বনিবনা না হওয়ারই কথা। তার মেজাজের ওপর মেজাজ দেখানোর লোক থাকলে যোগীন সিংয়ের সেখানে টিকে থাকার কথা নয়। তার মতো পাইলট নিয়মিত সার্ভিসের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও অনায়াসে মোটা মাইনের কাজ জোটাতে পারত। মাসে দু-দশ বার ইংল্যাণ্ড আমেরিকা করতে পারত। কিন্তু সে কাজ করতে হলে নিয়মের বশ হতে হয়, মেজাজও কিছুটা খাটো করতে হয়।
যোগীন সিংয়ের সঙ্গে চেনা-যাত্রী হিসেবে আমার আলাপ বটে, কিন্তু হৃদ্যতার আরো একটু কারণ ছিল। বছর তিন চার আগে খবরের কাগজে একটা ফ্রী-ফাইটের ছবি ছাপা হয়েছিল সেটা আজ আর কারো মনে নেই বোধহয়। কলকাতার বাইরের এক অভিজাত হোটেলে বয়সের গরমে আর টাকার গরমে তিনটি ধনী সন্তান নিজেদের ভাষায় এক বিদেশী তরুণী মহিলার উদ্দেশে তরল টিকা-টিপ্পনী কাটছিল। মহিলা ভাষা না বুঝলেও তাকে নিয়েই কিছু হচ্ছে বুঝে ক্রুদ্ধ এবং আরক্ত হয়ে উঠছিলেন। যোগীন সিং মদ খাচ্ছিল আর ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল। উঠে গিয়ে প্রতিবাদ করতে ধনীর দুলালের তিনজনেই একসঙ্গে রুখে উঠল এবং মাতাল বলে কটুক্তি করে উঠল। একে তিনজন তারা, তায় স্বাস্থ্যও কারো খারাপ নয়! যোগীন সিং আর কিছু না বলে নিজের টেবিলে এসে মদের গেলাস খালি করল, তারপর উঠে চুপচাপ বাইরে চলে এল।
একটু বাদে চায়ের পাট শেষ করে আমি বাইরে এসে দেখি, যোগীন সিং নির্লিপ্ত মুখে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতে নিস্পৃহ উক্তি করল–হ্যালো।
আমিও বললাম, হ্যালো।
আলাপ তখনো এর বেশি নয়। এরোড্রোম থেকে বেরিয়ে অনেক সময় এক হোটেলে এসে উঠলেও, লোকটাকে অত মদ খেতে দেখে, আমি তেমন বেশি কাছে ঘেঁষি না। কিন্তু সেদিন আমার সাংবাদিক চোখে কি যেন একটা সম্ভাবনার অস্বস্তি দেখা দিল। ট্যাক্সি ধরার অছিলায় আমিও দাঁড়ালাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। নি। ভিতরের মহিলাটি আগেই চলে গিয়েছিলেন। লোক তিনটিও একটু পরেই বেরুল। তারপর ফুটপাথের ওপরেই খণ্ড যুদ্ধ। দুজনের নাক মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে লাগল–তারা ফুটপাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তৃতীয় জন প্রাণ বাঁচিয়ে মোটরে উঠে চম্পট দিয়েছে।
আমি কিছুই করি নি। শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছি, আর ঠিক যে মুহূর্তটির ছবি তোলা। দরকার, সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলেছি। তারপর ঘটনার বিবরণ লিখে কাগজে পাঠিয়ে দিয়েছি।
এই থেকেই হৃদ্যতা। পরে যোগীন সিং হাসতে হাসতে বলেছে, তার উপকার করেছি আমি। সে অনেক জায়গা থেকে অনেক সাবাস পেয়েছে বলে নয়। লোকগুলোর টাকার জোর আছে, তারা কেস করত, অন্যভাবেও জব্দ করার চেষ্টা করত। কিন্তু খবরের কাগজে এভাবে ফলাও করে সব প্রকাশ হয়ে পড়াতে নিজেরাই গা ঢাকা দিয়ে আছে। খবরের কাগজ তার জোরালো সাক্ষীর কাজ করেছে।
আমি প্রীত হয়েছিলাম। কিন্তু এও জানি, যোগীন সিং কারো উপকারের পরোয়া না রেখেই যা করার করেছিল।
এরপর বাইরের এরোড্রোম থেকে বেরিয়ে সে যখন যে হোটেলে উঠেছে, আমাকেও সেখানেই টেনে নিয়ে গেছে। আমি বসে বসে তাকে অনেক মদ খেতে দেখেছি, কিন্তু মাতাল হতে দেখি নি। তাকে দেখলে বা কথাবার্তা বললে পাঞ্জাবী। বলবে না কেউ। দাড়ি-গোঁফের বালাই নেই, আমাদের মতোই পরিষ্কার বাংলা বলে। ছেলেবেলা থেকে বাংলাদেশেই মানুষ।
যাক, বর্তমানের কথা বলি। কুচবিহার থেকে আমার ফেরার তাড়া ছিল। কিন্তু দুদিনের আগে প্লেনে সীট পাব, সে আশা ছিল না। ইতিমধ্যে যোগীন সিংয়ের প্লেন দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। সে আবার পরদিনই বিকেলে প্লেন নিয়ে ফিরছে জেনে, তাকে ধরলাম, নিয়ে যেতে হবে। যোগীন সিংও তক্ষুনি রাজী। তার এক টেলিফোনে ফেরার ব্যবস্থা হয়ে গেল। কারো আপত্তির প্রশ্ন ওঠে না, যোগীন সিং বলেছে যখন, মালের ওপর বসিয়ে নিয়ে গেলেও নিয়ে যাবেই জানি।–
পরদিন। দুপুর থেকে আকাশের অবস্থা ঘোরালো। কাগজেও ঝড়ের আভাস দিয়েছে। শাঁ শাঁ করে বাতাস বইছে, থমথমে মেঘের গুরু গুরু ডাকটা অন্যরকম।
যোগীন সিংকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই ওয়েদার, যাবে কি করে?
সে নির্ভাবনায় জবাব দিল, যেতে হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, কলকাতায়?
মাথা নাড়লে। হাসলও একটু।
এ ধরনের হাসি আমি চিনি। বললাম–তাহলে তো বেশ জটিল অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে হচ্ছে, সময়ে না গেলে নিশ্চয় কোনো লেডির বিরাগ ভাজন হবার ভয় আছে?
যোগীন সিং আরো হেসে আরো বেশি মাথা ঝাঁকালে। আমার শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সদাব্যস্ত যোগীন সিংয়ের প্রণয় কথা ফেঁদে বসার মেজাজ ছিল না। টুকটাক দু-চার কথা মাত্র জানা গেল। মহিলার নাম যশোধরা। ক্রিশ্চিয়ান। মস্ত ব্যবসায়ীর মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের বড় অবস্থার সময় যোগীন সিং ও-মেয়ের পাত্তা পায় নি। বাপের ব্যবসা লাটে উঠতে খানিকটা সুবিধে হয়েছে। তখনো যোগীন সিংয়ের টান দেখে–না, টান আরো বাড়তে দেখে, যশোধরা বুঝেছে যোগীন সিংয়ের লোভ তার বাবার টাকার ওপর নয়, লোভ তারই ওপর। সে অনেক ব্যাপার
যোগীন সিং হাসি মুখে স্বীকার করেছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করলে রক্ষা নেই সেটা সত্যি কথাই। মেয়ের যেমন মেজাজ তেমনি অভিমান, একবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফেল করার ফলে সে কি কাণ্ড!