শুনে আমার কান মন দুই-ই বিষিয়ে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সতের বছর আগের একটা ঘটনাও বার বার মনে আসতে লাগল। ফলে ভিতরটা আরো বেশি ভারাক্রান্ত হয়েই থাকল।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকতে বেলা একটা। ভারী খাওয়ার ফলে বন্ধু তার ঘরে একটু গড়াগড়ি করে নিতে গেলেন। আমাকেও তাই করতে বললেন।
গড়াগড়ি করতে গিয়ে হিসেব ভুলে বন্ধু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন নিশ্চয়। কারণ। তার আবার এ-ঘরে পদার্পণ ঘটল বেলা তখন চারটে। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই তিনি। হা একেবারে।
আমি আমার শয্যাতেই বসে আছি। আমার সামনে মেঝেতে বসে আছে সরস্বতী। এখন তার সঙ্গে ছেলেও নেই।
গৃহস্বামীর হতচকিত অবস্থা দেখে সরস্বতী বিব্রত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।
আমি ওকে উদ্দেশ্য করে হাল্কা সুরেই বললাম, বাড়ির মালিক ঘুমুচ্ছিলেন বলেই তুই এক ঘণ্টা ধরে এখানে বসে যেতে পারলি। যা পালা এখন, সাড়ে পাঁচটা নাগাত তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিস–কেষ্টকে দেখে আসতে যাবখন।
সরস্বতীর ঠাণ্ডা মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল। কিন্তু সাহস করে সেটুকু প্রকাশ করতে পারল না। আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বন্ধু আমার দিকে চেয়ে আছেন, আমাকেই দেখছেন। মাথার বিকৃতি কি আর কিছু তাই ভাবছেন। আমাকে হাসতে দেখে তার পিত্তি জ্বলে গেল বোধ হয়। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, আমার সকালের এত কথা তোমার কানে গেল না? তুমি ওর বাড়ি যাবে?
-শুনলেই তো। মাথা ঠাণ্ডা করে বোসো। ঘুরে এসে তোমার হিসেবের বাইরে তোমাকে যদি কিছু না শোনাতে পারি তো আজ রাতেই আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে নিশ্চিন্ত হয়ো।
বলার ধরনের ব্যতিক্রমটুকু কানে লেগেছে।-এখনি বলে শুনি, এক ঘণ্টা ধরে মেয়েটা তোমাকে কি এমন বলে গেল যে তুমি গলে জল হয়ে গেলে?
বললাম, এখন না, আগে ঘুরে আসি।
ঘুরে এলাম। এ-সব জায়গায় শীতকালের সাড়ে সাতটা মানে রাতই। ঘরে পা দিয়েই মনে হল বন্ধু আর বন্ধু-পত্নী দুজনেই আমার জন্যে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরেই বসে ছিলেন তারা। বন্ধু-পত্নী উঠে দাঁড়িয়ে। বললেন, আগে এক পেয়ালা চা খাওয়াই আপনাকে।
বাধা দিলাম, কিছু দরকার নেই, বসুন, এর মধ্যে দু পেয়ালা হয়ে গেছে।
বন্ধু বলে উঠলেন, কোথায় হল, তোমার ওই সরস্বতীর ওখানেই?
-হ্যাঁ। শয্যায় বসে তার দিকে ফিরলাম।–যা বলব সে যদি তোমার হিসেবের বাইরে হয়, আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে, আর সে অনুরোধ রাখাটা। তোমার একটুও সাধ্যের বাইরে নয়–বউদি আপনি সাক্ষী।
বন্ধু বললেন, ভণিতা ভালই হয়েছে এখন ব্যাপারখানা কি শুনি!
