আ-হা, একটু খুশি হয়ে ও মন্তব্য করল, আমি ওর তুলনায় পেত্নী।
কিন্তু আমাদের হালকা হবার চেষ্টা ব্যর্থ। বাড়ির কাছাকাছি যে দুজন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তারা জয়ন্তীর মেজদা আর ছোড়দা। এক নজর তাকিয়েই বোঝা গেল, তারাও যেখান থেকে আসছে, আমরাও সেখান থেকেই। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। জয়ন্তীর ছোড়দা শুধু চোখের ইশারায় পিছনের দিকটা দেখিয়ে দিল। আমরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে মণিদাও। ওদের বড়দা।
তার শুকনো মুখে অপ্রতিভ হাসির আভাস। কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু সেও রাণী প্রসঙ্গ তুলল না, বা কিছু জিজ্ঞাসা করল না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়েই চার ভাইবোনের মধ্যে একটা নীরব প্যাক্ট হয়ে গেল যেন। তারপর ভাইদের আমার দিকে চোখ পড়তেই জয়ন্তী তেমনি নিঃশব্দ ইশারায় আশ্বস্ত করল, এ-দিক ঠিক আছে।
দোতলায় উঠেই সিঁড়ির পাশে কাকীমার পুজোর ঘর। সন্ধ্যার মুখ তখন। মুখ হাত ধুয়ে কাকীমা এ-সময়টা আধঘণ্টা খানেকের জন্য বৈকালিক জপে বসেন। আজও বসেছেন। ৬৫০
কাকীমা সকলকে একে একে তার ঘরটা অতিক্রম করতে দেখলেন। আমার দিকে চোখ পড়তে প্রসন্ন আহ্বান জানালেন, এসো, খবর ভালো তো?
আমি ঘাড় নাড়লাম। নিজের অগোচরে কাকীমার স্বামীর ফোটোখানার দিকে চোখ গেল। ফোটোর গলায় প্রতিদিনের মতই টাটকা মালা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, জয়ন্তী আর তার দাদারাও অদূরে দাঁড়িয়ে গেছে। সশঙ্ক, অপরাধী দৃষ্টি।
খুব সাদাসিধেভাবেই কাকীমা জিজ্ঞাসা করলেন, রাণী দেখে এলে বুঝি?
এমন বিড়ম্বনায় জীবনে পড়িনি বোধহয়। আমি যে রাণী দেখে এলাম সে কি আমার মুখে লেখা ছিল? কিন্তু এই ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ালে সত্যি জবাব যা সেটা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিজের অগোচরেই বলে ফেললাম, হ্যাঁ। তারপর শুকনো হাসি, আমার তো লেখা-টেখার ব্যাপারে দেখতেই হবে।
তেমনি সহজ সরল কৌতূহলে কাকীমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলে?
হঠাৎ কি যে হল কে জানে। অকারণ জোর আর অকারণ উৎসাহভরে বলে ফেললাম, চমৎকার, এত সুন্দর আগে ভাবিনি।
তাই নাকি! কাকীমার প্রসন্ন বিস্ময়। তারপর ভাশুরঝি আর ভাশুরপোদের নির্বাক মুখের দিকে চোখ পড়ল।–ওরা কিছু বলছে না যে, ওদের ভালো লাগেনি বুঝি?
