- বইয়ের নামঃ কথামালা
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আপস
এটা গল্প ঠিক নয়, মনস্তত্ত্বগ হিউম্যান বিহেভিয়ারিজম বা মানবিক আচরণের একটা অতিবাস্তব নজির বলা যেতে পারে। পল্লব গুপ্ত বয়সে আমার থেকে ঢের ছোট হলেও বন্ধুস্থানীয়। দাদা বলে ডাকে কিন্তু জিভ ছুটলে মনে-মুখে লাগাম নেই। এক-এক সময় ওর কথা শুনলে আমারই কানের ডগার রং বদলায়। কিন্তু ও-ছেলের এতটুকু সংকোচের বালাই নেই।
এক-একজন থাকে যার স্বভাব-চরিত্রের অবাঞ্ছিত দিকগুলোও বেশ অনায়াসে বরদাস্ত করা যায়, অন্যায় করে বেড়ালেও খুব অসহ্যরকমের অন্যায় মনে হয় না। সেগুলো দোষের ব্যাপারগুলো জানা থাকলেও তার সঙ্গ-সান্নিধ্য ভাল লাগে। পল্লব গুপ্ত সেই জাতের একজন।
পৈতৃক অবস্থা ভাল, নিজে মস্ত ফার্মের মোটা মাইনের পাবলিক রিলেশনস অফিসার। অনেকের মতে, এই চাকরিটাই ওকে আরো তরল-মতি করে তুলেছে। পকেটে সর্বদা দামী সিগার মজুত, হাতেও একটা জ্বলছেই। বড় বড় পার্টিকে বশে আনার দায় তার, সেই কারণে ওর কোম্পানির অঢেল খরচা করতেও দ্বিধা নেই –আর তাদের চিত্তবিনোদনের এই সব খরচাই হয়ে থাকে পল্লব গুপ্তর মারফত। পি. আর. ও.পাবলিক রিলেশনস অফিসার, অতএব সে-ই হোস্ট। ফলে, বড় বড় ড্রিঙ্ক পার্টিতে সকলের কাছে নিজেকে ইনটারেস্টিং করে তোলাটা চাকরির অঙ্গ। আর তার ফলে দস্তুরমত পানাসক্ত যে হয়ে পড়ছে এও নিজেই স্বীকার করে। নিজেই এক-এক সময় বলে, এ-শালার চাকরি থেকে কোনো একদিন রিটায়ার করার পর অবস্থাখানা যা হবে আমার, স্বভাব-চরিত্র একেবারে খেয়ে দিলে। কিন্তু এ নিয়ে ও সত্যি এতটুকু দুশ্চিন্তায় পড়েছে এ কোনদিন মনে হত না। পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে তাতেও দুই-এক পুরুষ চোখ বুজে জাহান্নমে যেতে পারে।
পল্লব গুপ্তর স্বভাব-চরিত্রের আরো একটা দুর্বল দিক আছে। সেটা সুরূপা রমণী সংক্রান্ত। দিলখোলা হাসি-খুশি মিষ্টি চেহারার ছেলেটার মেয়েমহলেও বেশ কদর। এই ব্যাপারে বারকয়েক বিপাকে পড়তে পড়তে কোনরকমে পিছলে বেরিয়ে এসেছে। তবু মেয়েদের নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করে আনন্দে কাটানার নেশাটা ছাড়তে পারেনি। একবার এক উঠতি ফিল্ম-আর্টিস্টের পিছনে এমন মেতে গেল যে চাকরি-বাকরি শিকেয় ওঠার দাখিল। আমরাও ধরেই নিলাম ওই ফিল্ম-আর্টিস্টই ওর গলায় ঝুলল। শেষে একদিন ও এসে নিজে থেকেই বলল, বাপের পুণ্যিতে খুব কাটান দিয়ে এলাম দাদা–বারোটা বেজে গেছল আর কি!
কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করেছি, এত কি ভয়ের ব্যাপার ছিল?
