ব্যাপার কি না বুঝে আমি বন্ধুর দিকে তাকালাম। মেয়েটার এরকম দুঃসাহস দেখে বন্ধুও কিছুটা অবাক আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুটি করে ওদের দিকে চেয়ে আছেন।
পায়ে পায়ে মেয়েটা এবার আমাদের এই দাওয়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। মদের বেঁকে আবার কি কাণ্ড বাধায় আমার সেই অস্বস্তি। বন্ধুও হকচকিয়ে গিয়ে থাকবেন।
পায়ে পায়ে মেয়েটা এসে একেবারে দাওয়া ঘেঁষে দাঁড়াল। অপলক চাউনি আমারই মুখের ওপর। নেশার ঘোর কেটে গিয়ে তারও যেন কিছু বিস্ময়ের কারণ ঘটেছে। অভাবের ছায়া এটে বসা কমনীয় মুখ, উসকো-খুসকো ঈষৎ কোঁকড়া লালচে চুল। খাটো ডুরে শাড়ি পরা সুঠাম গড়ন, শরীরের সবটুকুর পক্ষে ওই ছোট শাড়ি আদৌ যথেষ্ট নয়। বছর তিরিশ-বত্রিশের বেশি বয়েস মনে হয় না। মাথার ছোট ঘোমটাটাও এর মধ্যে খসে গেছে। আমি কেমন বিমূঢ় হঠাৎ। এই গোছের একখানা মুখ আমি কি কোথাও কখনো দেখেছি? একেবারে অচেনা লাগছে না কেন?
পাশ থেকে বন্ধু প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন, কি চাই এখানে?
ধমক খেয়ে মেয়েটার বিস্ময়ের ঘোর কাটল যেন। এবার বন্ধুর দিকে তাকালো। তার ভয়লেশশূন্য সাদাসাপটা কথা শুনে আমি হতভম্ব।তাড়া দেন কেন বাবু, আমি কি চুরি করতে এয়েছি? পরক্ষণে আমার দিকে ফিরতে ঢুলু ঢুলু চোখে আগ্রহ যেন উপচে উঠল। জিজ্ঞাস করল, কলকাতার মুখুজ্জে বাড়ির সেজবাবু না?
আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই। এবারে অবাক বোধ হয় বন্ধুটিও। নিজের অগোচরে। মাথা নেড়েছিলাম কিনা খেয়াল নেই। নিজের বাড়িতে আমি সেজবাবুই বটে।
চোখের পলকে মেয়েটা এবার দাওয়ায় উঠে এলো। তার পরেই উপুড় হয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম। আমি বাধা দেবারও সময় পেলাম না। প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির মালিকের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ঘাড় ফিরিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক দিল, ভুলু, শীগগির আয়!
ছেলেটারও হয়তো নেশা ছুটে গেছে। সে হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসতেই বলে উঠল, দেবতার দেখা পেয়ে গেলি আজ, গড় কর শীগগির, গড় কর।
ছেলেটাও কিছু না বঝেই তাড়াতাড়ি প্রণাম সেরে উঠল। আমি তখনও আঁতিপাতি করে খুঁজছি কে হতে পারে এরা।
মেয়েটার চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে, আপনি এখানে সেজবাবু! বেড়াতে এয়েছেন?
-হ্যাঁ, আমার এই বন্ধুর বাড়ি এটা।
বাড়ির সকলে ভালো আছেন? সেজ-মা ভালো আছেন?
সেজ-মা বলতে আমার স্ত্রী। আমি বললাম, সব ভালো, কিন্তু তোমার নাম কি বলো তো?
সে বলে উঠল, ও-মা, এখনো এই পোড়ারমুখিকে চিনতেই পারলেন না সেজবাবু! আমি আপনাদের বাড়ির সেই কমলা দাসীর মেয়ে সরস্বতী!
শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে বিস্মৃতির পর্দাটা সরে গেল। এবার তাকাতেই মনে হল ষোল বছরের আধফর্সা কেঁকড়া কচি-কাঁচা মিষ্টি মুখের সঙ্গে আরো সতেরটা বছর জুড়লে এরকমই হতে পারে বটে। মগজে একরাশ স্মৃতি একসঙ্গে ভিড় করে আসছে। আবার একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা দিল সঙ্গে সঙ্গে। কিছুটা নির্লিপ্ত গাম্ভীর্যে বললাম, এবারে চিনেছি। কেষ্টর খবর কি?
