বাইরের দাওয়ায় বন্ধুর সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এসেছি। তিনি রাত থাকতে ওঠেন, সন্ধ্যা আহ্নিক করেন। এরই মধ্যে তার সব কিছু সারা। মুখ হাত ধুয়ে তার পাশে এসে বসলাম। তিনি হেসে বললেন, এত ঘুমোও কি করে বাপু! তুমি উঠবে-উঠবে। করে গিন্নি সেই কখন চায়ের জল চড়িয়ে বসে আছে।
বললাম, আজ তো তবু ঢের আগে উঠেছি, সাড়ে ছটাও নয় এখন
দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা এসে গেল। সর্ব ব্যাপারে আমার এই বন্ধুটির হিসেবের বায়ু আছে। হিসেবের ভিতর দিয়ে সবকিছুরই একটা পাকা চিত্র ছকে ফেলার ঝোঁক। চা খেতে খেতে যখন শুনলেন কলকাতায় সাড়ে সাতটার আগে আমার ঘুমই ভাঙে না, ছুটির অবকাশে তক্ষুনি একটা হিসেব মাথায় ঢুকে গেছে তার। এগারোটায় শুয়ে সাড়ে সাতটায় ওঠা মানে কম করে আট-সাড়ে আট ঘন্টার ঘুম–আট ঘণ্টাই ধরা। যাক। তাহলে এক মাসে অর্থাৎ তিরিশ দিনে দুশ চল্লিশ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটে-বছরে হল গিয়ে দুশ চল্লিশ ইনট বারো–হল গিয়ে দু হাজার আটশ আশী ঘণ্টা। তাহলে ধরো মোট যদি পঁচাত্তর বছর বাঁচো তাহলে
আমি ভাবলাম এই হিসেবটা আর মুখে মুখে এগোচ্ছে না। কিন্তু তিনি বলে। উঠলেন, ধ্যেৎ ছাই আমি বোকার মতো এভাবে হিসেব করছি কেন–আট ঘণ্টা ঘুমানো মানে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমনো–তাহলে পঁচাত্তর বছরের তিন ভাগের এক ভাগ হল গিয়ে পঁচিশ বছর–সোজা হিসেব! তাহলে দেখো পঁচাত্তর বছরের মধ্যে পঁচিশটা বছর তুমি স্রেফ মরার মতো ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলে।
হেসেই বললাম, থামো এখন, তোমার হিসেবের কলে পড়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে–এক্ষুনি না আবার ঘুম পেয়ে যায়।
হাসতে লাগলেন বন্ধুও। বললেন, না, এই হিসেবের ফল ঠিক উল্টো-সর্বব্যাপারে মিতাচারী হবার মহৌষধ। দেখো, আগে আমি সিগারেট খেতাম কম করে দিনে দশটা। পঁচাত্তর বছরের জীবনে হিসেব করে দেখলাম দু লক্ষ সত্তর হাজার সিগারেট খেতে হবে–ব্যস সিগারেটের নেশা খতম। পান খাওয়াও এই হিসেব করেই কমিয়ে ফেলেছি
শুনতে মজা লাগছিল বেশ। চোখ টিপে গলা খাটো করে বললাম, তোমার যৌবনকালের গার্হস্থ্য ধর্মেও এই হিসেব মাথায় ছিল না তো?
বন্ধুর ছেলে মাত্র একটি, মেয়ে নেই। হা-হা শব্দে হেসে উঠে হাঁক দিলেন, ওগো শুনছ!
