আমার সামনের দুহাতের মধ্যে যে-লোকটি সকলের মাথার উপর দিয়ে আধ হাত গলা বাড়িয়ে সামনের ফাঁকা রাস্তাটাই একবার দেখে নেওয়ার জন্যে কসরৎ করছে, তাকে আমি চিনি। আর, কলকাতা ছেড়ে গোটা বাংলাদেশের লোক এখানে ভেঙে পড়লেও ওই একজনের এখানে আসার কথা নয়।
আমার বহুদিনের পরিচিত চাটুজ্জে বাড়ির বড়দা-মণিদা।
পরস্পরের দেখা হয়ে গেলে কে অপ্রস্তুত হবে না ভেবেই আমি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের ভিড়ে ভেসে পড়লাম। আধ ঘণ্টার চেষ্টায় বেশ খানিকটা তফাতে আসা গেল। তার পরেই একটা বন্ধ দোকানের উঁচু ধাপের দিকে চোখ যেতেই আবার ধাক্কা! চোখের দোষ নেই, বেশ একটি সুশ্রী মেয়ে ভিড় বাঁচিয়ে দোকানের বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কিন্তু আমি চমকে উঠেছি, কারণ, ওই মেয়েও চাটুজ্জে বাড়ির একজন। বড়দা অন্যথায় মণিদার ছোট বোন জয়ন্তী। আমার সঙ্গে ওই বাড়ির আত্মীয়তার সূতোটায় পাঁচঘোঁচ অনেক। মাসতুতো বোনের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটাকে কোনোভাবেই কাছের সম্পর্ক বলা চলে না। কিন্তু সর্বদা যাওয়া-আসার ফলে সম্পর্কটা কাছেরই হয়ে গেছে।
এবারে আর নিঃশব্দে আড়াল হওয়া গেল না। চেষ্টা-চরিত্র করে, আর, অনেকের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।
দেখার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তী একদফা থতমত খেয়ে উঠল। ভিড় ঠেলে উঁচু ধাপটা থেকে নেমে আসতে আসতে সামলে নিল একটু। কাছে এসে হাসতে চেষ্টা করে কৈফিয়তের সুরে বলল, কাণ্ড দেখুন লোকের, এমন আটকে গেছি যে নড়াচড়ার উপায় নেই।
জয়ন্তী ইস্কুলে মেয়ে পড়ায়, উক্তিটা যে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল নিজেই বুঝেছে। ওদের বাড়ি যেতে হলে এতটা আসতে হয় না, আটকে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, যাচ্ছিলেন কোথায়?
বললাম, কোথাও না, এখানেই এসেছি।
জয়ন্তী আবারও ঢোঁক গিলল। ভিড়ের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে বলল, চলুন, বাড়ির দিকে যাই… কিন্তু বেরুবেন কি করে?
একটা জায়গা দেখে দাঁড়াই চলো, এসেছি যখন দেখেই যাই।
জয়ন্তী থমকে গিয়ে মুখের দিকে তাকালো। অপ্রতিভ হাসির আভাস, একটু অসহিষ্ণুও।বাড়ি গিয়ে আবার হড়বড়িয়ে বলে দেবেন না তো?
-না।…. তাছাড়া ওদিকে মণিদাও সকলের মাথার ওপর দিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে দেখলাম।
শুনে জয়ন্তী ঘুরে দাঁড়ালো একেবারে।–বড়দা? কই?
এখান থেকে দেখবে কি করে! আছে…। চলো, ওদিকে চলো—
বিস্ময় কাটিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আবার সামনের দিকে এগলো সে। একটা অপরাধপ্রবণতার অনুভূতি জোর করেই বিলুপ্ত করার চেষ্টা। বলে উঠল, আসবে না। কেন, এর সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক কি?
