলকুচি করে আর গায়ে। সেন্ট মেখে তবে কাছে আসতে হয়–ততক্ষণে আমার চুমু খাওয়ার তেষ্টা চলে। যায়।
ওর খোলাখুলি বলার নমুনা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। পল্লব বলে চলল, তৃতীয় অভিযোগ, ড্রিঙ্ক করা। যত ভাল জিনিসই খাই ও ঠিক টের পায় আর তারপর কুরুক্ষেত্র। চতুর্থ অভিযোগও ওর কাছে তেমনি মারাত্মক–আমি মেয়েদের পিছনে ছোটাছুটি করি। আমার আগের চালচলন কিছু কিছু জেনে ফেলেছে, তাছাড়া বাড়িতে অনেক মেয়ের টেলিফোন আসে
বললাম, একটু সামলে-সুমলে চললেই তো পারো।
ও রেগে গিয়ে বলল, সব ছেড়ে-ছুঁড়ে পরমহংস হয়ে বসে থাকব? আমি তো মঞ্জরীকে শাসিয়েছি, এ-রকম করলে চাকরি-বাকরি ছেড়ে বিষয়-আশয় বিলি করে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব–তাতেও ঘাবড়ায় না!
আরো মাস তিনেক বাদে একদিন দুজনেই এসে হাজির আমার বাড়িতে। সেদিন আবার ভিন্ন মূর্তি দুজনেরই। পল্লব গুপ্ত আগের মতোই হাসিখুশি আর মঞ্জরীও যেন আগের সেই লাবণ্যময়ী মিষ্টি মেয়েটি। ওদের কথাবার্তা থেকেও বোঝা গেল মাঝের একটা বছরের সমস্ত অশান্তি আর মনোমালিন্য অপগত। এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হে, কিছু একটা ম্যাজিক-ট্যাজিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে?
খুশিতে ডগমগ পল্লব বলল, ম্যাজিক বলে ম্যাজিক–একেবারে নিদারুণ ম্যাজিক দাদা!
–কি করে হল?
–সেই অনিমেষ সরকারের কল্যাণে।
শুনে আমি অবাক।
তারপর মঞ্জরীকে ও-ঘরে আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে বসিয়ে দিয়ে ও মনের আনন্দে যে ফিরিস্তি দিল, তাতে আমি আরো অবাক। মঞ্জরী ওর সঙ্গে আপোস করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যার পরে পর্যন্ত গোটা ছয় সিগার চলতে পারে, ড্রিঙ্ক একেবারে ছাড়তে হবে না, বড় পার্টি হলে মাত্রা রেখে খেতে হবে, আর মেয়েদের সঙ্গে হৈ-হুঁল্লোড় করে বেড়ানোতেও আপত্তি নেই, তবে মঞ্জরীর অনুপস্থিতিতে সেটা করা চলবে না –যেখানে যাবে সে-ও সেখানে উপস্থিত থাকবে।
বলা বাহুল্য, পল্লব গুপ্ত সানন্দে রাজী। ম্যাজিকের ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই রকম :
…সেদিনও মেজাজপত্র, বিগড়েই ছিল পল্লব গুপ্তর। তিন দিনের মধ্যে মঞ্জরী কাছে আসেনি, ওকেও কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। সামনা-সামনি রাগও করতে পারে না পল্লব, কারণ সে রাগলে মঞ্জরী ডবল রাগে–আর তখন আরো বেশি আক্কেল দিতে চেষ্টা করে।
বিকেলে ওই রকম মেজাজ খারাপ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ফুটপাথের পাশে একেবারে একটা হ্যাঁগার্ড মার্কা লোককে দেখে গাড়ি থামাল। জামা-কাপড় আর ওই মূর্তি দেখলে কেউ তাকে ভদ্রলোক ভাববে না। তার ওপর একগাল দাড়ি, মাথার রুক্ষু চুল ঘাড় আর কান বেয়ে নেমেছে। গালের হাড় উঁচিয়ে আছে, দু চোখ গর্তয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিমেষ সরকারকে চিনতে পারল পল্লব গুপ্ত। বিয়ের আগে দু-দুটো দিন মঞ্জরীর ঘরে বসা দেখেছে-এ মুখ ভোলার কথা নয় তার।
কিন্তু অনিমেষ সরকার পল্লব গুপ্তকে দেখেও নি, চেনেও না। গাড়ি থেকে নেমে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে?
কোটরের দুই চোখ তুলে লোকটা তাকালো, বুভুক্ষু চাউনি।–আপনি…?
–আমাকে চিনবেন না, আমি আপনাকে চিনি। আদর্শ মানুষ ছিলেন, এক সময় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
লোকটার সেই ক্ষুধার্ত চোখ দুটো জ্বলে উঠল একবার। বিড়বিড় করে বলল, আদর্শ আর দেশের কাজ কোথায় আমাকে এনেছে দেখতেই পাচ্ছেন।… চেনেন যদি একটু উপকার করতে পারেন?
-বলুন?
–গোটা দশেক টাকা দিতে পারেন–ভাই-বোনদের নিয়ে তিন দিন ধরে উপোস চলছে!
পল্লব গুপ্ত চকিতে ভেবে নিল কি। তারপর বলল, আসুন আমার সঙ্গে, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব
লোকটা হতভম্বের মতো তার গাড়িতে উঠল। তাকে নিয়ে পল্লব গুপ্ত সটান বাড়ি। অকারণে হর্ন বাজিয়ে যা আশা করেছিল তাই হল। মঞ্জরী দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ থেকে অনিমেষ সরকার তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
পল্লব গাড়ি থেকে নামল, গলা একটু চড়িয়েই ডাকল, আসুন অনিমেষবাবু! অনিমেষ সরকার যথার্থই হকচকিয়ে গিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে তার সঙ্গে ঘরে এসে বসল।
পল্লব গুপ্ত চট করে বাইরে এলো একবার। যা ভেবেছে তাই। অবাক বিস্ময়ে মঞ্জরী সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে আসছে। পল্লব তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, তোমার সেই আদর্শ পুরুষ অনিমেষ সরকার কিছু আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, তুমি এক্ষুণি ঘরে ঢুকো না।
মঞ্জরী হতভম্ব। যাকে দেখেছে ওপর থেকে সে অনিমেষ সরকার কি তার কঙ্কাল ভেবে পেল না। আর এই রকম বেশবাস…।
পল্লব বসার ঘরে ফিরে এলো আবার। দরজার ওধারে শ্রীমতীর অবস্থান স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছে। প্রতিটি কথাও ঠিকই কানে যাবে।