সচকিত হয়ে বললাম, আমি কিন্তু উঠে পালাব তাহলে
কিন্তু হাঁক শুনে তার গৃহিণী এসেই গেছেন। অগত্যা হাসি সামলে বন্ধু বললেন, চায়ের পেয়ালাগুলো নিয়ে যেতে বলো–
এই সাত সকালে দাওয়ায় বসে কিছু রঙ্গরস চলছে, তার গৃহিণী সেটা আঁচ করে হালকা সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন।
হাসি গোপন করার চেষ্টায় আমি সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কুয়াশা অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে। তার ওপর রোদ ঝিকমিক করছে। হঠাৎ অদূরে একটা দৃশ্য দেখে আমার দু চোখ সেদিকে আটকালো। সামনের ওই রাস্তাটা ধরে শ্লথ পায়ে একটি রমণী এগিয়ে আসছে। পা ফেলে ফেলে তার এগিয়ে আসার ধরনটা যেন কেমন! দূর থেকে চেহারাপত্র ভালো ঠাওর করা গেল না। তবে বেশ মজবুত স্বাস্থ্যের মেয়ে এটুকু বোঝা যাচ্ছে। পরনে খয়রী রংয়ের একটা খাটো ডুরে শাড়ি। কিন্তু মেয়েটা এভাবে পা ফেলে ফেলে আসছে কেন!
বন্ধুর উপস্থিতি ভুলে সেদিকেই চেয়ে ছিলাম। আরো কাছে আসতে পরিষ্কার দেখলাম। বেশবাস দেখে বোঝা যায় খেটে-খাওয়া দুঃস্থ গরিব ঘরের বৌ। কিন্তু সুন্দর সুঠাম স্বাস্থ্য। আধফর্সা মুখখানাও বেশ সুশ্রী। মাথায় খাটো ঘোমটা। বয়েস বত্রিশ তেত্রিশ হতে পারে। ঢিমে তালে এলোমেলো পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে। আর যেভাবে আসছে, মনে হল মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারে।
যে কোনো কারণে রমণীটি বেশি-রকম অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভেবে উতলা চোখে আমি বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালাম। দেখি বন্ধু আমাকেই দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা দেখার রোগ না লেখকের রোগ?
বললাম, মেয়েটাকে অসুস্থ মনে হচ্ছে, কিভাবে পা ফেলছে আর ঢুলতে ঢুলতে আসছে দেখছ না?
-ওটা রস-সিক্ত পদক্ষেপ আর রসের ঢুলুনি। মেয়েটার পিছনে যে আসছে তাকেও দেখো! ৬৬৮
বন্ধুর কথা শুনে যেমন অবাক আমি, ওই মেয়েটার পিছনে গজ বিশেক পিছনে পিছনে যে আসছে তাকে দেখেও তেমনি অবাক। বছর চৌদ্দর একটি ছেলে। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে হেঁভা শার্ট। আদর-যত্ন পেলে ওই কচি মুখটাও সুশ্রী দেখাত হয়তো। আমি অবাক এই কারণে যে ওই ছেলেটাও সামনের রমণীটির মতোই টলতে টলতে। ঢুলতে ঢুলতে পথ ভেঙে এগিয়ে আসছে।
সবিস্ময়ে আবার বন্ধুর দিকেই ফিরলাম আমি।–এই সাত সকালে দুটোতেই মদ গিলে ঘরে ফিরছে নাকি? কে ওরা-মা আর ছেলে?
বন্ধু জবাব দিল, তাই। তুমি আর ড্যাব ড্যাব করে ওদিকে তাকিয়ে থেকো না। ওই বজ্জাতও নতুন মানুষ দেখে তোমার দিকে মন দিয়েছে দেখছি-রসিক জন। ভেবেছে বোধহয়।
রাস্তাটা বেঁকে বাড়িটার পাশ ঘেঁষেই সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মেয়েটা অপলক চোখে সত্যি আমাকে দেখতে দেখতেই, বাড়িটা পার হল। অস্বস্তি তার পরেও। বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতেও ঘাড় ফিরিয়ে আমাকেই দেখছে। তার পরের বিস্ময় অভাবনীয়। দাঁড়িয়েই গেল এবং ঘুরে এদিকেই চেয়ে রইল। এদিকে বলতে বন্ধুর দিকে নয়, শুধু আমার দিকে। মাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ছেলেটাও মায়ের কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে তাকালো।