এরপর যে চিত্রটা ওদের গোচরে এনেছিলাম, পাঠকের সামনেও সেটুকুই তুলে ধরছি।
সরস্বতীর মায়ের নাম কমলা দাসী।, আমাদের বাড়ির ঝি ছিল। বারো বছরের মেয়ে সরস্বতীকে নিয়ে সকালে আর বিকেলে আমাদের বাড়ি কাজ করতে আসত। কমলার বয়েস তখন বেশি হলে সাতাশ-আটাশ। স্বামী নেই, শুনেছি বছর দেড় দুই আগে বিধবা হয়েছে। আমাদের বাড়ির বউরা কাজে-কর্মে খুব একটা খুঁত ধরতে পারত না তার, তবু ওর ওপর তেমন খুশি ছিল না। বলত ওর স্বভাব চরিত্র সুবিধের নয়, কবে কার সঙ্গে কোন রাস্তায় নাকি ওকে দেখা গেছে একাধিক দিন। পরে বউরা তাকে জিজ্ঞাসা করতেও নাকি বলেছে আমার অমুক সম্পর্কের আত্মীয়। তাছাড়া চাল-চলনও ভালো নয়। বাড়ির ঠাকুরটার সঙ্গে নাকি ঠারেঠোরে কথা বলে, ফাঁক পেলে হাসাহাসি করে, যার দরুন ঠাকুরটা ওকে দু বেলাই বেশি-বেশি চা-রুটি দেয় ইত্যাদি।
মেয়েদের এ-সব কথায় আমি বড় একটা কান দিইনি। ভেবেছি, ওদের শ্রেণীর মেয়েদের তুলনায় কমলা দাসীর চেহারাপত্রের চটক বেশি, আর মোটামুটি সুশ্রী আর স্বাস্থ্যবতী বলেই মেয়েদের ওই গোছের সন্দেহ। তাছাড়া কান না দেবার আরো কারণ, ওর মেয়েটা সত্যিই স্নেহের পাত্রী হয়ে উঠেছিল আমার। সুন্দরী না হোক ভারী মিষ্টি দেখতে, না ফর্সা না কালো, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, বড় টানা-টানা দুটো চোখ। মুখ বুজে মায়ের কাজে সাহায্য করত, তারপর ফাঁক পেলেই দোতলায় চলে আসত। সকালে আমি নিজের মেয়ে আর ভাইঝিদের পড়াতাম, সন্ধ্যায় তাদের গল্প শোনাতাম। এই দু বেলার আসরে ওর উপস্থিত থাকা চাই-ই। ওর এত আগ্রহ দেখে ওকেও ছাত্রী করে নিলাম। বাড়িতে থাকতে বিনা বেতনের প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। আবার ভর্তি করে দিলাম। খুশিতে কৃতজ্ঞতায় মেয়েটা যেন আমার কেনা হয়ে গেল।
চার বছর বাদে সরস্বতীর মা কমলা মেয়ে ফেলে সত্যি কার সঙ্গে উধাও হয়ে। গেল। বাড়ির মেয়েরা তখন সরস্বতীকেও বিদায় দিল। ও তখন ষোল বছরের মেয়ে, বাড়ন্ত গড়ন। মেয়েদের বিশ্বাস ওরও স্বভাবচরিত্র মায়ের মতোই হবে। কারণ পাড়ার ভদ্র ঘরের একটা বখাটে ছেলের সঙ্গে ওর ভাবসাব দেখা যাচ্ছে। আর ওদের বস্তির কতগুলো ছোকরাও নাকি বাড়ির আশপাশে সর্বদা ঘুরঘুর করে। ভদ্রঘরের ওই ছেলেটা আস্কারা পায় বলে ওদের নাকি সরস্বতীর ওপর ভয়ানক রাগ। সেই ভদ্রঘরের ছোকরাকে আমি চিনি। নাম কৃষ্ণ ঘোষ, সকলে কেষ্ট বলে ডাকে। লেখাপড়ায় স্কুলের বেড়া পার হতে পারেনি। তখন শ্যামনগর না কোথায় একটা কাগজের কলে ঢুকেছে। হাতে কিছু পয়সা আসতেই বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে।