হাসি চেপে জল এনে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কতদিন এই দশা চলেছে। তোমার?
টানা দুমাস হয়ে গেল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দাদা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে চোখের মধ্যে কেবল ওই মঞ্জরী সেনই ঘুরপাক খাচ্ছে দিবারাত্র।
–তোমাকে সে-রকম পাত্তা দিচ্ছে না?
-একেবারে দিচ্ছে না বললেও ঠিক হবে না। হাজার হোক বাপের বিষয়ের সুপুর হয়ে বসেছি, ভাল চাকরি করি, নিজের একটা ঝকঝকে গাড়িও আছে-সকলের চোখে আমার দাম যে কিছু আছে সেটা ও মেয়েও বোঝে। কিন্তু ওই চেহারাপত্তর নিয়ে সে এই বাইশ বছর পর্যন্ত নিজেকে আগলে বসে আছে বর্গে তো বিশ্বাস হয়। না–দখলদারির জন্যে কে হাঁ করে আছে জানতে পারলে তবে তো ডুয়েল-টুয়েল লড়তে পারি–সেটাই যে কিছু আঁচ করতে পারছি না। মাসির মুখে শুনেছি, এম. এ. পাস না করে বিয়ে করবে না ঘোষণা করেছিল নাকি-কিন্তু আসলে সেটা কাউকে কিছু সময় দেবার ছল কিনা কে জানে-এবারে এম. এ. পাস করেছে শুনে আমার বুকের প্যালপিটেশানে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে।… ভাল কথা, মঞ্জরীর সঙ্গে কাল কিছু সাহিত্য-আলোচনা হয়েছিল। সেই কবে ইংরেজিতে এম. এ. পাস করেছিলাম, এতদিনে। সব গুলে খেয়ে বসে আছি! আর বাংলা সাহিত্যের দৌড় বঙ্কিম আর শরৎ পর্যন্ত, তাও বঙ্কিমের নায়িকার সঙ্গে শরৎবাবুর নায়িকা গুলিয়ে গেছে-কিন্তু মঞ্জরী দেখলাম আধুনিক সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, আপনার নামও দু-চারবার করল, কি ছাই লিখেছেন খানকতক বই বার করুন তো, প্রেসটিজটা বাঁচাই–
ওর পাল্লায় পড়লে আমারই প্রেসটিজের দফারফা হবার ম্ভাবনা। কিন্তু আলমারির বইয়ের কলেবর দেখে পল্লব আঁতকে উঠল।-এ আমার পড়ার সময় হবে কখন! তার থেকে বরং দু-চারখানা বইয়ের পাঁচ-সাত লাইনের মধ্যে জিস্ট বলে দিন তাই দিয়েই সামলে নেব।
অব্যাহতি পাবার আশায় বললাম, তার থেকে তুমি বরং কিছু জানান না দিয়ে মঞ্জরী সেনকে এখানে একদিন ধরে নিয়ে এসো, সে তার ইচ্ছেমত বই বেছে নেবেখন, আর সাহিত্যিকদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে এও ধরেই নেবে।
ও বলল, মতলবটা ভালই দিয়েছেন। দেখা যাক।
যাবার আগে মঞ্জরী সেন সম্পর্কে আরো একটু খবর দিল পল্লব গুপ্ত। সমবয়সী মাসতুতো ভাই বলেছে, মঞ্জরী সে-রকম কোন ছেলেকে ধরে বসে আছে বলে মনে হয় না। তবে একটা ছেলে–তার নাম অনিমেষ সরকার, সে এখনো প্রায়ই ওদের। বাড়িতে আসে। আগে মঞ্জরীদের পাড়াতেই থাকত সেই লোক, ভাড়া না পেয়ে বাড়িওলা কেস করে তাদের উঠিয়েছে। লোকটা রাজনীতি করত, জেল-টেলও খেটেছে। মঞ্জরী নাকি আদর্শ নিয়ে খুব মাথা ঘামায়, তাই তার কাছে এই লোকটির কদর। তাকে নিয়ে মঞ্জরীর ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে কিনা সেটা অবশ্য মাসতুতো ভাই সঠিক বলতে পারল না। ওদের বাড়ি গিয়ে সেই অনিমেষ সরকারকে মঞ্জরীর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছে পল্লব-একদিন নয়, দুদিন দেখেছে। আর তারপর থেকে গুণ্ডা লাগিয়ে খতম করা যায় কিনা সে-কথাও ভাবছে।
সব মিলিয়ে বোঝা গেল মঞ্জরী সেন নামে একটা মেয়ের জন্য পল্লব গুপ্তর এখন আহার-নিদ্রা ঘুচতে বসেছে।
সত্যিই মঞ্জরীকে একদিন বাড়ি নিয়ে এলো সে। আর আমারও ভালই লাগল। রূপসী না হোক বেশ সুন্দরীই বটে। আর সমস্ত মুখে ভারী একটা লাবণ্য মাখা। আমি পল্লবের প্রশংসা করলাম খুব, আর খানকতক বইয়ে তার নাম লিখে দিলাম। পরদিনই পল্লব লাফাতে লাফাতে এসে হাজির।
–দাদা, কাল আমার প্রেসটিজ যে কি বেড়ে গেছে ভাবতেই পারবেন না–বেরিয়ে এসে আমাকে চোখ রাঙালো, এ-রকম একজন লোকের সঙ্গে এত খাতির আমাকে কক্ষনো বলেননি পর্যন্ত! দাদা, আপনি যে এ-রকম একজন লোক সে তো আমিও এই প্রথম শুনছি!
আমার হাসিই পাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, অনিমেষ সরকারের খবর কি?
হেসে হেসে পল্লব বলল, অনিমেষ সরকারের?–তার বরও মাসতুতো ভাইয়ের মুখে যা শুনলাম আশাপ্রদ। আমার বরাত-গুণে লোকটা নিতান্ত গরীব–আর এরই মধ্যে নাকি কতগুলো ছোট ছোট ভাই-বোন রেখে তার বাবা মারা গেছে–বাবার বদলে অনিমেষ সরকার গেলে আরো একটু খুশি হওয়া যেত। তবে আর একটা ভাল খবর শুনলাম, মঞ্জরীর মা নাকি সাংঘাতিক গরীব ঘরের মেয়ে ছিল, রূপের জোরে সুখের ঘরে এসেছে। তাই মেয়ের কোন গরীব ছেলের সঙ্গে চেনা-জানা আছে শুনলেও নাকি ত্রাস তার। এই কারণেই অনিমেষ সরকারকে মা দুচক্ষে দেখতে পারে না। আর মাসতুতো ভাই বলে মঞ্জরীও গরীবানা চালে থেকে অভ্যস্ত নয়–যতই আদর্শ আর্শ করুক।
এরপর পল্লব গুপ্ত আবার একদিন এসে আনন্দের আতিশয্যে আমাকে ধরে দুটো ঝাঁকানি দিল। তারপর বিয়ের নেমন্তন্ন-পত্র হাতে দিল। বলল, এ যে এত সহজ ব্যাপার হবে ভাবতেও পারিনি দাদা–ওদের লক্ষ্যও যে আমি এ কি ছাই আগে বুঝেছি! তাহলে নির্লিপ্ত থেকে নিজের আর একটু কদর বাড়ানো যেত!
কিন্তু ওদের বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই আমার কেমন মনে হল সমাচার ব কুশল নয়। গণ্ডগোলের সূত্রপাত মঞ্জরার দিক থেকে। দিলদরিয়া পল্লব ওর কেমন হাসাস দশা একটু। গম্ভীর মুখে মঞ্জরী একদিন আমাকে স্পষ্টই বলল, প্রথম দিন আপনি বাড়িয়ে বলেছিলেন দাদা, ওর অনেক খারাপ অভ্যাস আছে।
আমি আমতা আমতা করে বলেছি, কেন, এ রকম খোলামেলা চরিত্র
বাধা দিয়ে ঈষৎ ঝাঝালো সুরে মঞ্জরী বলল, চরিত্রেরও গলদ আছে।