–ঘরে আছে। অষ্ট পহর ঘরেই থাকতে হয়, ঘর থেকে বেরুনোর উপায় নেই। সাগ্রহে আঙুল তুলে মেঠো রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ওই মাঠ ছাড়ালেই বস্তি এলাকায় আমাদের ঘর–মাঠ ভেঙে গেলে কাছেই–আপনি এখানে দিন কয়েক থাকবেন সেজবাবু?
মুখে বলতে সাহস করল না বটে, কিন্তু এমন করে বলল যে পারলে এক্ষুনি ও আমাকে ওদের ঘর দেখাতে টেনে নিয়ে যায়।
বন্ধুর বিরক্তি-ছাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো গম্ভীর। বললাম, না, পরশু ভোরে চলে যাব। তারপর প্রায় রূঢ় গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এভাবে হেঁটে আসছিলি কেন–সকালেই মদ গিলেছিস আর ছেলেটাকেও খাইয়েছিস?
সরস্বতী থতমত খেল একদফা। দেখতে দেখতে সমস্ত মুখটাই বিষাদে ছেয়ে গেল। বলল, আপনি নেদ্যয় হলে ভগবান আমাকে আরো কত মারবেন ঠিক নেই, আপনার কথা আমরা এখনো বলি, আপনি দয়া রাখবেন সেজবাবু! বিষ না খেয়ে আমাদের পেটে ভাত জোটে না যে, কি করব…
বলতে বলতে একটা উদগত কান্না ভিতরে ঠেলে দিয়ে ছেলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি দাওয়া থেকে নেমে গেল। তারপর হনহন করে পথ চলল।
শেষের এই কথাগুলো শুনে কেন যেন আমার বুকের তলায় মোচড় দিয়ে উঠল। কি ব্যাপার আমি ভেবে পেলাম না। ওর স্বামী কেষ্ট ঘোষের ঘর ছেড়ে বেরুনোর উপায় নেই কেন? বিষ না খেলে পেটের ভাত জোটে না বলার মানে কি? মদ গিলে আগে বিবেকের গলা টিপে মেরে তারপর নিজের দেহ বেচে স্বামী পুত্রের ভাত জোটাতে হচ্ছে? তাহলে ছেলেটা সঙ্গে যাবে কেন? ছেলেটাও মদ গিলবে কেন?
বন্ধুর বিরস মুখের দিকে চেয়ে বললাম, মেয়েটা ভারী মিষ্টি আর ভালো ছিল এক সময়
বন্ধু বাধা দিয়ে উঠলেন, এক সময় বলতে সেই সতের বছর আগে তো? এর মাঝে আর দেখেছ?
মাথা নাড়লাম। দেখিনি।
তাহলে এখন আর ভালোটালো বিচার করতে বোসো না। তবে এখনো অনেক লোকে ওকে মিষ্টি দেখে। ওই মেয়ে এই দাওয়ায় উঠে কথা বলছিল দেখে কটা লোক অবাক হয়ে এদিকে চাইতে চাইতে চলে গেল তুমি খেয়াল করোনি। ওর সুনাম কেমন বুঝছ?
সরস্বতীর এ-বাড়ির দাওয়ায় উঠে কথা বলাটা বন্ধুর একটুকুও পছন্দ হয়নি বোঝা গেল। আবার বললেন, তোমার ওই ভালো মেয়ে এখন ছেলে নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় কলকাতা যায় চোলাই মদ বিক্রী করতে আর সকালে ফেরে। বুঝলে? কাপড়ের নীচে ওদের কোমরে চোলাই মদ পাচার করার ব্লাডার বাঁধা থাকে। যা বেচতে পারল বেচল, বাকিটা মা আর ছেলে মিলে যে সাবড়ে দেয় সে তো ওদের নিজের চোখে দেখেই বুঝতে পারলে। এই করে ঘরের পঙ্গু স্বামীর আর ছেলের ভাত জোটাস বুঝলাম, তা বলে নিজেরা খাস কেন! তাছাড়া তোমার ওই ভালো মেয়ের পিছনে অনেক লোক লেগে আছে, তার মধ্যে পয়সাওলা লোকেরও অভাব নেই শুনেছি। ওই বস্তি এলাকায় ওর কিছু পিয়ারের লোকও আছে-কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে ওদের লেলিয়ে দেয়, দু-চারজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মারপিটের খবরও আমার কানে এসেছে।