বোন আর ভাইয়েরা বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। ধরা পড়ে হঠাৎ কাকীমার ওপরেই যেন সব রাগ গিয়ে পড়ল জয়ন্তীর। এক পা এগিয়ে এসে তরল উদ্দীপনায় বলে উঠল, খুব ভালো লেগেছে কাকীমা, কত সুন্দর ভাবতেও পারবে না, দেখলে চোখ। ফেরানো যায় না, একসঙ্গে যেন লক্ষ্মী সরস্বতী।
সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার ছোড়দা তেমনি ছদ্ম আগ্রহে যোগ দিল, খবরের কাগজের ছবিতে যেমন দেখো তার থেকে অনেক সুন্দর-কাগজে কিছুই ওঠে না।
আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কাকীমার মুখের ওপর। কিন্তু সেই মুখে কৃত্রিমতার আভাসও চোখে পড়ল না। সহজ সরল কৌতূহল। দেখে সকলে খুশি হয়েছে তাইতেই খুশি যেন। প্রসন্ন মন্তব্য, হবারই কথা, সুন্দরের গুষ্টি ওরা শুনেছি–আ-হা, বেঁচে থাক–
জয়ন্তীকে বললেন, মুখ হাত ধুয়ে ওদের খেতে দে, নিজেও খেয়ে নেখিদেয় মুখ চোখ বসে গেছে সব।
জপে মন ফেরানোর জন্যে ঘুরে বসলেন।
আমরা নির্বাক। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ইংরেজ রাজদুহিতার উদ্দেশে কাকীমার ওই সাদাসিধে আশীর্বাদটুকু আমাদের কানের ভিতর দিয়ে বুকের কোথায় গিয়ে পৌঁছুল হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারছি না।
নিজের অগোচরে আরো একবার তাকালাম।… অমন মাতৃত্বমণ্ডিত মুখ আর যেন দেখিনি আমি।
আজও থেকে থেকে মনে হয়, ভারতবর্ষ দেখতে এসে রাণী ভারতবর্ষের জনতা দেখে গেলেন শুধু, আর ভারতবর্ষের ভূগোল-পথে বিচরণ করে গেলেন। ভারতবর্ষ দেখতে পেলেন না।
হিসেবের বাইরে
সকাল সাতটাও নয় তখন। বাইরের বাঁধানো দাওয়ায় গরম চাদর মুড়ি দিয়ে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলাম। একটু আগে এখানে বসেই প্রাথমিক চায়ের পর্ব শেষ হয়েছে। শীতের সকাল কুয়াশায় ঢাকা। রোদের ছিটেফোঁটাও নেই এখন পর্যন্ত। তাছাড়া কলকাতা থেকে এখানকার এই খোলামেলা জায়গায় শীতও বেশি। নিউ ব্যারাকপুরের লোকালয় ছাড়িয়ে একটু নিরিবিলিতে বন্ধুর এই বাড়ি। না শহর না গ্রাম। বন্ধুর আমন্ত্রণে দুদিনের অবকাশ কাটাতে এখানে আসা। একই আপিসে পাশাপাশি চাকরি করি। তবে চাকরিতে বন্ধুটি আমার থেকে কিছুটা পদস্থ। তার ওপর অফিস ইউনিয়নের হোমরা-চোমরা একজন। সকলেই মান্যগণ্য করে। এমন কি মালিকরাও তাকে একটু-আধটু সমীহ করে। কলকাতা থেকে একটু দূরে থাকার বাসনায় এইখানে জমি কিনে বছরখানেক আগে এই ছিমছাম ছোট বাড়িটি করেছেন ভদ্রলোক। এখান থেকেই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন এখন। দিনের কাজকর্ম চুকিয়ে একবার বাড়ি এসে বসতে পারলেই কি-যে মহাশান্তি সেকথা অজস্রবার শুনিয়েছেন। আর, একবার এসে দেখে যাবার তাগিদও বহুবার দিয়েছেন। গত সন্ধ্যায় আপিস ফেরত দুজনে এক সঙ্গেই চলে এসেছি। আগামী কালটা দুজনেই ছুটি নিয়েছি। তার পরদিন রবিবার। অতএব প্রাণখোলা আড্ডার ঢালা অবকাশ।
শীতের সকালে কলকাতায় সাড়ে সাতটা-আটটার আগে লেপের তলা থেকে বেরুতে পারি না। কিন্তু এখানে ছটা না বাজতে কেউ যেন ঠেলে তুলে দিল। তার বেশ খানিক আগে থেকেই পাখির কিচির-মিচির কানে আসছিল। ভোরের আলোয় তারা যেন মিষ্টি আলাপের আসর বসিয়েছে। এখানে কুয়াশা মাখা সকাল কলকাতার মতো নয়। ধোঁয়ার গন্ধের লেশমাত্র নেই। লেপের মায়া ছেড়ে উঠে পড়েছিলাম। ঘরের পিছনের দিকের জানলার সামনে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়েছিলাম। অনেকটা জায়গা। জুড়ে ধানী জমি। কুয়াশায় ভালো চোখ চলে না, তবু মনে হল ওই জমিটার পাশ দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার শেষ কোথায় গিয়ে মিশেছে তা আর আদৌ ঠাওর হচ্ছিল না।