যোগীন সিং অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কাণ্ডবিস্তারে আগ্রহ দেখা গেল না। একটু বাদেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে ব্যস্ত পায়ে কোথায় চলে গেল। কিছু হয়ত মনে পড়ে থাকবে।
যথা সময়ে এয়ার অফিসে এসে হতাশ হলাম। এই আবহাওয়ায় প্লেন ছাড়বে। মনে হয় না। ঝোড়ো বাতাস ক্রমে বাড়ছে, আকাশের অবস্থা ভয়াবহ। এ সময় কুচবিহার থেকে ওই একটাই প্লেন ছাড়ার কথা। ছোট বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের মালবাহী প্লেন। ছাড়বে কি ছাড়বে না এ নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায় না। তবু ক্যাপ্টেন যোগীন সিং আসতে অফিস থেকে তাকে জানানো হল, সব জায়গারই ওয়েদার রিপোর্ট খারাপ –টেক অফ করা ঠিক হবে না।
যোগীন সিং কান দিলে না, নিঃশঙ্ক জবাব দিল–ও কিছু না, উপর দিয়ে চলে। যাব।
আমার ভয় ধরল একটু। এক ফাঁকে তাকে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম–এর মধ্যেই তুমি যাবে?
-তুমি থেকে যাও না, কাল যেও!
নিজের কাজে চলে গেল। দ্বিধা কাটিয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করলাম। প্লেন যাবে, যোগীন সিং যাবে, এত মালপত্র যাবে, সঙ্গে যাত্রীও যাবে আরো–এর মধ্যে নিজের প্রাণটার জন্য এত ভাবতে লজ্জা করল। তাছাড়া সত্যিই বিপদের সম্ভাবনা। থাকলে যোগীন সিংই বা রওনা হতে চাইবে কেন?
প্লেন উঠল। আমরা চারজন মাত্র যাত্রী। এ ছাড়া পাইলট, কো-পাইলট এবং দু-চারজন ক্রু। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের, অর্থাৎ যাত্রীদের অবস্থা সঙিন। মালবাহী প্লেনের বসার আসনের ব্যবস্থা প্যাসেঞ্জার প্লেনের মতো নয়। মালের সঙ্গে খানিকটা মালের মতো হয়েই আসা। তবে কোমরে বাঁধার বেল্ট গোছের কিছু আছে। সামনেই মুহুর্মুহু লাল আলো জ্বলছে, ফ্যাসন ইওর বেল্ট-বেল্ট বেঁধে বসুন। কিন্তু ওই বেল্ট বাঁধা সত্ত্বেও স্থির হয়ে বসে থাকা অসম্ভব।
বাইরে ঝড় কতটা হচ্ছে টের পাচ্ছি না। কিন্তু ঝাঁকানি দোলানিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘড়ি দেখলাম। সময় অন্যায় আমরা কলকাতার ওপরে এসে পড়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণের। মধ্যেই ভয় আর ত্রাসে শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। অনেক উঁচু দিয়ে প্লেনটা চক্রাকারে ঘুরছে। নীচে নামার এক একটা চেষ্টার মুখে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড-আমরা কে কোথায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছি ঠিক নেই। মনে হচ্ছে ঝড়ের মুখে কুটোর মতো এখুনি সব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
চোখের সামনে মৃত্যু দেখছি আমরা। মৃত্যু প্রতীক্ষা করছি। এরই মধ্যে ঝড়ের তাণ্ডব এড়িয়ে কোনোমতে প্লেন সম্ভবত অনেক উঁচুতে উঠে স্থির হল একটু। ভিতরে সকলে চিৎকার করে বলাবলি করতে লাগল, প্লেন আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, যেখান থেকে এসেছি সেইখানে, অথবা যে-কোনো দূর দূরান্তে যেখানে ঝড় নেই। আমিও একমত, কিন্তু জানাব কাকে?