-আর বলেন কেন দাদা, এমন বুদ্ধ বনে গেলাম না যে নিজেকেই রামছাগল বলে গালাগাল না দিয়ে পারলাম না। আচ্ছা দাদা, আপনার কাছেও তো এনেছিলাম একদিন, নিজেই দেখেছেন–এমন নরম-সরম মিষ্টি হাবভাব দেখলে কোন শালা না। ধরে নেবে অক্ষত কুমারাটি একেবারে–আরও ভেবেছিলাম বারো ভূতে দেবে অমন একটা মেয়েকে লুটে-পুটে শেষ করে, তার আগে নিজেই পাকাপাকি দখল নিয়ে বসি। অনেকটা এগিয়েও ছিলাম বেশ, শেষে বলে কিনা, তোমাকে ছাড়া আর আমার চলছে না–এবারে ডিভোর্স স্যুট ফাইল করা যাক একটা, খরচপত্র যা লাগে তুমিই দেবে কিন্তু বাপু। শেষে জেরায় এগিয়ে আমি তো চিত্তির–শুধু বিবাহিতা নয়, দুদুটো মেয়ে আছে মহিলার!
-তারপর?
-তারপর আর কি, আমি বললাম, তার ডিভোর্স সহজ হলেও আমার ডিভোর্স সহজ হবে না, আমার গৃহিণীটি আঁশ-বঁটি নিয়ে তাড়া করবে দুজনকেই। আমিও বিবাহিত শুনে সে প্রথমে তাজ্জব, তারপর ঠক-প্রবঞ্চক রাস্কেল-টাস্কেল বলে বিদায় দিল আমাকে। আমি মনে মনে গঙ্গার চান সেরে সোজা আপনার এখানে, কারণ আপনি অবান্তরে এগোতে বারণই করেছিলেন আমাকে।
কেন বারণ করেছিলাম সঠিক বলতে পারব না, ফিল্ম-আর্টিস্টকে নিয়ে ওর সংসারযাত্রা খুব সুনির্বিঘ্ন হবে মনে হয়নি সম্ভবত। কিন্তু ছেলেটার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি। ধাক্কা খেয়ে তক্ষুনি নিজেকেও বিবাহিত বলে চালিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই গোছের আরো ছোট-খাটো দুই-একটা ধাক্কা খাবার পরেও ও-যে রমণীসঙ্গবিরহিত জীবন যাপন করছে, এমন নয়। এখনো অনেক সময় অনেক রকম মেয়ের সঙ্গে ওকে মেলামেশা করতে দেখা যায়। আর অম্লানবদনে নিজের এমন সব কীর্তির কথা বলে যে সাধারণস্থলে কান গরম হবার কথা। কিন্তু পল্লব গুপ্তর বলার ঢংটাই এমন-যে না শুনে পারা যায় না–শোনার পর ধমক-ধামকের প্রশ্ন।
এ-হেন পল্লব গুপ্ত একদিন এসে মুখ বেজার করে বলল, এবারে সত্যিই একটা যন্তন্নার মধ্যে পড়ে গেলাম দাদা, কি যে করি
জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার–কোনো মেয়ে?
–তাছাড়া আর কি!
–আবার ফেঁসেছ?
–ফেঁসে যাবার জন্য এবারে তো আমি হাঁ করে আছি, কিন্তু সে-ভাগ্য হবে কি হবে না সেই চিন্তাতেই তো এত যন্ত্রণা! আচ্ছা দাদা, এর নামই কি প্রেম?
জবাব না দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, মেয়েটা কে, আবার কোনো ফিল্ম আর্টিস্ট?
-না না, সে-রকম কিছু নয়–সোজাসুজি এক ভাল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে-বলেই ফেলি আপনাকে, আমার মাসির ভাশুরের মেয়ে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে দেখেছিলাম মেয়েটাকে, ভাল করে ফিরেও তাকাইনি–তখন বিশ বছর বয়েস আমার, আঠেরো বিশের শাড়ি-পরা সেই সব ডবকা ইয়ের মেয়ে ভিন্ন কারো দিকে তাকাতামই না। কিন্তু সেই চৌদ্দ বছরের মেয়ে যে বাইশ বছর বয়সে এ-রকম হয় তখন কি ছাই একবারও মনে হয়েছে। বিশ্বাস করবেন না দাদা, পাশ ঘেঁষে চলে গেলেও মনে হয় গায়ে এক ঝলক গরম বাতাসের ঘেঁকা লাগল। আর চোখে চোখ রেখে হেসে হেসে কথা বলে যখন, উঃ! এক গেলাস জল খাওয়ান দাদা