আমার নীরবতাটুকুই সায়ের মতো। দু চোখ আপাতত দুজনের মতো একটু জায়গা আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন।
এবারে একটু পূর্ব কথা বলে নেওয়া দরকার। জয়ন্তীর ওপরে তিনটি দাদা ও-ই সকলের ছোট। ওদের বাবা বিপ্লবী হরিশ চ্যাটার্জীর আপন বড় ভাই। ইংরেজ শাসনে যে হরিশ চ্যাটার্জীর প্রায় তিরিশ বছর আগে ফাঁসি হয়ে গেছে। জয়ন্ত ছেড়ে জয়ন্তীর ছোড়দাও জন্মায় নি তখনো। তাহলেও সেই কাকার আত্মাহুতির এক নিবিড় স্পর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে ওই বাড়ির সবকটি ছেলে মেয়ে। কাকীমা আছেন, তার বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। ওই বাড়ির তিনিই শুচিশুভ্র আদর্শ। ভাই বোন সকলেরই ওই কাকীমা-অন্ত-প্রাণ, তারই প্রভাবে মানুষ ওরা। কাকীমা পূজা-আহ্নিক করেন, সেই ঘরে দেবতার পাশেই বিপ্লবী স্বামীর ফোটো। রোজই মালা দেওয়া হয় ফোটোতে। জয়ন্তীরা ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম যত না করে, কাকার ফোটোতে প্রণাম করে। তার থেকে বেশী। কাকীমাও বলতে গেলে দিবারাত্রি ওই ঠাকুরঘরেই থাকেন, ঠাকুরঘরের মেঝেতে শোন।
হরিশ চ্যাটার্জীর ফাঁসির পর ও-বাড়িতে কোনো বিলিতি সামগ্রী ঢোকা দূরের কথা, বিলিতি বাতাসটুকু পর্যন্ত ঢুকতে পায়নি। আজও না। সেবারে কাকীমার অত বড় অসুখটাতেও এক ফোঁটা বিদেশী ওষুধ চলেনি। কাকীমা বলেছেন, মরবই তো একদিন তাতে কি, কিন্তু তোরা মারিস না।
মনের জোরে কাকীমা কবিরাজী চিকিৎসাতেই সেরে উঠেছিলেন।
রাণীর আসার ব্যাপারে আমি ওই এক বাড়িতেই শুধু আলোচনা শুনিনি। সকলকেই নিস্পৃহ, নিরাসক্ত দেখেছি। ঠিক তাও নয়, উল্টে যেন সকলের মনের তলায় এক ধরনের গাম্ভীর্য থিতনো দেখেছি।
.
রাণী এলেন। রাণী চলে গেলেন। জনতার অভ্যর্থনার উল্লাস আকাশে গিয়ে ঠেকল। শৃঙ্খলাবদ্ধ জনতা বাঁধভাঙা বন্যার মতোই তারপর আলোড়িত হয়ে উঠল। তার ভিতর দিয়ে পথ করার চেষ্টাও বিপজ্জনক।
রাণীদর্শনতৃপ্ত একটু-আধটু আলোচনা কানে আসছে। রাণীর রূপের ব্যাখ্যা, পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, তিনটি ছেলেমেয়ের মা–অথচ দেখে মনে হয় বাইশ বছরেরটি–না। জানলে বিবাহিত কিনা বোঝা শক্ত-রাণীর পরনে কি ছিল, কোন দিকে তাকিয়েছিলেন রাণী, কার চোখে চোখ পড়েছে, এই ভিড় আর এই অভ্যর্থনা দেখে রাণীর কতটা খুশি হওয়া সম্ভব, রাণীর স্বামী ওই ফিলিপ ভদ্রলোক বেচারী না ভাগ্যবান, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরো ঘণ্টাখানেক পরে পাশাপাশি জয়ন্তীদের বাড়ির দিকে চলেছি। একটু সহজ হবার জন্যেই বোধহয় জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলেন?
বললাম, তোমার থেকে সুন্দর নয় ভাবতে চেষ্টা করছি।