জানাবার সুযোগ হল। কি কারণে মিনিট দুইয়ের জন্য কো-পাইলটের হাতে প্লেন ছেড়ে একবার ভিতরে এল ক্যাপ্টেন সিং। মনে হল, ভগবান আমাদের আরজি শোনাবার জন্যেই তাকে ভিতরে পাঠালেন। বিপদ সম্বন্ধে আমরা বেশি বুঝি, কি সে বেশি বোঝে সেই জ্ঞানও তখন আমাদের নেই। শুধু বাঁচতে চাই, বাঁচার আকুতি।
অন্য যাত্রীরা তাকে দেখেই চেঁচামেচি করে উঠল। তারা আশ্বাস চায়, বাঁচার আশ্বাস। প্লেন ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলল তারা। কিন্তু অনুভূতিশূন্য পালিশ-করা মূর্তি যোগীন সিংয়ের। কারো কথার জবাব দিলে না। ভিতরের একটা ছোট্ট খুপরির মধ্যে গিয়ে ঢুকল, আর দু মিনিট বাদেই বেরিয়ে এল।
এইবার তাকে দেখা মাত্র আমার ত্রাস আরো বেড়ে গেল। কারণ আমার মনে হল, ওখানে গিয়ে সে গলায় খানিকটা মদ ঢেলে এলো। সত্যি মিথ্যে জানি না। কিন্তু আমার তাই মনে হল, বিশ্বাস হল। রাগে ক্ষোভে আর ভয়ে দেহ অবশ। মনে হল, এক বদ্ধ পাগলের পাল্লায় পড়েছি আমরা। এই দুর্যোগ থেকে আর অব্যাহতি নেই, প্রাণের আশা নেই।
যোগীন সিং ভিতরে চলে গেল। কোথা দিয়ে কোথায় উড়ছি জানি না, তবে প্লেনের দাপাদাপি অপেক্ষাকৃত কম। ভাবতে চেষ্টা করলাম, হয়ত আমার অনুমান মিথ্যা, যোগীন সিং হয়ত কোনো কাজেই ওই খুপরির মধ্যে ঢুকেছিল। ডিউটির সময় মদ খাবেই বা কোন সাহসে। আশা করতে ভালো লাগল, আমরা হয়ত কোনো নিরাপদ স্থানেই ফিরে চলেছি। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। কোন দিকে চলেছি কিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না।
অকস্মাৎ মিনিট কয়েকের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর বিবরের মধ্যেই যেন ঢুকে পড়লাম আমরা। দেহের সব রক্ত প্রবল বেগে শিরশির করে উঠতে, বুঝলাম শাশা করে নীচের দিকে নামছে প্লেন। ঝড়ের সামান্য একটু বিরতির অপেক্ষায় ছিল যোগীন সিং। তারপরেই সব বোঝাবুঝির বাইরে আমরা।
দশ মিনিট গেছে, কি দশ ঘণ্টা গেছে, কি অনন্তকাল গেছে–কিছুই জানি না। একসময় সচেতন হয়ে দেখলাম প্লেন থেমে আছে, আর আমরা বেঁচে আছি। সেটা এমনই বিস্ময় যে চট করে বিশ্বাস হয় না।
দরজা খোলা হতে বাইরের দিকে চেয়ে আরো বিস্ময়। এরোড্রোমেই নেমেছি আমরা। ঝোড়ো হাওয়ায় তখনো দুপায়ের ওপর ভর করে দাঁড়ানো শক্ত। এই বিপদ দেখেই ছোট একটা গাড়ি এসে আমাদের প্লেনের চত্বর থেকে তুলে নিয়ে অফিসে এনে ছেড়ে দিল।
সর্বাঙ্গ অবসন্ন। শান্তি। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে জীবনের আলোয় ফিরে আসার শান্তি। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার মতো শান্তি।
কিন্তু যাব কী করে? এ প্যাসেঞ্জার প্লেন নয় যে কোম্পানির গাড়ি করে তাদের এয়ার অফিস পর্যন্ত অন্তত পৌঁছে দেবে। এদিকে প্লেন চলাচল সব বন্ধ, অন্য কোনো কোম্পানীর গাড়িও যাতায়াত করছে না। বাসও নেই। নির্জীবের মতো এরোড্রোমের রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক কাপ কড়া কফি নিয়ে বসলাম। প্রাণে যখন বেঁচেছি, সমস্ত রাত এখানে কেটে গেলেও খুব আপত্তি নেই।